হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৯ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
হযরত আয়েশা (রাঃ) আঠারো বছর বয়সে বিধবা হন এবং এ অবস্থায় জীবনের আরো আঠচল্লিশটি বছর অতিবাহিত করেন। যতদিন জীবিত ছিলেন, কবর পাকের পাশেই ছিলেন। প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কবরের পাশেই ঘুমাতেন। একদিন রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) স্বপ্নে দেখার পর সেখানে ঘুমানো ছেড়ে দেন। হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে ঘরে দাফনের পূর্ব পর্যন্ত হিজাব ছাড়া আসা-যাওয়া করতেন। কারণ, তখন সেখানে যে দুই জন শায়িত ছিলেন, তাঁদের একজন স্বামী এবং অপরজন পিতা। তাঁদের পাশে উমার (রাঃ)-কে দাফন করার পর বলতেন, “এখন ওখানে যেতে গেলে হিজাবের প্রয়োজন হয়।”
আল্লাহ পাক আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের (পবিত্র সহধর্মিণীগণ) জন্য দ্বিতীয় বিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ এক ব্যক্তি ইচ্ছা করলেন যে, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইনতিকালের পর তাঁর কোন এক স্ত্রীকে বিয়ে করবেন। হাদীসের বর্ণনা সূত্রে একজন বর্ণনাকারী সুফইয়ানকে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেনঃ “তিনি কি আয়েশা (রাঃ)?” সুফইয়ান বললেনঃ “বর্ণনাকারীরা তাই উল্লেখ করেছেন।” সুদ্দী বলেনঃ যে ব্যক্তি এমন ইচ্ছা করেছিলেন, তিনি হলেন তালহা ইবন উবাইদিল্লাহ। এরই প্রেক্ষিতে নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়ঃ
আরবি হবে
“আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেওয়া এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁর পত্মীগণকে বিয়ে করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর কাছে এটা গুরুতর অপরাধ।”
অপর আয়াতে আল্লাহ পাক আযওয়াজে মুতাহ্হারাতকে মুসলমানদের জননী বলে ঘোষণা করেন।
আরবি হবে
“نَبِيُّوْنَ لِلْمُؤْمِنِينَ أَزْوَاجُهُمْ أُمَّهَاتُهُمْ”
মূলকথা হলো, আযওয়াজে মুতাহ্হারাত—যাঁরা তাঁদের জীবনের একটি অংশে মহানবীর (সাঃ) জীবনসঙ্গিনী ছিলেন—তাঁরা বাকী জীবনটাও স্বামীর শিক্ষা ও কর্মের অনুশীলন এবং চারপাশে অতিবাহিত করবেন। তাঁরা মুসলমানদের মা। তাঁদের দায়িত্ব হবে সন্তানদের তা‘লীম ও তারবিয়্যাত (শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ) প্রদান করা। তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করেছেন এভাবে:
“হে নবী! তোমাদের পত্মীগণ অন্য নারীদের মত নন; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পর পুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলবে না। ফলে সেই ব্যক্তি কু-বাসনা করবে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে। তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে—প্রথম জাহিলী যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। যাকাত কায়েম করবে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং আপনাদেরকে পূর্ণরূপে পবিত্র রাখতে। আল্লাহর আঞ্জাত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে সঞ্চিত হয়, তোমরা সেগুলো স্মরণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়-জ্ঞ।”
হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) বাকী জীবন উক্ত আল্লাহর বাণীর বাস্তব ব্যাখ্যাস্বরূপ অতিবাহিত হলো। হযরত রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইন্তিকালের পর উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) সম্মানিত পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) খলিফা নির্বাচিত হলেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাফন-দাফন ও খলিফা নির্বাচনের ঝামেলা থেকে মুক্ত হওয়ার কয়েকদিন পর রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বেগমগণ চাইলেন হযরত উসমানকে (রাঃ) তাঁদের পক্ষ থেকে খলিফার নিকট পাঠাতে, উত্তরাধিকারের বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য। তখন হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর জীবদ্দশায় বলেছিলেন, “আমার কোন উত্তরাধিকারী থাকবে না। আমার পরিত্যক্ত সবকিছু সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে।” এ কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেলেন।
