বন্ধুগণ,
নিজের জীবন এলো যখন সমাপ্তির দিকে, তখন ডাক পড়লো আমার দেশের এই যৌবন-শক্তিকে সম্বোধন ক’রে তাদের যাত্রাপথের সন্ধান দিতে। নিজের মধ্যে কর্মশক্তি যখন নিঃশেষিতপ্রায়, উদ্যম ক্লান্ত, প্রেরণা ক্ষীণ, তখন তরুণের অপরিমেয় প্রাণধারার দিক-নির্ণয়ের ভার পড়লো এক বৃদ্ধের উপর। এ আহ্বানে সাড়া দিবার শক্তি-সামর্থ্য নেই—সময় গেছে। এ আহানে বুকের মধ্যে শুধু বেদনার সঞ্চার করে। মনে হয়, একদিন আমারও সবই ছিল—যৌবন, শক্তি, স্বাস্থ্য, সকলের কাজে আপনাকে মিশিয়ে দেবার আনন্দবোধ—এই যুব—সংঘের প্রত্যেকটি ছেলের মতই,—কিন্তু সে বহুদিন পূর্বেকার কথা। সেদিন জীবন-গ্রন্থের যে-সকল অধ্যায় ঔদাস্য ও অবহেলায় পড়িনি, এই প্রত্যাসন্ন পরীক্ষার কালে তার নিষ্ফলতার সান্ত্বনা আজ কোন দিকেই চেয়ে আমার চোখে পড়ে না। আমি জানি, এই তরুণ-সংঘকে জোর ক’রে বলবার কোন সঞ্চয়ই আমার নেই। তাদের পথ-নির্দেশের গুরুতর দায়িত্ব আমার সাজে না; সে কল্পনাও আমি করিনে। আমি কেবল গুটি-কয়েক বহুপরিচিত পুরাতন কথা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য এখানে উপস্থিত হয়েছি।
পেশা আমার সাহিত্য; রাজনীতি-চর্চা হয়ত আমার অনধিকার চর্চা, এ কথাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আরও একটা কথা প্রথমেই বলা দরকার, সে আমার নিজের লেখার সম্বন্ধে। আমার বইগুলির সঙ্গে যারা পরিচিত, তারাই জানে আমি কোন দিন কোন ছলেই নিজের ব্যক্তিগত অভিমত জোর ক’রে কোথাও গুঁজে দেবার চেষ্টা করিনি। কি পারিবারিক, কি সামাজিক, কি ব্যক্তিবিশেষের জীবন-সমস্যায় আমি শুধু বেদনার বিবরণ, দুঃখের কাহিনী, অবিচারের মর্মান্তিক জ্বালার ইতিহাস, অভিজ্ঞতার পাতার উপরে পাতা কল্পনার কলম দিয়ে লিপিবদ্ধ করে গেছি—এইখানেই আমার সাহিত্য-রচনার সীমারেখা। জ্ঞানতঃ কোথাও একে লঙ্ঘন করতে আমি নিজেকে দিইনি। সেই জন্যেই লেখার মধ্যে আমার সমস্যা আছে, সমাধান নেই; প্রশ্ন আছে, তার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ এ আমার চিরদিনের বিশ্বাস যে সমাধানের দায়িত্ব কর্মীর, সাহিত্যিকের নয়। কোথায় কোন্টা ভাল, কোন্টা মন্দ; বর্তমান কালে কোন্ পরিবর্তন উপযোগী, এবং কোন্টার সময় আজও আসেনি, সে বিবেচনার ভার আমি সংস্কারকের উপরে রেখেই নিশ্চিন্তমনে বিদায় নিয়েছি; আজকে এই কয় ছত্র লেখার মধ্যেও তার অন্যথা করিনি। এখানেও সেই সমস্যা আছে, তার জবাব নেই। কারণ জবাব দেবার ভার বাঙ্গালার তরুণ-সংঘের—এ বৃদ্ধের নয়। সেইটাই এই অভিভাষণের বড় কথা।
