হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১১ পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১০ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ‘আয়িশা (রাঃ) সাথে যখন পানাহারের সুযোগ হতো, তখন তারা একই দস্তরখানে এক থালায় আহার করতেন। একবার পর্দার হুকুমের আগে তাঁরা একসাথে খাচ্ছিলেন, এমন সময় ‘উমার (রাঃ) এসে উপস্থিত হলেন। রাসূল (সাঃ) তাঁকে খেতে ডাকলেন এবং তিনজন একসাথে খাইলেন। পানাহারের মধ্যে প্রেম-প্রীতির অবস্থা এমন ছিল যে, ‘আয়িশার (রাঃ) যেখানে মুখ লাগাতেন, রাসূল (সাঃ) ঠিক সেখানেই মুখ ঘোরিয়ে খেতেন। রাতে যেহেতু ঘরে বাতি জ্বালানো হতো না, তাই অন্ধকারে বসে মাঝে মাঝে উভয়ের হাত একই টুকরোর উপর গিয়ে পড়তো।

সীরাত ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ও ‘আয়িশার (রাঃ) প্রেম-প্রীতি ও মান-অভিমানের এক চমৎকার দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক, নির্মল আবেগ-অনুভূতিকে অস্বীকার করেনি; এ বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁদের আচরণের মধ্যেই। কখনো কখনো তাঁদেরকে দেখা যায় সাধারণ মানুষের মতো আবেগপ্রবণ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ‘আয়িশা (রাঃ) যেমন একজন নবীর স্ত্রী, তেমনি একজন নারীও বটে। আবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেমন একজন নবী ও রাসূল, তেমনি একজন স্বামীও বটে। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাঁদের এমন বহু আচরণ ও মান-অভিমানের ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, যা অত্যন্ত চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয়।

রাসূলে কারীম (সাঃ) তাঁর পরলোকগত প্রথমা স্ত্রী খাদীজা (রাঃ)-কে প্রায়ই স্মরণ করতেন। একবার তিনি খাদীজার (রাঃ) কথা আলোচনা করছিলেন। তখন ‘আয়িশা (রাঃ) বলে উঠলেন,
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এই বৃদ্ধার কথা এত স্মরণ করেন কেন? আল্লাহ তো আপনাকে তাঁর চেয়ে ভালো স্ত্রী দান করেছেন।”
রাসূল (সাঃ) বললেন,
“আল্লাহ আমাকে তাঁর থেকেই সন্তান দান করেছেন।”

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে— একদিন রাসূল (সাঃ) খাদীজার (রাঃ) প্রশংসা করতে শুরু করলেন এবং দীর্ঘক্ষণ তাঁর প্রশংসা করলেন। ‘আয়িশা (রাঃ) বলেন, এতে আমার অন্তর্দাহ হলো। আমি বললাম,
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি একজন কুরাইশী বৃদ্ধা, যার ঠোঁট ছিল লাল, যার মৃত্যুর পর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে — তাঁকে এত প্রশংসা করছেন! অথচ আল্লাহ তো তাঁর চেয়ে ভালো স্ত্রী আপনাকে দিয়েছেন।”
এই কথা শুনে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) চেহারার রং পাল্টে গেল। তিনি বললেন,
“খাদীজা আমার এমন স্ত্রী ছিলেন, যখন মানুষ আমাকে নবী বলে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছিল, তখন সে আমার প্রতি ঈমান এনেছিল। মানুষ যখন আমাকে সাহায্য করতে চায়নি, তখন সে নিজের অর্থ-বিত্ত দিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর আল্লাহ তার মাধ্যমেই আমাকে সন্তান দান করেছেন — যখন অন্য স্ত্রীরা আমাকে সন্তান দিতে পারেনি।”

একবার ‘আয়িশার (রাঃ) মাথায় ব্যথা হলো। তখন রাসূলুল্লাহর (সাঃ) শরীরে ইতোমধ্যেই অন্তিম রোগলক্ষণ শুরু হয়েছিল। তিনি ‘আয়িশা (রাঃ)-কে বললেন,
“তুমি যদি আমার আগে মারা যেতে, আমি নিজ হাতে তোমাকে গোসল দিতাম, কাফন পরাতাম এবং তোমার জন্য দো‘আ করতাম।”
‘আয়িশা (রাঃ) বললেন,
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি আমার মৃত্যুকামনা করছেন? যদি এমন হয়, তাহলে তো আপনি এই ঘরেই অন্য একজন স্ত্রীকে এনে তুলবেন!”
এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মৃদু হেসে দিলেন।