আসলে, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) বিষয়-সম্পত্তি এমন কিছুই ছিল না যা তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা যেত। হাদীসে এসেছে, তিনি দিরহাম ও দিনার, চতুষ্পদ জন্তু, দাস-দাসী—কিছুই মীরাস হিসেবে রেখে যাননি।
তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল হিসেবে কয়েকটি বাগ-বাগিচা তিনি নিজের অধীনে রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) জীবদ্দশায় যেসব খাতে আয় ব্যয় করতেন, খিলাফতে রাশেদাও তা একইভাবে বহাল রাখলেন। রাসূল (সাঃ) বেগমগণের ব্যয় নির্বাহ করতেন এই আয় থেকে, এবং আবু বকরও (রাঃ) তা বহাল রাখলেন।
পিতৃবিয়োগ
হযরত আবু বকর (রাঃ) মাত্র দুই বছর খিলাফত পরিচালনার সুযোগ পান। হিজরী তেরো সনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর যখন অন্তিম দশা, তখন মেয়ে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) পিতার শিয়রে বসে ছিলেন। এর আগে সুস্থ অবস্থায় তিনি মেয়েকে কিছু বিষয়-সম্পর্কিত ভোগ-দখলের জন্য দিয়েছিলেন। এখন অন্য সন্তানদেরও বিষয়-সম্পর্কিত প্রয়োজনের কথা মনে করে বললেনঃ
“আমার কলিজার টুকরা মেয়ে! তুমি কি ঐ বিষয়-সম্পত্তি তোমার অন্য ভাইদের দিয়ে দেবে?”
মেয়ে বললেনঃ “অবশ্যই দেব।”
পরবর্তীতে তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাফনে মোট কতখানা কাপড় ছিল?”
মেয়ে বললেনঃ “তিনখানা সাদা কাপড়।”
আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ “তিনি কোন দিনে ওফাত পান?”
মেয়ে বললেনঃ “সোমবার।”
পরবর্তীতে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আজ কি বার?”
মেয়ে বললেনঃ “সোমবার।”
বললেনঃ “তাহলে আজ রাতে আমাকেও যেতে হবে।”
পরবর্তীতে তিনি নিজের চাদরটি দেখালেন। তাতে জাফরানের দাগ ছিল। বললেনঃ
“এই কাপড়খানি ধুয়ে তার উপর আরো দুইখানি কাপড় দিয়ে আমাকে কাফন দিবে।”
মেয়ে বললেনঃ “এই কাপড় তো পুরানো।”
তিনি উত্তর দিলেনঃ “মৃতদের চেয়ে জীবিতদেরই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন বেশি।”
সেই দিন রাতেই তিনি ওফাত পান। হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) হুজরার মধ্যে, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পাশে, একটু পায়ের দিকে সরিয়ে তাঁকে দাফন করা হয়। হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) হুজরায় পতিত এটি হলো দ্বিতীয় চাঁদ। এত অল্প বয়সে স্বামী হারানোর মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তিনি পিতাকে হারালেন।
খিলাফতে ফারুকী
হযরত ফারুক আজমের (রাঃ) খিলাফতের কালটি ছিল সর্বদিক দিয়ে উৎকর্ষমণ্ডিত। তিনি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য নগদ ভাতা নির্ধারণ করতেন। একটি বর্ণনা মতে, তিনি আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের প্রত্যেকের জন্য বাৎসরিক বারো হাজার দিতেন। অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, অন্য আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের প্রত্যেককে দশ হাজার এবং হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) কে বারো হাজার দিতেন। এই প্রাধান্য প্রদানের কারণ উমার (রাঃ) নিজেই বলেছেন, “আমি তাঁকে দুই হাজার বেশি দিই, কারণ তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সর্বাধিক প্রিয় পাত্রী।”