প্রথমেই একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া চাই। তরুণ-সংঘ যে রাষ্ট্রিক সংস্রবে অংশতঃ বিজড়িত, এ সত্য গোপন ক’রে লাভ নেই। এ তার কর্তব্য। অথচ এই শহরে দিন-দুই পরে বাঙ্গালা দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মিলনের কাজ আরম্ভ হবে। সুতরাং উভয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য যখন বহুলাংশে এক, তখন আলাদা করে তরুণ-সংঘ সম্মিলনের কি আবশ্যকতা ছিল ? কেউ কেউ বলেন আবশ্যকতা এই জন্যে যে,তরুন-সংঘের মধ্যে অনেক ছাত্র আছেন এবং ছাত্র না হয়েও এমন অনেক আছেন, যাঁরা খোলাখুলিভাবে রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতে পারেন না। বাধা ও নিষেধ বহুপ্রকার আছে, তাদের জন্য একটা আবরণ দরকার। কিন্তু আবরণ দিয়ে—কৌশলে ও ছলনার আশ্রয়ে, কোন দিন সত্যকার সিদ্ধিলাভ হয় না। কাজ করতেও চাই, উপরওয়ালার চোখেও ধুলো দিতে চাই—এ দুটো চাওয়া একসঙ্গে পাওয়া যায় না, অতএব যুব-সংঘকে স্পষ্ট করে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য দেশের কাছে ব্যক্ত করতে হবে। ভয় করলে চলবে না। কিন্তু তা যারা পারে না, তাদের দিয়ে এটাও হবে না,—সেটাও নিষ্ফল হবে।
কিন্তু আসলে তা নয়। এ দুটো প্রতিষ্ঠানের বাইরের চেহারায় হয়ত অনেক সাদৃশ্য আছে কিন্তু ভিতরের দিক্ থেকে দেখলে দেখা যাবে প্রভেদও অপরিসীম। কংগ্রেস অনেক দিনের—আমারই মত সে বৃদ্ধ; কিন্তু যুব সংঘ সেদিনের—তার শিরার রক্ত এখনও উষ্ণ, এখনও নির্মল। কংগ্রেস দেশের মাথাওয়ালা আইনজ্ঞ রাজনীতি- বিশারদগণের আশ্রয়কেন্দ্র কিন্তু যুব-সংঘ কেবলমাত্র প্রাণের ঐকান্তিক আবেগ ও আগ্রহ দিয়ে তৈরী। একটাকে চালনা করে কূটবিষয়বুদ্ধি, কিন্তু অন্যটাকে নিয়োজিত করে জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম; তাই নানা প্ররোচনা ও উত্তেজনার পর মাদ্রাজ-কংগ্রেস যখন পাস করেছিল দেশের সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতা, তখন সে বস্তু টেঁকলো না—একটা বৎসর গত না হতেই কলিকাতার কংগ্রেসে সে মত নাকচ হয়ে গেল। স্বাধীনতার পরিবর্তে তাঁরা ফিরে চাইলেন Diminion Status; কিন্তু দেশের তরুণদল সে নির্ধারণে কান দিল না। উভয় প্রতিষ্ঠানের এইখানেই পার্থক্য। পুরাতনের বিধি-নিষেধের বেড়াজালে প্রাণ তার হাঁপিয়ে উঠে, যুব-সমিতির জন্ম-ইতিহাসের এই হেতু। শুধুই কি কেবল ভারতবর্ষে? পৃথিবীর যে-কোন দিকে চেয়ে দেখি, সেই দিকেই যেন এর নব অভ্যুদয়ের রক্তরাগ-রেখা চোখে পড়ে। দেখা যায়, কেবল রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয়, সমাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি সর্বপ্রকার নীতির সম্পর্কেই তরুণ-শক্তি যেন নবচেতনা লাভ করেছে। তাঁরা ছাড়া জগতের বর্তমান দুর্ভেদ্য সমস্যা যে কোন মতেই মীমাংসিত হবে না, এ সত্য তারা নিঃসংশয়ে অনুভব করেছে। এটা মস্তবড় আশার কথা। পুরাতনপন্থীরা তাদের মাঝে মাঝে তিরস্কার করে বলেন, তোমরা সেদিনের—তোমাদের কতটুকু অভিজ্ঞতা? যুব-সমিতি এ অভিযোগের উত্তর দিতে ছাড়ে না।
