হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৫ পর্ব

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৪ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

শিক্ষা-দীক্ষা

প্রাচীন আরবে, যেখানে পুরুষদেরই লেখা-পড়ার কোনো প্রচলন ছিল না, সেখানে মেয়েদের তো কোনো প্রশ্নই আসেনি। ইসলামের সূচনাকালে মক্কার গোটা কুরাইশ খান্দানে মাত্র ১৭ (সতেরো) ব্যক্তি লিখতে-পড়তে জানতেন। তাদের মধ্যে একজন মাত্র মহিলা ছিলেন—শিফা বিনতে ‘আবদিল্লাহ। ইসলামে পড়া-লেখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ায় খুব দ্রুত এর প্রসার ঘটে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহধর্মিণীগণের মধ্যে হাফসা (রাঃ) ও উম্মু সালামা (রাঃ) কিছুটা লেখাপড়া জানতেন। হযরত হাফসা (রাঃ) খোদ রাসূলুল্লাহর নির্দেশে শিফা বিনতে ‘আবদিল্লাহ (রাঃ)-এর নিকট লিখতে ও পড়তে শিখেন। সেই সময় আরও কিছু মহিলা সাহাবীও লেখাপড়া শিখেছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একাধিক স্ত্রী গ্রহণ, বিশেষত হযরত ‘আয়িশাকে (রাঃ) অপরিণত বয়সে গ্রহণের মধ্যে বহুবিধ কল্যাণ নিহিত ছিল। রাসূলুল্লাহর সাহচর্যের বরকত অগণিত পুরুষকে সৌভাগ্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিচ্ছিল, তবু স্বাভাবিক কারণে সাধারণ মহিলারা এ সৌভাগ্য লাভে সক্ষম ছিলেন না। রাসূলুল্লাহর সহধর্মিণীদের মাধ্যমে তার সাহচর্যের ফয়েজ ও বরকতের রহস্য গোটা বিশ্বের নারী জাতির মধ্যে প্রচারিত ও প্রসারিত হওয়া সম্ভব হয়েছিল।

একমাত্র হযরত ‘আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) ছাড়া অন্য সকল আযওয়াজে মুতাহ্‌হারা বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পরই রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ দিক দিয়ে হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) একমাত্র নবুওয়াতের ফয়েজ ও বরকত লাভে ধন্য হন।

শৈশব ও কৈশ্যের বয়স হলো মানুষের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের প্রকৃত সময়। সৌভাগ্যবশত এই বয়সের পুরোটা সময় হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) নবীর প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন, যাতে তিনি বিশ্বের মানবজাতির অর্ধেক অংশের জন্য আলোরবর্তিকা হয়ে উঠতে পারেন।

গোটা কুরাইশ খান্দানের মধ্যে কাব্যশাস্ত্র ও কৌশলবিদ্যায় আবু বকর (রাঃ) ছিলেন সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তি। হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) এমন পিতার তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন। ফলে বংশগতভাবে তাঁর মধ্যে এই দুই শাস্ত্রের প্রতি প্রীতি ও পারদর্শিতা সৃষ্টি হয়।

হযরত আবু বকর (রাঃ) নিজের সন্তানদের সুশিক্ষা ও আদব-আখলাক শিখানোর প্রতি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। ক্ষেত্রবিশেষে তিনি কঠোরতাও প্রয়োগ করতেন। হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে এর প্রমাণও পাওয়া যায়। একবার তিনি ছেলে ‘আবদুর রহমানকে মারতে উদ্যত হন শুধু এই কারণে যে, সে মেহমানদের খাবার দিতে দেরী করেছিলেন।

বিয়ের পরও হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) নিজের কোনো ভুল বা কৃত্রিম ত্রুটির জন্য পিতার থেকে কঠোর শিক্ষালাভ করতেন। অনেক ক্ষেত্রে পিতা তাঁকে ভীষণভাবে বকাঝকা করতেন এবং মাঝে মধ্যে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করতেন না। একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বাঁচিয়ে দেন। আর একবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিতিতে হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) পাঁজরে জোরে থাপ্পড় মারা হয়। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে উঠেনঃ

“আবু বকর! আল্লাহ আপনাকে মাফ করুন। আমরা এমনটি চাইনি।”

হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভের প্রকৃত সূচনা হয় স্বামীর ঘরে যাওয়ার পর। এ সময়ে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন এবং দেখে-দেখে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি লিখতে জানতেন না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কুরআন লেখালেখির কাজ হযরত ‘আয়িশার (রাঃ) জন্য তাঁর দাস জাকওয়ান করতেন। তবে কিছু বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে, কোনো চিঠির জবাবে তিনি নিজে লিখেছেন।