আযওয়াজে মুতাহ্হারাতের সংখ্যা অনুযায়ী খলীফা উমার (রাঃ) নয়টি পিয়ালা তৈরি করান। যখন কোন জিনিস তাঁর হাতে আসত, নয়টি ভিন্ন-ভিন্ন পিয়ালা সকলের নিকট পাঠানো হতো। হাদিয়া ও তোহফা বণ্টনের সময় এতখানি খেয়াল রাখতেন যে, কোন জন্তু জবেহ হলে তার মাথা থেকে পায়া পর্যন্ত সকলের নিকট পাঠানো হতো।
ইরাক বিজয়ের এক পর্যায়ে মূল্যবান মোতি ভর্তি একটি কৌটা মুসলমানদের হাতে আসে। অন্যান্য মালের সঙ্গে সেটিও খলীফার দরবারে পাঠানো হয়। এই মোতির বণ্টন সকলের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। খলীফা উমার (রাঃ) বললেন, “আপনারা সকলে অনুমতি দিলে এই মোতিগুলি আমি উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) নিকট পাঠাতে পারি। কারণ তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সর্বাধিক প্রিয় পাত্রী।”
পাত্রটি হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) নিকট পাঠানো হলো। তিনি তা খুলে দেখে বললেনঃ
“রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পরে আল্লাহ আমাকে এত বড় অনুগ্রহ দেখিয়েছেন। হে আল্লাহ! আগামীতে তাঁর এমন সব অনুগ্রহ লাভের জন্য আমাকে জীবিত রাখো।”
খলীফা হযরত উমারের (রাঃ) বাসনা ছিল, হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) হুজরায় রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কদম মুবারকের পাশে দাফন হওয়া। কিন্তু একথা বলতে পারছিলেন না। তাঁর কারণ, যদিও মাটির নিচে চলে গেলে শরীয়তের দৃষ্টিতে পুরুষদের থেকে পর্দা করা জরুরি নয়, তবু আদব ও শিষ্টাচারের দৃষ্টিতে দাফনের পরেও তিনি হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) নিকট নিজেকে মাহরাম মনে করতেন।
একেবারে অন্তিম মুহূর্তে এসব চিন্তায় তিনি বড়ই পরেশান ছিলেন। শেষমেষ ছেলেকে পাঠালেন এই বলে, “উম্মুল মুমিনীনকে আমার সালাম পৌঁছে দেবে এবং বলবে, উমারের বাসনা হলো তাঁর দুই বন্ধুর পাশে দাফন হওয়া।”
হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) বললেনঃ “যদিও আমি ঐ স্থানটি নিজের জন্য রেখেছি, তবে আমি সন্তুষ্টচিত্তে তাঁকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি।”
উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) এই অনুমতি পাওয়ার পরেও, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে উমার (রাঃ) অসহায় হয়ে গেলেন। তাঁর লাশবাহী খাটিয়াটি দরজায় নিয়ে এসে আবার অনুমতি চাইলেন। যদি তিনি অনুমতি দান করেন, ভিতরে দাফন করা হবে, অন্যথায় সাধারণ মুসলমানদের গোরস্থানে। খলীফার ইনতিকালের পর তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা হয়। হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) দ্বিতীয়বার অনুমতি দান করেন এবং লাশ ভিতরে নিয়ে দাফন করা হয়।
এভাবে তিনি হলেন হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) স্বপ্নের তৃতীয় চাঁদ, যার মাধ্যমে তাঁর স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়।
বিদ্রোহীদের হাতে খলীফা হযরত উসমানের (রাঃ) শাহাদাত গ্রহণ ইসলামের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনা। এর প্রেক্ষিতে উম্মুল মুমিনীন হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) সরাসরি তৎকালীন রাজনীতিতে জড়িত হন। আর তাঁর প্রেক্ষাপটে ঘটে আর এক হৃদয়বিদারক ঘটনা—উটের যুদ্ধ। হযরত ‘উসমানের (রাঃ) শাহাদাত পরবর্তী ঘটনাবলীতে তাঁর এভাবে জড়িত থাকা কতটুকু ঠিক বা বেঠিক ছিল, তা নিয়ে আমরা কোন সিদ্ধান্তে যাব না। আমরা শুধু বিশ্বাস করবো, তাঁর সকল কর্ম-প্রচেষ্টা নিবিঘ্নভাবে দীন ও উম্মাহর কল্যাণের জন্য নিবেদিত ছিল। ঐতিহাসিক এ সকল ঘটনা বুঝতে বিস্তারিত বর্ণনার প্রয়োজন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।