হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৫ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
উল্লেখ্য, মুনাফিকদের ছাড়াও মুষ্টিমেয় কিছু মুসলমান এই মিথ্যার অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে মিসতাহ ইবন উসাসা, ইসলামের প্রখ্যাত কবি হাসান ইবন সাবিত, এবং হযরত যয়নাব (রাঃ)-এর বোন হামনা বিনত জাহাশ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আয়িশা (রাঃ) বলেন—
“এই কাহিনী শুনে আমার রক্ত যেন পানি হয়ে গেল। যে উদ্দেশ্যে এসেছিলাম, সেই প্রয়োজনের কথাও ভুলে গেলাম। সোজা ঘরে ফিরে গেলাম এবং সারা রাত কেঁদে কাটালাম।”
এদিকে, আমার অনুপস্থিতিকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী ও উসামা ইবন যায়িদ (রাঃ)-কে ডাকলেন এবং তাদের নিকট এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন।
উসামা (রাঃ) আমার পক্ষে সত্যিই ভালো কথা বললেন। তিনি বললেন—
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার স্ত্রীর মধ্যে ভালো ছাড়া মন্দ কিছু কখনো দেখিনি। যা কিছু রটানো হচ্ছে, তা সবই মিথ্যা এবং কেবল রচিত অভিযেগ মাত্র।”
আলী (রাঃ) বললেন—
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের সমাজে মেয়েদের অভাব নেই। আপনি চাইলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। আর আসল বিষয় জানতে চাইলে দাসীকে ডেকে অবস্থা জেনে নিতে পারেন।”
দাসীকে ডাকা হলো এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। তিনি বললেন—
“আল্লাহর কসম, যিনি আপনাকে সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন, আমি তাঁর মধ্যে কোনো খারাপ কিছুই দেখিনি—যা নিয়ে আপত্তি করা যায়। দোষ শুধুমাত্র এতটুকু দেখেছি যে, আমি আটা মেখে রেখে যেতাম। আর তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন, এবং তৈরি আটা ছাগল এসে খেয়ে যেত।”
সেই দিন নবী করীম (সাঃ) তাঁর এক ভাষণে বললেন,
“হে মুসলমানগণ! তোমাদের মধ্যে কে আছে যে আমার স্ত্রীর ওপর মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে যে কষ্ট দিয়েছে, তাকে রক্ষা করতে পারে? আল্লাহর শপথ, আমি আমার স্ত্রীর কোনো দোষ দেখিনি, এবং না সেই লোকটির মধ্যে যার সম্পর্কে এই অভিযোগ তোলা হয়েছে। বাস্তবে, আমার অনুপস্থিতির সময় সে তো কখনই আমার ঘরে আসে নি।”
এই কথা শুনে হযরত উসাইদ ইবন হুদাইর (রাঃ) — কিছু বর্ণনায় বলে হযরত সা‘দ ইবন মু‘য়াজ (রাঃ) — দাঁড়িয়ে বললেন,
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! অভিযোগকারী যদি আমাদের বংশের লোক হয়ে থাকে, আমরা তাকে হত্যা করবো। আর যদি সে আমাদের ভাই খাযরাজ গোত্রের লোক হয়, তাহলে আপনি যা নির্দেশ দেবেন, তাই করবো।”
এ কথা শুনে খাযরাজ গোত্র-প্রধান সা‘দ ইবন উবাদা দাঁড়িয়ে এলেন এবং বললেন,
“তুমি মিথ্যা বলছো; তুমি তাকে কেবল সেই জন্য হত্যা করার কথা বলছো যে সে খাযরাজ গোত্রের লোক নয়। যদি সে তোমাদের লোক হত, তুমি কখনই তাকে হত্যা করার কথা বলবা না।”
জবাবে তাকে বলা হলো, “তুমি তো মুনাফিক; তাই মুনাফিকদের সমর্থন দিচ্ছ।”
এই বাক-বিতন্ডায় মসজিদে নববীতে একটা হট্ট্রাগোলের সৃষ্টি হয়। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা মসজিদেই লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু নবী কারীম (সাঃ) তাদেরকে ঠান্ডা করেন এবং পরে মিন্বরের উপর হতে নেমে আসেন।
অন্তত একমাত্র কাল এই মিথ্যা দোষারোপের বানোয়াট কথা সমাজে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। নবী করীম (সাঃ) কঠিন মানসিক কষ্টে থাকলেন। আমি কান্নাকাটি করতে লাগলাম। আমার পিতা-মাতা সীমাহীন দুশ্চিন্তায় ও উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছিলেন।
শেষ পর্যন্ত, নবী করীম (সাঃ) একদিন আসলেন এবং আমার পাশে বসলেন। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি একবারও আমার কাছে বসেননি। আবু বকর ও উম্মু রুমান (আমার পিতা-মাতা) মনে করলেন—আজ হয়তো কোনো সিদ্ধান্তমূলক কথা হবে। এই কারণে তাঁরাও নিকটে এসে বসলেন।
নবী করীম (সাঃ) বললেন—
