হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৮ পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৭ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

ঈলা বা তাখঈর-এর ঘটনা

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হযরত আয়েশার (রাঃ) যুগের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা অনেক। তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুইটি হলো—তাহরীম এবং ঈলা বা তাখঈর-এর ঘটনা।
তাহরীম হলো মধ্যস্থ সংক্রান্ত সেই ঘটনা যা হযরত হাফসার (রাঃ) জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে। অপর ঘটনাটির প্রতি পূর্বে কোথাও ইঙ্গিত থাকলেও বিশদ আলোচনা হয়নি, তাই এখানে তা বর্ণনা করা হলো।

এটি হিজরী ৯ম সনের ঘটনা; মতান্তরে আহযাব ও বনু কুরাইজার সমসাময়িক কালের ঘটনা। তখন আরবের দূর-দূরান্তে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল। ইসলামের বাইতুল মালে প্রতিনিয়ত সম্পদ জমা হচ্ছিল।

তবু হযরত রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পরিবারের লোকেরা যে অভাব-অনটন ও মিতব্যয়িতার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করছিলেন, তার কিছু ইঙ্গিত পূর্বেই এসেছে। খাইবার বিজয়ের পর যে পরিমাণ শস্যদানা ও খেরামা খেজুর আযওয়াজে মুতাহ্হারাত-এর সারা বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা ছিল খুবই অপ্রতুল।

তাছাড়া তাঁদের প্রত্যেকের অতিথি সেবার অভ্যাস ও দান-খায়রাতের হাতের কারণে জীবনযাপন মান ছিল নিম্নস্তরের। তাদের প্রতিটি দিন কাটতো অনাহার বা অর্ধাহারে।

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সঙ্গে বিয়ের আগে তারা নিজের পিতৃপৃহে বা পূর্বের স্বামীর ঘরে অত্যন্ত সরল ও বিরাসী জীবন যাপন করতেন। এই কারণে, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) হাতে অর্থ-সম্পদের আধিক্য দেখে তারা একযোগে নিজেদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি জানান।

এ কথা হযরত উমার (রাঃ)-এর কানে গেলে, প্রথমে তিনি নিজের মেয়ে হাফসাকে (রাঃ) এভাবে বুঝালেন:
“তুমি তোমার জীবিকার পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছো। যা প্রয়োজন, তা আমার কাছ থেকেই চাইতে পার।”

এরপর হযরত উমার (রাঃ) এক এক করে উম্মাহাতুল মুমিনীন-এর প্রত্যেকের দরজায় গিয়ে তাঁদেরকে বুঝালেন। হযরত উম্মু সালামা বললেন:
“উমার! আপনি তো প্রতিটি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেই থাকেন; এখন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) স্ত্রীরা সম্পর্কেও হস্তক্ষেপ করা শুরু করলেন।”

একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) অপমানিত হয়ে চুপ হয়ে গেলেন।

একদিন হযরত আবু বকর ও হযরত উমার (রাঃ) দু’জন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট উপস্থিত হয়ে দেখলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে ঘিরে তাঁর স্ত্রীরা বসে আছেন এবং তাঁদের জীবিকার পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য চাপ দিচ্ছেন। উভয়ে নিজ নিজ মেয়ে—আয়েশা ও হাফসাকে—মারতে উদ্যত হলেন। তখন তাঁরা এই অঙ্গীকার করলেন যে, আগামীতে আর জীবিকা বৃদ্ধির দাবী জানিয়ে রাসূল (সাঃ)-কে কষ্ট দেবেন না।

অন্য স্ত্রীরা তাঁদের দাবীতে অটল থাকলেন। ঘটনাক্রমে, এই সময় রাসূল (সাঃ) ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান এবং পাঁজরে গাছের একটি মূলের সঙ্গে ধাক্কা লাগায় আহত হন।

হযরত আয়েশার (রাঃ) হুজরা সংলগ্ন আর একটি ঘর ছিল, যাকে ‘আল-মাশরাবা’ বলা হতো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানেই অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, আগামী এক মাস কোনো স্ত্রীর কাছে যাবেন না।

