সাহারা মরূদ্যান-সন্নিহিত ক্যাম্প
আফ্রিকা
ঘুম ভাঙল। ঘুমের ঘোর তবু ভাঙল না। … নিশি আমার ভোর হলে, সে স্বপ্নও ভাঙল, আর তার সঙ্গে ভাঙল আমার বুক! কিন্তু এই যে তার শাশ্বত চিরন্তন স্মৃতি, তার আর ইতি নেই। না – না, মরুর বুকে ক্ষীণ একটু ঝরনা-ধারার মতো এই অম্লান স্মৃতিটুকুই তো রেখেছে আমার শূন্য বক্ষ স্নিগ্ধ-সান্ত্বনায় ভরে। বয়ে যাও ওগো আমার ঊষর মরুর ঝরনা-ধারা, বয়ে যাও এমনি করে বিশাল সে এক তপ্ত শূন্যতায় তোমার দীঘল রেখার শ্যামলতার স্নিগ্ধ ছায়া রেখে। দুর্বল তোমার এই পূত ধারাটিই বাঁচিয়ে রেখেছে বিরাট কোনো এক মরুভূ-প্রান্তরকে, তা তুমি নিজেও জান না, – তবু বয়ে যাও ওগো ক্ষীণতোয়া নির্ঝরিণীর নির্মল ধারা, বয়ে যাও।
নিশি-ভোরটা নাকি বিশ্ববাসী সবার কাছেই মধুর, তাই এ-সময়কার টোড়ি রাগিণীর কল-উচ্ছ্বাসে জাগ্রত নিখিল অখিলের পবিত্র আনন্দ-সরসী-সলিলে ক্রীড়ারত মরালযূথের মতো যেন সঞ্চরণ করে বেড়ায়, কিন্তু আমার নিশি ভোর না হলেই ছিল ভালো। এ আলো আমি আর সইতে পারছি নে, – এ যে আমার চোখ ঝলসিয়ে দিলে! এ কী অকল্যাণময় প্রভাত আমার!
ভোর হল। বনে বনে বিহগের ব্যাকুল কূজন বনান্তরে গিয়ে তার প্রতিধ্বনির রেশ রেখে এল! সবুজ শাখীর শাখায় শাখায় পাতার কোলে ফুল ফুটল। মলয় এল বুলবুলির সাথে শিস দিতে দিতে। ভ্রমর এল পরিমল আর পরাগ মেখে শ্যামার গজল গানের সাথে হাওয়ার দাদরা তালের তালে তালে নাচতে নাচতে। কোয়েল, দোয়েল, পাপিয়া সব মিলে সমস্বরে গান ধরলে, –
ওহে সুন্দর মরি মরি!
তোমায় কী দিয়ে বরণ করি!
অচিন কার কণ্ঠ-ভরা ভৈরবীর মিড় মোচড় খেয়ে উঠল – ‘জাগো পুরবাসী।’ সুষুপ্ত বিশ্ব গা মোড়া দিয়ে তারই জাগরণের সাড়া দিলে!
তুমি সুন্দর, তাই নিখিল বিশ্ব সুন্দর শোভাময়।
পড়ে রইলুম কেবল আমি উদাস আনমনে, আমার এই অবসাদ-ভরা বিষণ্ণ দেহ ধরার বুকে নিতান্ত সংকুচিত গোপন করে, হাস্যমুখরা তরল উষার গালের একটেরে এককণা অশুষ্ক অশ্রুর মতো! অথচ এই যে এক বিন্দু অশ্রুর খবর, তা উষা-বালা নিজেই জানে না, গত নিশি খোওয়াবের খামখেয়ালিতে কখন সে কার বিচ্ছেদ-ব্যথা কল্পনা করে কেঁদেছে, আর তারই এক রতি স্মৃতি তার পাণ্ডুর কপোলে পূত ম্লানিমার ঈষৎ আঁচড় কেটে রেখেছে।
ঘুমের ঘোর টুটলেই শোর ওঠে, –ওই গো ভোর হল! জোর বাতাসে সেই কথাই নিভৃত-সব কিছুর কানে কানে গুঞ্জরিত হয়। সবাই জাগে – ওঠে – কাজে লাগে। আমার কিন্তু ঘুমের ঘোর টুটেও উঠতে ইচ্ছে করছে না। এখনও আপশোশের আঁসু আমার বইছে আর বইছে। সব দোরই খুলল, কিন্তু এ উপুড়-করা গোরের দোর খুলবে কী করে? – না, তা খোলাও অন্যায়, কারণ এ গোরের বুকে আছে শুধু গোরভরা কঙ্কাল আর বুকভরা বেদনা, যা শুধু গোরের বুকেই থেকেছে আর থাকবে! – দাও ভাই, তাকে পড়ে থাকতে দাও এমনি নীরবে মাটি কামড়ে, আর ওই পথ বেয়ে যেতে যেতে যদি ব্যথা পাও, তবে শুধু একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলো, আর কিচ্ছু না!