কিন্তু আমি ভাবি, নানা বাগ্বিতণ্ডার মাঝে এ-কথা কেন না তারা স্পষ্ট করে জানায় যে পুরাতনের অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধেই তাদের সবচেয়ে বড় লড়াই? তাদের এই বহুযত্ন-অর্জিত ঘনবিন্যস্ত অভিজ্ঞতার জ্ঞানটাকেই নিঃশেষে দগ্ধ করে দিয়ে তারা জগতকে মুক্তি দিতে চায়। কিন্তু একটা বিষয়ে তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না। কংগ্রেস জাতীয় প্রতিষ্ঠান, বস্তুতঃ এই-ই দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান—যা বিদেশীর রাজশাসনের অবিচার ও অনাচার মুখ বুজে মেনে নেয়নি। তার দীর্ঘকালব্যাপী বাদ-প্রতিবাদ অনুযোগ-অভিযোগের সম্মিলিত কোলাহল বধির রাজকর্ণে প্রবেশ করেনি সত্য কিন্তু এ ছাড়া আর উপায় ছিল কি ? এমনিভাবে দিন চলে যাচ্ছিল, সহসা একদিন এলো মহাত্মার অদ্রোহ-অসহযোগ এবং তার টিকি বাঁধা রইলো তার খাদি-চরকার দড়িতে। স্বরাজের তারিখ ধার্য হলো ৩১শে ডিসেম্বর। এলো জেলে যাবার দিন, এলো আত্মত্যাগের বন্যা। মন্ত্র এলো বাঙ্গালার বাইরে থেকে, অথচ যত চরকা ও যত খাদি সেদিন বাঙ্গালায় তৈরী হলো, যত লোক গেল বাঙ্গালার কারাগারে, যত ছেলে দিলে জীবনের সর্বস্ব বলিদান, সমগ্র ভারতবর্ষে তার জোড়া রইল না। কেন জান? কারণ এই বাঙ্গালার ছেলে যতখানি তার দেশকে ভালবাসে, হয়ত পাঞ্জাব ছাড়া তার একাংশও ভারতের কোথাও খুঁজে মিলবে না। তাই ‘বন্দেমাতরম্’-মন্ত্র সৃষ্টি এই বাঙ্গালায়। এই বাঙ্গালাতে জন্ম নিয়েছিলেন পুণ্যশ্লোক স্বর্গীয় দেশবন্ধু। এদিকে ৩১শে ডিসেম্বর পার হয়ে গেল—স্বরাজ এলো না। কোথায় কোন্ এক অজানা পল্লী চৌরীচৌরায় হলো রক্তপাত, মহাত্মা ভয় পেয়ে দিলেন সমস্ত বন্ধ করে। দেশের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা আকাশ-কুসুমের মত একমুহূর্তে শূন্যে মিলিয়ে গেল। কিন্তু সেদিন একজন জীবিত ছিলেন, তাঁর ভয়ের সঙ্গে পরিচয় ছিল না—তিনি দেশবন্ধু। তিনি তখন জেলের মধ্যে; বাঙ্গালার বাহির-ভিতরের সকলে মিলে দিলে তাঁর সমস্ত চেষ্টা-আয়োজন নিষ্ফল করে। কে জানে, ভারতের ভাগ্য হয়ত এতদিনে আর এক পথে প্রবাহিত হতে পারতো, কিন্তু যাক সে কথা।
আবার কিছুদিন নিঃশব্দে থাকার পরে সাড়া পড়ে গেছে। সেবার ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ, এবার হয়েছে সাইমন কমিশন। আবার সেই চরকা, সেই খাদি, সেই বয়কটের অহেতুক গর্জন, সেই তাড়ির দোকানে ধন্না দেওয়ার প্রস্তাব, সেই ৩১শে ডিসেম্বর, এবং সর্বোপরি বাঙ্গালার বাইরের নেতার দল আবারও বাঙ্গালার ঘাড়ে চেপে বসেছে। আমি জানি এবারও সেই ৩১শে ডিসেম্বর ঠিক তেমনি করে পার হয়ে যাবে। কেবল একটুখানি ক্ষীণ আশার আলো বাঙ্গালার এই যৌবনশক্তির জাগরণ। বঙ্গভঙ্গ সেটেল্ড্ ফ্যাক্ট (settled fact) একদিন আন্সেটেল্ড্ (unsettled) হয়েছিল—সে এই বাঙ্গালাদেশে। সেদিন বাইরে থেকে কেউ ভার বইতে আসেনি, আন্দোলন পরিচালনার পরামর্শ দিতে বাইরে থেকে কর্তা আমদানি করতে হয়নি; বাঙ্গালার সমস্ত দায়িত্ব সেদিন বাঙ্গালার নেতাদের হাতে ন্যস্ত ছিল।