এই ঘটনাটি মুনাফিকরা প্রচার করে দেন যে, রাসূল (সাঃ) তাঁর সকল স্ত্রীর তালাক দিয়েছেন। একথা শুনে সাহাবা-ই-কিরাম মসজিদে সমবেত হন। ঘরে ঘরে অস্থিরতার ভাব বিরাজ করতে থাকে। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সহধর্মিণীরা কান্নাকাটি শুরু করেন। সাহাবীদের মধ্যে কেউই রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিকট থেকে ঘটনাটির সত্যতা যাচাই করার সাহস পাননি।

হযরত উমার (রাঃ) খবর পেয়ে মসজিদে নববীতে এসে দেখেন, সাহাবায়ে কিরাম বিমর্ষ অবস্থায় চুপচাপ বসে আছেন। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে দুইবার সাড়া পাননি। তৃতীয় বারের মাথায় অনুমতি পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখলেন, রাসূল (সাঃ) একটি চৌকির উপর শুয়ে আছেন এবং তাঁর পবিত্র দেহে মোটা কম্বলের ছাপ পড়ে গেছে।

উমার (রাঃ) ঘরের চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে দেখলেন, সেখানে কয়েকটি মাটির পাত্র এবং শুকনো মাশক ছাড়া আর কোনো জিনিস নেই। এই অবস্থা দেখে উমারের (রাঃ) চোখে অশ্রু নেমে আসে। তিনি বললেন:
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি আপনার স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন?”
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জবাব দিলেন: “না।”

উমার (রাঃ) বললেন: “আমি কি এ সুসংবাদ মুসলমানদের মধ্যে প্রচার করে দিই?”
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) অনুমতি পেয়ে উমার (রাঃ) গলা ফাটিয়ে ‘আল্লাহু আকবর!’ ধ্বনি দিয়ে ওঠেন।

এই মাসটি ছিল ২৯ দিনের। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন:
“আমি এক এক করে দিন গুনতাম। ২৯ দিন পূর্ণ হলে আমি ঘর থেকে বের হয়ে আসি।”

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম হযরত আয়েশার (রাঃ) ঘরে যান। তিনি আরজ করেন:
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি তো এক মাসের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আজ তো উনত্রিশ দিন হলো।”
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন:
“কোনো মাস ২৯ দিনেও হতে পারে।”

যেহেতু আযওয়াজে মুতাহ্হারাত জীবন-যাপনের মান বৃদ্ধির দাবীদার ছিলেন, অন্যদিকে নবী কারীম (সাঃ) সহধর্মিণীদের সন্তুষ্টির জন্য পার্থিব ভোগ-বিলাস দ্বারা নিজেকে কলুষিত করতে পারেন না, তাই আল্লাহ তা‘আলা ‘তাখঈর’-এর আয়া নাযিল করেন।
‘তাখঈর’ অর্থ—ইচ্ছা ও স্বাধীনতা দান করা। অর্থাৎ, স্ত্রীদের মধ্যে যিনি ইচ্ছা অনুযায়ী দরিদ্র্য ও অভাব-অনটন মেনে আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে সংসার পালন করতে চান, তিনি থাকতে পারেন; আর যিনি ইচ্ছা করেন, তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে দেওয়া হবে।

আয়াতটি নিম্নরূপঃ

আরবি:

“ইয়া নবী! তোমাদের স্ত্রীদের বলো—যদি তোমরা দুনিয়া ও তার চাকচিক্যই চাও, তবে এসো, আমি তোমাদের কিছু দিয়ে সুন্দরভাবে বিদায় করি। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং পরকালে অংশী হতেই চাও, তবে জানো, তোমাদের মধ্যে যারা নেককার, তাদের জন্য আল্লাহ বিরাট পুরস্কার নির্ধারিত রেখেছেন।”
(আল আহযাব: ২৯)

মুসলিম শরীফে উল্লেখিত হাদীসে হযরত জাবির ইবন আবদিল্লাহ (রাঃ) সেই সময়কার ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন যে, একদিন হযরত আবু বকর ও হযরত উমার (রাঃ) নবী কারীমের (সাঃ) খিদমতে হাজির হয়ে দেখলেন যে, হযরতদের পত্মীগণ তাঁর চারপাশে বসে আছেন, আর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চুপচাপ বসে আছেন।