* * *
আচ্ছা, আমি এই যে আমার কথাগুলো লিখে রাখছি সবাইকে লুকিয়ে, এ কি আমার ভালো হচ্ছে? নাঃ, তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি নে, – এ ভালো, না মন্দ। হাঁ, আর এই যে আমার লেখার উপর কুয়াশার মতো তরল একটা আবরণ রেখে যাচ্ছি, এটাও ইচ্ছায়, না অনিচ্ছায়? তাই বলছি, এখন যেমন আমি অনেকেরই কাছে আশ্চর্য একটা প্রহেলিকা, আমি চাই চিরটা দিনই এমনি করে নিজেকে লুকিয়ে থাকতে – আমার সত্যিকারের ব্যথার উৎসে পাথর চাপা দিয়ে আর তারই চারি পাশে আবছায়ার জাল বুনে ছাপিয়ে থাকতে, বুকের বেদনা আমার গানের মুখর কলতানে ডুবিয়ে দিতে। –কেননা, যখন লোকে ভাববে আর হাসবে, যে, ছি! – সৈনিকেরও এমন একটা দুর্বলতা থাকতে পারে ! না না – এখন থেকে আমার বুক সে চিন্তাটার লজ্জায় ভরে উঠছে! – আমার এই ছোটো কথা ক-টি যদি এমনই এক করুণ আবছায়ার অন্তরালেই রেখে যাই, তাহলে হয়তো কারুর তা বুঝবার মাথা-ব্যথা হবে না। আর কোনো অকেজো লোক তা বুঝবার চেষ্টা করলেও আমায় তেমন দূষতে পারবে না। দূর ছাই, যতসব সৃষ্টিছাড়া চিন্তা। কারই বা গরজ পড়েছে আমার এ লেখা দেখবার? তবু যে লিখছি? মানুষ মাত্রেই চায় তার বেদনায় সহানুভূতি, তা নইলে তার জীবনভরা ব্যথার ভার নেহাৎ অসহ্য হয়ে পড়ে যে। দরদি বন্ধুর কাছে তার দুখের কথা কয়ে আর তার একটু সজল সহানুভূতি আকর্ষণ করে যেন তার ভারাক্রান্ত হৃদয় অনেকটা লঘু হয়। তাছাড়া, যতই চেষ্টা করুক, আগ্নেয়গিরি তার বুক-ভরা আগুনের তরঙ্গ যখন নিতান্ত সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে ওঠে, তখন কী অত বড়ো শক্ত পাথরের পাহাড়ও তা চাপা দিয়ে আটকে রাখতে পারে? কখনই না। বরং সেটা আটকাতে যাবার প্রাণপণ আয়াসের দরুন পাহাড়ের বুকের পাষাণ-শিলাকে চুর-মার করে উড়িয়ে দিয়ে আগুনের যে হলকা ছোটে, সে দুর্নিবার স্রোতকে থামায় কে?… হাঁ, তবু ভাববার বিষয় যে, সে দুর্মদ দুর্বার বাষ্পোচ্ছ্বাসটা আগ্নেয়গিরির বুক থেকে নির্গম হয়ে যাবার পরই সে কেমন নিস্পন্দ শান্ত হয়ে পড়ে। তখন তাকে দেখলে বোধ হয়, মৌন এই পাষাণ-স্তূপের যেন বিশ্বের কারুর কাছে কারুর বিরুদ্ধে কিছু বলবার কইবার নেই। শুধু এক পাহাড় ধীর প্রশান্ত-নির্বিকার শান্তি! আঃ – সেই বেশ!