প্রত্যেক দেশেরই স্বভাব, প্রবৃত্তি, রীতিনীতি, চালচলন বিভিন্ন। এ বিভেদ শুধু তার দেশের লোকেই জানে। এই জানার উপর যে কতবড় সাফল্য নির্ভর করে, বহু লোকেই তা ভেবে দেখে না। অবশেষে এই অজ্ঞতাই একদিন যখন বিফলতার গর্তে টেনে ফেলে তখন দেশের লোকের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে বাইরের মানুষে সান্ত্বনালাভ করে। ভাবে সমস্ত দেশের কার্য- তালিকা সর্বাংশে এক হওয়ার নামই বুঝি একতা। বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির মধ্যেও যে সত্যকার ঐক্য নিহিত থাকতে পারে, এই সত্য স্বীকৃত হয় না বলেই গণ্ডগোল বাধে। তাই ত দেশের লোকের হাতেই তার আপনার দেশের কাজের ধারা নিরূপিত হওয়া প্রয়োজন। সাইমন সাহেবের দলেরও ঠিক এই ভুলই হয়েছিল, যখন এক দেশ থেকে এসে তাঁরা আর এক দেশের constitution তৈরির স্পর্ধা প্রকাশ করেছিলেন—এই কথাটা বাঙ্গালার যুব সমিতিকে ভেবে দেখতে আজ আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করি।
আমার বক্তব্য নীরস, অনেকের কানে হয়ত কটু শোনাবে; শব্দাড়ম্বরের ঘটায় বচন-বিন্যাসের কৌশলে উত্তেজনার সৃষ্টি করতে আমি অক্ষম। কিন্তু তোমরা ত জান, সোজা কথা সোজাভাবে বলাই আমার স্বভাব। কারও বিরুদ্ধে কতগুলো কঠোর অভিযোগ করতেও আমি নারাজ, তাই আমার কথার মধ্যে তেমন স্বাদ নেই—এ আমি নিজেই অনুভব করি। কিন্তু ভরসা এই যে, রাষ্ট্রীয় সম্মিলন আসন্নপ্রায়। নেতারা অনেকে এসে পড়েছেন; বাকী যাঁরা আছেন, তাঁরাও এলেন বলে। বক্তৃতা শুনে তোমাদের ক্ষুধা মিটবে। ইংরাজ-রাজত্বের দেড় শো বছরের ইতিহাস তাঁদের কণ্ঠস্থ। ইংরেজ, তুমি এই করেছ—এই করেছ—এই করেছ, এই করনি—এই করনি —এই করনি,—অমুককে লাঠি মেরে খুন করছ,—অমুককে বিনাবিচারে আটক করেছ,—চা-বাগানের অমুক সাহেবকে ছেড়ে দিয়েছ,—অতএব তোমার রাজ্য শয়তানের। এমনি অত্যাচারের ধারাবাহিক ফর্দ দিয়ে জগতের কাছে তাঁদের নিঃসংশয়ে প্রমাণিত করতে হয় যে, ইংরেজ-শাসনপ্রণালী অতিশয় মন্দ এবং তার চাপে আমরা আর বাঁচিনে। সুতরাং হয় আইনকানুন বদলাক, নয় এর সঙ্গে আমরা আর কোন সংস্রব রাখব না। এ-সকলের যে প্রয়োজন নেই তা আমি বলিনে, বরঞ্চ বোধ করি বেশী প্রয়োজনই আছে। কিন্তু প্রয়োজন যতই থাক, এইখানেই উভয় প্রতিষ্ঠানের মনস্তত্ত্বের গভীর ব্যবধান। কারণ শয়তানের রাজ্য কিনা—এ সপ্রমাণ করার দায়িত্ব যুব-সমিতির নেই। তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা এই উত্তরই দেবে যে, বিদেশীর শাসনপ্রণালী যা হয় তাই। কংগ্রেসের সম্মিলিত ধিক্কারে লজ্জিত হয়ে তারা ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করবে কি না, সে তারাই জানে, কিন্তু আমরা জানি তার সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ নেই। স্বাধীনতার বিনিময়ে পরাধীন স্বর্গরাজ্যও দেশের যৌবনশক্তি কোনদিন প্রার্থনা করবে না।