তিনি হযরত উমারকে (রাঃ) লক্ষ্য করে বললেন:
“তোমরা দেখছো, এরা আমার চারপাশে বসে আছে; আসলে এরা আমার নিকট খরচের টাকা চাচ্ছে।”

এই কথা শুনে উভয় সাহাবী নিজ নিজ কন্যাকে শক্তভাবে শাসিয়ে বললেন এবং বললেন:
“তোমরা রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) কষ্ট দিচ্ছ এবং তাঁর নিকট এমন জিনিস চাচ্ছ যা তাঁর নিকট নেই।”

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে যে, উভয় সাহাবী তাঁদের মারতে উদ্যত হলেন, কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাঁদের থামালেন। এই ঘটনা থেকে নবী কারীম (সাঃ) যে কতদূর আর্থিক অনটনের মধ্যে ছিলেন, তা স্পষ্ট জানা যায়।

যখন এই আয়াত নাযিল হলো, নবী কারীম (সাঃ) সর্বপ্রথম হযরত আয়েশার (রাঃ) সাথে কথা বললেন:
“তোমাকে একটি কথা বলছি। খুব তাড়াতাড়ি করে জবাব দিও না; তোমার পিতা-মাতার মতামত জেনে নাও।”

এরপর নবী কারীম (সাঃ) হযরত আয়েশাকে (রাঃ) উল্লেখিত আয়াতটি পাঠ করে শোনালেন এবং বললেন যে, আল্লাহর নিকট থেকে এই হুকুম এসেছে।

সাথে সাথে হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন:
“এ বিষয়ে আমি কি আমার পিতা-মাতার নিকট জিজ্ঞেস করব? আমি তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং আখিরাতের সাফল্যই চাই।”

হযরত আয়েশার (রাঃ) এমন জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দারুণ খুশী হলেন। তিনি বললেন:
“যেভাবে আমি বিষয়টি তোমার নিকট উপস্থাপন করেছি, সেভাবে তোমার অন্য সতীনদের নিকটও করবো।”

হযরত আয়েশা (রাঃ) বললেন:
“অনুগ্রহ করে আপনি আমার সিদ্ধান্তের কথাটি অন্য কাউকে জানাবেন না।”

কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাঁর সে অনুরোধ রাখেননি। তিনি যেভাবে হযরত আয়েশাকে (রাঃ) বিষয়টি বলেছিলেন, ঠিক সেভাবে তাঁর সতীনদেরও বললেন। সাথে সাথে তিনি এ কথাটিও জানালেন যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ও আখিরাতকে গ্রহণ করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই হযরত আয়েশার (রাঃ) মত একই জবাব দেন।

সীরাতের গ্রন্থসমূহে এই ঘটনা ‘তাখঈর’ নামে অভিহিত হয়েছে।
‘তাখঈর’ অর্থ—ইচ্ছা ও স্বাধীনতা দান করা। অর্থাৎ, স্ত্রীকে সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা দেওয়া হয় যে, তিনি স্বামীর সঙ্গে থাকবেন নাকি তাঁর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।

সাইয়েদ আবুল আ‘লা মাওদূদী (রহঃ) ইবনুল ‘আরাবীর আহকামুল কুরআন-এর সূত্রে বলেছেনঃ
“‘তাখঈর’ এর আয়াত নাযিল হওয়ার সময় হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চারজন বেগম বর্তমান ছিলেন। তাঁরা হলেনঃ হযরত সাওদা (রাঃ), হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত হাফসা (রাঃ) ও হযরত উম্মু সালামা (রাঃ)।”

তবে আল্লামা ইবন কাসীর হযরত ইকরিমা (রাঃ)-এর সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, সেই সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মোট নয়জন বেগম ছিলেন।
পাঁচজন কুরাইশ খান্দানের—আয়িমা, হাফসা, উম্মু হাবীবা, সাওদা ও উম্মু সালামা (রাঃ), এবং অন্যরা হলেন—সাফিয়্যা, মাইমুনা, জুওয়াইরিয়া ও যয়নাব বিনত জাহাশ আল-আসাদিয়্যা (রাঃ)।

ঘটনার সময়কাল নিয়ে মতভেদের কারণে এই পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে।

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৯ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!