হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৫ পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৪ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

যুদ্ধ-বিগ্রহ

ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন—
আনাস (রাঃ) উহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গে বলেন,
“আমি আয়িশা (রাঃ) ও উম্মু সুলাইমকে (রাঃ) দেখেছি; তাঁরা কাঁধে মশক ভরে পানি এনে আহতদের মুখে ঢালছিলেন। পানি শেষ হয়ে গেলে আবার ভরে এনে ঢালতেন।”

উহুদ যুদ্ধের সময় আয়িশা (রাঃ)-এর বয়স ছিল মাত্র দশ-এগারো বছর। কিন্তু তবুও তিনি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাহসিকতার সঙ্গে আহত সাহাবিদের সেবা করেছেন।

ইমাম বুখারী বলেন,
বনু মুসতালিক যুদ্ধই হলো ‘আল-মুরাইসী’ যুদ্ধ।

এই যুদ্ধটি কোন হিজরিতে সংঘটিত হয়েছিল—তা নিয়ে সীরাতবিশারদদের মধ্যে সামান্য মতভেদ রয়েছে।

  • মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বলেন, এটি হয়েছিল হিজরির ষষ্ঠ সনে

  • মূসা ইবন উকবা বলেন, এটি হয়েছিল চতুর্থ হিজরিতে

  • আর উরওয়া বলেন, এটি হয়েছিল হিজরির পঞ্চম সনের শা‘বান মাসে

আল-মুরাইসী ছিল বনু মুসতালিক গোত্রের একটি ঝরনার নাম। তাদের নেতা ছিল আল-হারিস ইবন আবি দিরার। সে নিজের গোত্র এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য গোত্রের লোকদের রাসূলুল্লাহর (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সংগঠিত করে।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ সংবাদ পেয়ে তাঁদের দমন করার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে একটি বাহিনী নিয়ে রওনা হন। এই বাহিনীতে বিপুল সংখ্যক মুনাফিক (কপট মুসলমান) অংশগ্রহণ করে—যা অন্য কোনো যুদ্ধে ঘটেনি।

অবশেষে আল-মুরাইসী ঝরনার পাশে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়।
এই অভিযানের সময় মুনাফিকরা হযরত আয়িশা (রাঃ)-কে নিয়ে একটি ঘৃণ্য ও কুৎসিত ষড়যন্ত্র রচনা করে, যা ইতিহাসে ‘ঘটনাতুল ইফক’ নামে পরিচিত।

ঘটনাটি আমরা নিচে আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরছি।

ঘটনাতুল ইফকের সূচনা

হিজরির ৫ম অথবা ৬ষ্ঠ সনের শা‘বান মাসে নবী করিম (সাঃ) জানতে পারলেন যে, মুরাইসী‘ নামক ঝরনার পাশে বসবাসকারী লোকেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এ সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের দিকে যাত্রা করলেন। মুনাফিকদের নেতা ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই বিপুল সংখ্যক মুনাফিক সঙ্গী নিয়ে এই অভিযানে নবী করিমের (সাঃ) সঙ্গে অংশগ্রহণ করে।

ইবন সা‘দ (রহ.) বলেন,
“ইতিপূর্বে কোনো যুদ্ধেই এত সংখ্যক মুনাফিক অংশ নেয়নি।”

অভিযান শেষে এই মুনাফিকরা নানাভাবে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার রহমত, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) দূরদৃষ্টি এবং তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাইয়ের সব চক্রান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

এই সফরেই তারা উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রাঃ)-কে কেন্দ্র করে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র রচনা করে।
তারা আয়িশা (রাঃ)-এর পবিত্র চরিত্রের ওপর চরম অপমানজনক মিথ্যা দোষারোপ করে বসে।

মূল ঘটনাটি হযরত আয়িশা (রাঃ)-এর নিজের ভাষায় সহীহ বুখারীসহ বিভিন্ন হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
তিনি বলেন—

ঘটনাতুল ইফক: সূচনা ঘটনা

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) নিয়ম ছিল—যখন তিনি দূরবর্তী কোনো সফরে বের হতেন, তখন কুরআনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতেন, তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কে সেই সফরে তাঁর সঙ্গী হবেন।

বনু মুসতালিক যুদ্ধের সময় কুরআনের ফয়সালায় আমার (আয়িশা রাঃ) নামটি আসে, ফলে আমি তাঁর সফরসঙ্গী হই।

ফেরার পথে, যখন আমরা মদীনার কাছাকাছি পৌঁছালাম, রাতের বেলায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক স্থানে তাঁবু গেড়ে অবস্থান নিলেন। রাতের শেষ প্রহরে সেখান থেকে যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল।

আমি ঘুম থেকে জেগে স্বাভাবিক প্রয়োজন সারার জন্য বাইরে গেলাম। ফিরে আসার সময় অবস্থানস্থলের কাছাকাছি পৌঁছে অনুভব করলাম—আমার গলার হারটি কোথাও পড়ে গেছে। তখন আমি হারটি খুঁজতে ফিরে গেলাম।

এদিকে, আমি অনুপস্থিত থাকাকালীন কাফেলা রওনা হয়ে যায়। নিয়ম ছিল—যাত্রার সময় আমি আমার হাওদাজে (উটের পিঠের পালকি) বসে যেতাম, তারপর চারজন সাহাবি সেটি তুলে উটের পিঠে স্থাপন করতেন।