কিন্তু স্বাধীনতা শুধু কেবল একটা নামমাত্রই ত নয়! দাতার দক্ষিণহস্তের দানেই ত একে ভিক্ষার মত পাওয়া যায় না,—এর মূল্য দিতে হয়। কিন্তু কোথায় মূল্য? কার কাছে আছে? আছে শুধু যৌবনের রক্তের মধ্যে সঞ্চিত। সে অর্গল যতদিন না মুক্ত হবে, কোথাও এর সন্ধান মিলবে না। সেই অর্গল মুক্ত করার দিন এসেছে। কোনক্রমেই আর বিলম্ব করা চলে না। কি মানুষের জীবনে, কি দেশের জীবনে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ যখন শূন্য দিগন্ত থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসতে থাকে, তখন কিছু না জেনেও যেন জানা যায় সর্বনাশ অত্যন্ত নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্ষুদ্র পল্লীর অতিক্ষুদ্র নরনারীর মুখের পরেও আমি তার আভাস দেখতে পাই। চারিদিকে দুর্বিষহ অভাবের মধ্যে কেমন করে যেন তারা নিঃসংশয়ে বুঝে নিয়েছে—এদেশে এ থেকে আর নিষ্কৃতি নেই, দুর্নিবার মরণ তাদের গ্রাস করলে বলে।
এদের বাঁচাবার ভার তোমাদের। এ ভার কি তোমরা নেবে না? জগতের দিকে দিকে চেয়ে দেখ—এ বোঝা কে বয়েছে। তোমরাই ত! শুধু এদেশেই কি তার ব্যতিক্রম হবে? শান্তি-স্বস্তিহীন সম্মানবর্জিত প্রাণ কি একা ভারতের তরুণের পক্ষেই এতবড় লোভের বস্তু? দেশকে কি বাঁচায় বুড়োরা? ইতিহাস পড়ে দেখ। তরুণ-শক্তি নিজের মৃত্যু দিয়ে দেশে দেশে কালে কালে জন্মভূমিকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করে গেছে। এ সত্ত্বেও যদি তোমরা ভোলো, তবে এ সমিতি গঠনের তোমাদের লেশমাত্র প্রয়োজন ছিল না।
ভারতের আকাশে আজকাল একটা বাক্য ভেসে বেড়ায়—সে বিপ্লব। বৈদেশিক রাজশক্তি তাই তোমাদের ভয় করতে শুরু করেছে। কিন্তু একটা কথা তোমরা ভুলো না যে, কখনও কোন দেশেই শুধু শুধু বিপ্লবের জন্যেই বিপ্লব আনা যায় না। অর্থহীন অকারণ বিপ্লবের চেষ্টায় কেবল রক্তপাতই ঘটে, আর কোন ফললাভ হয় না। বিপ্লবের সৃষ্টি মানুষের মনে, অহেতুক রক্তপাতে নয়। তাই ধৈর্য ধরে তার প্রতীক্ষা করতে হয়। ক্ষমাহীন সমাজ, প্রীতিহীন ধর্ম, জাতিগত ঘৃণা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, মেয়েদের প্রতি চিত্তহীন কঠোরতা, এর আমূল প্রতিকারের বিপ্লব-পন্থাতেই শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব সম্ভবপর হবে। নইলে অসহিষ্ণু অভিলাষ ও কল্পনার আতিশয্যে তোমাদের ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই দেবে না। স্বাধীনতার সংগ্রামে বিপ্লবই অপরিহার্য পন্থা নয়। যারা মনে করে, জগতে আর সব-কিছুরই আয়োজনের প্রয়োজন, শুধু বিপ্লবেরই কিছু চাই না—ওটা শুরু করে দিলেই চলে যায়, তারা আর যত-কিছুই জানুক, বিপ্লব-তত্ত্বের কোন সংবাদ জানে না। মনে মনে যাঁরা বিপ্লবপন্থী, আমার কথায় হয়ত তাঁরা খুশী হবেন না। কিন্তু আমি গোড়ায় বলে রেখেছি, খুশী করার জন্য এখানে আসি নাই। এসেছি সত্য কথা সোজা করে বলবার জন্যে।