“আয়িশা, তোমার সম্পর্কে এই সব কথা আমার কাছে পৌঁছেছে। তুমি যদি নিষ্পাপ হয়ে থাক, তাহলে আশা করি আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা প্রকাশ ও প্রমাণ করবেন। আর তুমি যদি বাস্তবিক কোনো প্রকার গুনাহে লিপ্ত হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর নিকট তাওবা কর এবং ক্ষমা চাও। বান্দা যখন গুনাহ স্বীকার করে ও তাওবা করে, তখন আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন।”
আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন—
“এই কথা শুনে আমার চোখের পানি শুকিয়ে গেল। আমি পিতাকে বললাম, ‘আপনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে এই কথা বলুন।’ তিনি বললেন, ‘মেয়ে! আমি কী বলব, তা বুঝতে পারছি না।’ আমি আমার মাকে বললাম, ‘আপনি কিছু বলুন।’ তিনি বললেন, ‘আমি কী বলব তা আমারও বোঝা যাচ্ছে না।’ তখন আমি বললাম, ‘আপনার কানে যে কথা এসেছে, তা মনের মধ্যে বাসা বেঁধে গেছে। এখন আমি যদি বলি — “আমি নির্দোষ, আল্লাহ সাক্ষী, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ” — তবু আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এমন কোনো কথা স্বীকার করি যা আমি করিনি — আল্লাহ জানেন যে আমি তা করিনি।’
তারপর আমি হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর কথা স্মরণ করতে চাইলে মনে পড়ল না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, এমন অবস্থায় আমি সেই কথা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না, যা হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর পিতা বলেছেন—
(আরবিতে হবে)
এই কথা বলে আমি পাশে ফিরে শুয়ে পড়লাম। আমি মনে মনে বললাম — “আল্লাহ আমার নির্দোষতা সম্পর্কে সর্বজন অবহিত আছেন; তিনি নিশ্চয়ই প্রকৃত ঘটনাটি মানুষের সামনে প্রকাশ করে দেবেন।” কিন্তু কখনই আমার মনে আসে নি যে, আমার পক্ষে এমন শারীরিক ও আল্লাহীয় ‘ওহী’ নাজিল হবে, যা কায়ণাত কালের জন্য পাঠ্য হবে। আমি কেবল ভেবে রেখেছিলাম — রাসূল (সাঃ) হয়তো কোনো স্বপ্ন দেখবেন, আর তাতে আল্লাহ আমার নির্দোষতা প্রকাশ করে দেবেন।
এই সময়েই নবী করীম (সাঃ)-এর উপর ওহী নাজিল হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। এমনকি তীব্র শীতেও তাঁর মুবারক চেহারায় ঘামের ফোটা টপটপ করে পড়তে লাগল। এমন অবস্থা দেখে আমরা সবাই স্থবির হয়ে গেলাম। আমি মনে একরকম সান্ত্বনা পেয়েছিলাম; কিন্তু আমার পিতা-মাতার অবস্থা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক—তারা আল্লাহর কোন মহাসত্য উদঘাটন করবেন, সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন ছিল।
ওহীকালীন অবস্থা শেষ হলে নবী করীম (সাঃ) খুবই উৎফুল্ল দেখালেন। তিনি হাসিমুখে প্রথম বললেন—
“আয়িশা, তোমাকে সুসংবাদ। আল্লাহ তোমার নির্দোষিতা ঘোষণা করে ওহী পাঠিয়েছেন।”
এরপর তিনি সূরা আন-নূর-এর ১১ নম্বর আয়াত থেকে ২১ নম্বর আয়াত পর্যন্ত পাঠ করে আমাদের শুনালেন। তখন আমার মা আমাকে বললেন—‘উঠো, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) শুকরিয়া আদায় কর।’ আমি বললাম—‘আমি উনার শুকরিয়া করব না, এবং তোমাদের দুজনেরও করব না; আমি তো আল্লাহর শুকরিয়া করবো, যিনি কুরআনের আয়াতে আমার নির্দোষতা ঘোষণা করেছেন। আপনারা তবু এই মিথ্যা অভিযোগকে পূর্ণভাবে অস্বীকার করেননি।’
হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল, কুরআনের ভাষায় তাকে ‘আল-ইফক’ বলা হয়েছে। এই শব্দ দ্বারা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে এই অভিযোগের পরিপূর্ণ প্রতিবাদ করা হয়েছে।
‘ইফক’ শব্দের অর্থ হলো—মূল কথাকে উল্টে দেওয়া, প্রকৃত সত্যের বিপরীতে যা ইচ্ছা করে বলা হয়। এই অর্থে এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও মনগড়া কথার জন্য ব্যবহৃত হয়। কোনো অভিযোগের ক্ষেত্রে শব্দটি প্রয়োগ হলে এর অর্থ দাঁড়ায়—সুস্পষ্ট মিথ্যা অভিযোগ, মিথ্যা দোষারোপ।
হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নির্দোষিতা ঘোষণা করে কুরআনের আয়াত নাজিল হওয়ার পর, মিথ্যা দোষারোপের জন্য দুইজন পুরুষ ও একজন নারীর উপর ‘হদ’ (নির্ধারিত শাস্তি) কার্যকর করা হয়। তাঁরা হলেন—
মিসতাহ ইবন উসাসা, কবি হাসান ইবন সাবিত, এবং হামনা বিনত জাহাশ (রাঃ)।
হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৭ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।