‘ইফক’ বা চরিত্রে কলঙ্ক আরোপের ঘটনার পর, যখন ওহী দ্বারা হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর পবিত্রতা ঘোষণা করা হলো, তখন তাঁর মা বললেন,
“যাও, স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”

‘আয়িশা (রাঃ) তৎক্ষণাৎ অভিমানী সুরে জবাব দিলেন,
“আমি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া — যিনি আমার পবিত্রতা ঘোষণা করেছেন — কারো প্রতি কৃতজ্ঞ নই।”

একবার রাসূল (সাঃ) বললেন,
“আয়িশা! তুমি আমার প্রতি কখন খুশী বা অখুশী থাকো, আমি তা বুঝতে পারি।”

‘আয়িশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন,
“কিভাবে, ইয়া রাসূলাল্লাহ?”

রাসূল (সাঃ) উত্তর দিলেন,
“যদি তুমি অখুশী থাকো, তাহলে বলো ‘ইবরাহীমের আল্লাহর কসম’। আর যদি খুশী থাকো, বলো ‘মুহাম্মাদের আল্লাহর কসম’। এতে আমি তা বুঝতে পারি।”

স্বামীর সেবা

হাদীসের গ্রন্থাবলীর বিভিন্ন স্থানে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর স্বামী-সেবার কথা ছড়িয়ে আছে। এখানে আমরা তার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি।

ঘরে খাদেম থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে সব কাজ করতেন। নিজ হাতে আটা পিষতেন, খাবার তৈরি করতেন, বিছানা পারতেন, ওযুর পানি সরবরাহ করতেন, স্বামীর কুরবানীর পশুর গলার রশি পাকাতেন, স্বামীর মাথায় চিরুনী করে দিতেন, দেহে আতর লাগাতেন, কাপড় ধুতেন, রাতে শোয়ার সময় মিসওয়াক ও পানি মাথার কাছে এনে রাখতেন, এবং মিসওয়াক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতেন।

একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে মসজিদে যান। একজন সাহাবী বললেন,
“ইয়া রাসূলাল্লাহ! কম্বলে তো কিছু ময়লার দাগ দেখা যাচ্ছে।”

সাথে সাথে তিনি কম্বলটি খুলে একজন খাদেমের হাতে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ)-এর নিকট পাঠিয়ে দেন। ‘আয়িশা (রাঃ) পানি নিয়ে নিজ হাতে কম্বলটি ধুয়ে শুকিয়ে আবার রাসূলুল্লাহর (সাঃ) কাছে পাঠিয়ে দেন।

কায়স আল-গিফারী (রাঃ), যিনি আসহাবে সুফফার অন্যতম সদস্য ছিলেন, বর্ণনা করেছেন—
একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,
“তোমরা সবাই আজ ‘আয়িশার ঘরে চলো।”

ঘরে গিয়ে তিনি বললেন,
“আয়িশা! আমাদের সকলকে আহার করাও।”

‘আয়িশা (রাঃ) আমাদের সকলকে পাকানো খাবার খাওয়ালেন এবং দুধ ও পানি পরিবেশন করালেন। সম্ভবত এটি হিজাবের হুকম নাযিল হওয়ার পূর্বের ঘটনা।

হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) স্বামীর প্রিয়তমা স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও অতি আগ্রহ ও নিষ্ঠা ভরে অন্যদের চেয়ে বেশি মাত্রায় স্বামীর সেবা করতেন। স্বামীর আরাম-আয়েশ ও ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি সর্বদা সতর্ক থাকতেন। বারবার স্বামীর মিসওয়াক ধোয়ার প্রয়োজন পড়লেও তিনি তা নিজের দায়িত্ব মনে করে সুচারুভাবে পালন করতেন।

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ১২ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!