তখন দারিদ্র্য ও অভাবের কারণে আমরা মেয়েরা ছিলাম খুবই হালকা-পাতলা গড়নের। ফলে তাঁরা বুঝতেই পারেননি যে, আমি হাওদাজের ভেতরে নেই। অজ্ঞাতসারে তাঁরা হাওদাজটি উটের পিঠে বেঁধে কাফেলার সঙ্গে রওনা হয়ে গেলেন।

এদিকে আমি হারটি খুঁজে পেলাম, কিন্তু ফিরে এসে দেখলাম—সেখানে কেউ নেই। তাই আমি নিজের চাদর দিয়ে সারা শরীর ঢেকে সেখানেই বসে রইলাম। ভাবলাম—যখন তাঁরা বুঝবেন আমি অনুপস্থিত, তখন নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজতে ফিরে আসবেন।

এই অবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে সাফওয়ান ইবন মু‘আত্তাল আল-সুলামী সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারলেন—কারণ পর্দার নির্দেশ নাজিল হওয়ার আগে তিনি আমাকে একাধিকবার দেখেছিলেন।

আমাকে দেখে তিনি উট থামালেন এবং বিস্ময়ে উচ্চারণ করলেন—
“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন! রাসূলুল্লাহর (সাঃ) পত্নী এখানে রয়ে গেছেন!”

অপবাদ ঘটনার সূচনা

তাঁর কণ্ঠস্বর কানে যেতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম এবং চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। তিনি আমার সঙ্গে কোনো কথাই বললেন না। নিজের উটটি এনে আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন।

আমি উটের পিঠে উঠে বসলাম, আর তিনি লাগাম ধরে হেঁটে চলতে লাগলেন। প্রায় দুপুরের সময় আমরা কাফেলার সঙ্গে মিলিত হলাম—যখন তারা এক স্থানে থেমেছে।

আমি যে পিছনে রয়ে গিয়েছিলাম, সে কথা তাদের কেউ জানতেও পারেনি।

এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে মিথ্যা দোষারোপের এক বিশাল পাহাড় রচনা করা হলো। যারা এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, তাদের মধ্যে ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই’ ছিল সবচেয়ে সক্রিয় ও কূটবুদ্ধিসম্পন্ন।

কিন্তু আমার বিরুদ্ধে কী কী কথা রটানো হচ্ছে, আমি তার কিছুই জানতাম না।

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে—
যখন সাফওয়ানের উটের পিঠে সওয়ার হয়ে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) সৈনিকদের তাঁবুতে উপস্থিত হলেন এবং জানা গেল যে তিনি পিছনে পড়ে গিয়েছিলেন, তখন ‘আবদুল্লাহ ইবন উবাই’ চিৎকার করে বলে উঠলঃ

“আল্লাহর কসম! এই মহিলাটি নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। দেখো, দেখো! তোমাদের নবীর স্ত্রী অপর এক পুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়ে এখন প্রকাশ্যে তার সঙ্গে চলে এসেছে!”

 

মদীনায় ফিরে আসা ও অসুস্থতা

আয়িশা (রাঃ) বলেন—

“মদীনায় ফিরে আসার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রায় এক মাসকাল আমি শয্যাশায়ী হয়ে থাকলাম। শহরের সর্বত্র এই মিথ্যা দোষারোপের খবর ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নবী করিম (সাঃ)-এর কান পর্যন্ত পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হলো, কিন্তু আমি কিছুই জানতে পারিনি।

আমার মনে এক ধরনের খটকা অনুভূত হচ্ছিল। তা হলো—অসুস্থ অবস্থায় যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার প্রতি দয়া ও স্নেহ দেখাতেন, এবার সেই ধরনের আচরণ আমি দেখলাম না। তিনি ঘরে আসতেন এবং ঘরের লোকদেরকে শুধু জিজ্ঞেস করতেন—‘ও কেমন আছে?’ আমার সঙ্গে কোনো কথা বলতেন না। এতে আমার মনে সন্দেহ জন্মে—কিছু ঘটেছে হয়তো।

শেষ পর্যন্ত, তাঁর অনুমতি নিয়ে আমি আমার মায়ের নিকট চলে গেলাম, যাতে মা আমার সেবা ও শুশ্রূষা ভালোভাবে করতে পারেন।”

একদিন রাতের বেলা, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে ঘরের বাইরে গেলাম। তখনও আমাদের সব বাড়িতে পায়খানা নির্মিত হয়নি। আমরা প্রাকৃতিক প্রয়োজনের জন্য বন-জঙ্গলে যেতাম। আমার সঙ্গে মিসতাহ ইবন উসাসা ছিলেন, যিনি আমার পিতার খালাতো বোন।

পথে চলার সময় তিনি হোঁচট খান। তখন অকম্শাৎ তার মুখ থেকে উচ্চারিত হলো—
“ধ্বংস হোক মিসতাহ!”

আমি বললাম—
“আপনি কেমন মা? নিজের ছেলের ধ্বংস কামনা করেন! আর ছেলেও এমন, যে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।”

তিনি উত্তর দিলেন—
“মেয়ে! তুমি কি কোনো খবরই রাখো না?”

এরপর তিনি আমাকে সকল কাহিনী জানালেন। যে মিথ্যা অপবাদ আমার সম্পর্কে রটানো হয়েছিল, তা সবই আমাকে বিস্তারিত শোনালেন।

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১৬ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!