সম্ভবত বর্ণনাকারীরা ‘লিখেছেন’ কথাটির স্থলে ‘লেখেন’ বলে দিয়েছেন। সাধারণত এমনই হয়ে থাকে। যাহোক, লেখা ও পড়া মানুষের জ্ঞানের বাহ্যিক মাপকাঠি মাত্র। প্রকৃত জ্ঞানের মাপকাঠি তার থেকে অনেক উঁচু স্তরে।

মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতার পূর্ণতা ও পবিত্রতা অর্জন, দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয় ও শরীয়াতের গূঢ় রহস্য জানা, এবং আল্লাহর কালাম ও আহকামের নববীর জ্ঞান লাভই হচ্ছে সর্বোত্তম শিক্ষা। হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) ছিলেন এই সকল জ্ঞানের ভান্ডার। তাছাড়া, ইতিহাস, সাহিত্য ও চিকিৎসা বিদ্যায়ও ছিল তাঁর গভীর জ্ঞান।

ইতিহাস ও সাহিত্যের জ্ঞান তিনি অর্জন করেছেন পিতার নিকট থেকে। চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চল ও স্থান থেকে আসা লোকজন ও প্রতিনিধিদের নিকট থেকে, যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে আসতেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের শেষ দিনগুলোতে অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকতেন। আরবের চিকিৎসকরা যেখানে যা ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দিতেন, হযরত ‘আয়িশা (রাঃ) তা স্মৃতিতে ধরে রাখতেন।

একদিন উরওয়া আয়িশাকে (রাঃ) বললেনঃ

“আমি আপনার ফিকহ, কাব্য ও প্রাচীন আরবের ইতিহাসের জ্ঞান দেখে বিস্মিত হয়েছি। কারণ এই জ্ঞান অর্জন আপনার জন্য সম্ভব। কিন্তু আপনার ‘তিব্ব’ বা চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান দেখে বিস্মিত না হয়ে পারি না। এই জ্ঞান আপনি কিভাবে ও কোথা থেকে অর্জন করেছেন?”

আয়িশা (রাঃ) জবাব দিলেনঃ

“উরওয়া! রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর শেষ জীবনে অসুস্থ থাকতেন। আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন তাঁর কাছে আসত। তারা নানা রকম ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ নিয়ে আসত। আর আমি সেইভাবে চিকিৎসা করতাম। সেখান থেকেই এই জ্ঞান অর্জন করেছি।”

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, উরওয়া প্রশ্ন করেনঃ

“এই তিব্ব বা চিকিৎসা বিদ্যার জ্ঞান আপনি কোথা থেকে অর্জন করেছেন?”

আয়িশা (রাঃ) জবাব দিলেনঃ

“যদি আমি বা অন্য কোনো লোক অসুস্থ হই, যে ওষুধ ও ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়, সেখান থেকেই শিখেছি। তাছাড়া একজন আরেকজনকে যে রোগ ও ওষুধের কথা বলে আমি তা সব মনে রাখি।”

দীনী জ্ঞান অর্জনের কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না। শরী‘য়াতের মহান শিক্ষক ঘরেই ছিলেন। রাত-দিন তাঁর সাহচর্য লাভে ধন্য হতেন। প্রতিদিন মসজিদে নববীতে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা‘লীম ও ইরশাদ অনুষ্ঠিত হতো। মসজিদের গাঁ ঘেঁষেই হযরত আয়িশার (রাঃ) হুজরা। এ কারণে রাসূল (সাঃ) বাইরে লোকদের যে শিক্ষা দিতেন, আয়িশা (রাঃ) ঘরে বসেই তাতে শরিক হতেন। কখনো কোনো কথা দূরত্ব বা অন্য কোনো কারণে বুঝতে না পারলে রাসূল (সাঃ) ঘরে এলে জিজ্ঞেস করে তা বুঝতেন। কখনো কখনো তিনি মসজিদের কাছাকাছি চলে যেতেন। তাছাড়া, রাসূল (সাঃ) মহিলাদের আবেদনের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট করে শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন।

দিবা-রাত্রে ইলম ও হিকমাত বা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অসংখ্য বিষয়ের আলোচনা তাঁর কানে আসতো। তাঁর অভ্যাস ছিল প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীন চিত্তে রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সামনে উপস্থাপন করা। তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তিনি শান্ত হতেন না। একবার রাসূল (সাঃ) বললেনঃ

“কিয়ামতের দিন যার হিসাব নেওয়া হবে, সে শাস্তি ভোগ করবে।”

আয়িশা (রাঃ) বললেনঃ

“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ তো বলেছেন—
‘তার থেকে সহজ হিসাব নেওয়া হবে।’”

রাসূল (সাঃ) বললেনঃ

“এ হলো আমলের উপস্থাপন। কিন্তু যার আমলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে, তার ধ্বংস অনিবার্য।”

হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রাঃ) -এর ৬ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!