আমরা কতদিকেই না নিরুপায়! অনেকে বলেন, বিদেশী রাজশক্তি আমাদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়ে একেবারে অমানুষ করে রেখেছে। অভিযোগ যে অসত্য তা আমি বলিনে, কিন্তু এই কি সমস্ত সত্য? অস্ত্রশস্ত্র আজই না হয় নেই, কিন্তু হাজার বছর ধরে করেছিলাম কি? তখন ত Arms Act জারি হয়নি! সবচেয়ে বেশী নিরুপায় করেছে—আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আত্মকলহ। তাই বার বার মোগল-পাঠান-ইংরাজের পায়ে আমাদের মাথা মুড়ানো গেছে। পৃথিবীর সমস্ত শক্তিমান জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আত্মকলহ তাদের মধ্যে থাকে না যে তা নয়, কিন্তু বহিঃশত্রুর সম্মুখে সে কলহ তারা স্থগিত রাখতে জানে। শত্রুকে সম্পূর্ণ পরাভূত না করা পর্যন্ত তারা কিছুতেই ঘরোয়া বিবাদে লিপ্ত হয় না। এই তাদের সবচেয়ে বড় জোর। কিন্তু আমাদের? জয়চাঁদ, পৃথ্বিরাজ থেকে শুরু করে সিরাজদ্দৌলা ও মীরজাফরেও এই মজ্জাগত অভিশাপ আর ঘুচল না। বাঙ্গালাদেশ মুসলমানেরা জয় করতে এলো। এদেশে ব্রাত্য-বৌদ্ধেরা খুশী হয়ে তাদের ধর্মদেবতার যশোগান করে ‘ধর্মমঙ্গলে’ লিখলেন —
“ধর্ম্ম হইলা যবনরূপী
মাথায় দিলা কালোটুপী
ধর্ম্মের শত্রু করিতে বিনাশ।”
অর্থাৎ বিদেশী মুসলমানরা যে হিন্দুধর্মাবলম্বী প্রতিবেশী বাঙ্গালী ভায়াদের দুঃখ দিতে লাগল, এতেই তাঁরা পরমানন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলেন। এই ত সেদিনের কথা—নিজেদের মধ্যে লড়াই করতেই অতবড় বিরাট্পুরুষ চিত্তরঞ্জনের সমস্ত আয়ু নিঃশেষ হয়ে গেল। আজও কি তার বিরাম আছে? এই যে যুব-সংঘ, খোঁজ করলেই দেখা যাবে এর মধ্যেও তেরটা দল। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই—এর কতরকমের মতভেদ, কতরকমের মান-অভিমানের অ-বনিবনাও— পদ্মপত্রে জলবিন্দুর মত অস্থির, কখন গড়িয়ে আলাদা হয়ে গেল বলে। বাইরে থেকে জড়ো করে ভিড় করার নাম কি organisation? Organic দেহবস্তুর মত এর পায়ের নখে ঘা দিলে কি মাথার চুল শিউরে ওঠে? কিন্তু যেদিন উঠবে, সেদিন উপায়হীনতার নালিশও অন্ততঃ বাঙ্গালাদেশে উঠবে না।
ভাবি, সেই ত সনাতন সংস্কার! শত্রু এসে সদর দরজায় ঘা দিচ্ছে, তবু দলাদলি আর মিটল না! অথচ এদের পরেই দেশের আজ সমস্ত আশা-ভরসা! কবে যে এর মীমাংসা হবে, তা জগদীশ্বরই জানেন।
আগেকার দিনে দিগ্বিজয়ের গৌরব অর্জন করার জন্যে প্রধানতঃ রাজারা রাজ্যজয়ে বার হতেন, কিন্তু এখন দিনকাল বদলে গেছে। এখন রাজা নেই, আছে রাজশক্তি। এবং সেই শক্তি আছে জন-কয়েক বড় ব্যবসাদারের হাতে। হয় স্বহস্তে করেন, না হয় লোক দিয়ে করান। বণিক্-বৃত্তিই এখন মুখ্যতঃ রাজনীতি। শোষণের জন্যেই শাসন। নইলে তার বিশেষ কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। দশ-পনের বছর পূর্বে যে জগৎ-ব্যাপী সংগ্রাম হয়ে গেল, তার গোড়াতেও ছিল ঐ এক কথা—ঐ বাজার ও খদ্দের নিয়ে দোকানদারের কাড়াকাড়ি।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।