আচ্ছা, বাইরে আমি এতটা নিষ্করুণ নির্মম হলেও আমার যে এই মরু-ময়দানের শুকনো বালির নীচে ফল্গুধারার মতো অন্তরের বেদনা, তার জন্যে করুণায় একটি আঁখিও কি সিক্ত হয় না? এতই অভিশপ্ত বিড়ম্বিত জীবন আমার! হয়তো থাকতেও পারে। তবু চাই নে যে? – না ভাই, না, প্রত্যাখ্যান আর বিদ্রুপের ভয় ও বেদনা যে বড়ো নিদারুণ! তাই আমার অন্তরের ব্যথাকে আর লজ্জাতুর করতে চাই নে – চাই নে। হয়তো তাতে সে কোন্ এক পবিত্র স্মৃতির অবমাননা করা হবে। সে তো আমি সইতে পারব না। – অথচ একটু সান্ত্বনা যেন এ নিরাশ নীরস জীবনে খুবই কামনার জিনিস হয়ে পড়েছে। এখন আমার সান্ত্বনা হচ্ছে এই লিখেই – এমনি করে আমার এই গোপন খাতাটির সাদা বুকে তারই – সেই বেদনাতুর মূর্তিটিরই প্রতিচ্ছবি আবছায়ায় এঁকে। আমার সাদা খাতার এই কালো কথাগুলি আর গানের স্নিগ্ধ-কল্লোল এই দুটি জিনিসই আমার আগুন-ভরা জীবনে সান্ত্বনা-ক্ষীর ঢেলে দিচ্ছে আর দেবে!…
আমার আজ দুনিয়ার কারুর উপর অভিমান নেই! আমার সমস্ত মান-অভিমান এখন তোমারই উপর খোদা! তুমিই তো আমায় এমন করে রিক্ত করেছ, তুমিই যে আমার সমস্ত স্নেহের আশ্রয়কে ঝড়ো-হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সারা বিশ্বকে আমার ঘর করে তুলছ, – এখন পর হলে চলবে না – এড়িয়ে যেতেও পারবে না। এখন তুমি না সইলে এ দুরন্তের আবদার অত্যাচার কে সইবে বল? ওগো আমার দুর্জ্ঞেয় মঙ্গলময় প্রভু, এখন তুমিই আমার সব! –
* * *
হাঁ, এখনই লিখে থুই, নইলে কে জানে কোন্ দিন দুশমনের শেলের একটা তীব্র আঘাত ক্ষণিকের জন্যে বুকে অনুভব করে চিরদিনের মতো নিথর-নিঝুম হয়ে পড়ব! এই মহাসমরসাগরে ছোট্ট এক বুদ্বুদের মতোই মাথা তুলে উঠেছি, আবার হয়তো এক পলকেই আমার ক্ষুদ্র বুকের সমস্ত আশা-উৎসাহ ব্যথা-বেদনা থেমে গিয়ে ওই বুদ্বুদটির মতোই কোথায় মিলিয়ে যাব। কেউ আহা বলবে না – কেউ উহুঁ করবে না! আমার কাছে সেই মৃত্যুর চিন্তাটা কেমন একরকম প্রশান্ত মধুর!
আর একটা কথা, – আমাকে কিন্তু বাইরে এখনকার মতোই এমনই রণদুর্মদ, কর্তব্যের সময় এমনই মায়া-মমতাহীন ক্রূর সেনানী, যুদ্ধে সমুদ্রের উচ্ছ্বাসের চেয়েও দুর্বিনীত দুর্বার নররক্তপিপাসু দুর্বৃত্ত দানবের মতোই থাকতে হবে। কলের মানুষের মতো আমার অধীন সৈনিকগণ যেন আমার হুকুম মানতে শেখে। আমার দায়িত্বজ্ঞানে আমার কাজে কলঙ্ক বা শৈথিল্যের যেন এতটুকু আঁচড় না পড়ে। সৈনিকের যে এর বড়ো বদনাম নেই। – তার পর কর্তব্য-অবসানেই আমি তাদের সেই চিরহাস্য প্রফুল্ল গীতিমুখর স্নেহময় ভাই! তখন আমার এই অগ্নি-উদ্গারী নয়নেই যেন স্নেহের সুরধুনী ক্ষরে, বজ্রনির্ঘোষের মতো এই কাঠচোটা স্বরেই যেন করুণা আর স্নেহ ক্ষীর হয়ে ঝরে, আমার কণ্ঠভরা গানে তাদের চিত্তের সব গ্লানি দূর হয়ে যায়! আমার অন্তর আর বাহির যেন এমন একটা অস্বচ্ছ আবরণে চির-আবৃত থাকে যে, কেউ আমার সত্যিকার কান্নারত মূর্তিটি দেখতে না পায়, হাজার চেষ্টাতেও না!
খোদা, আমার অন্তরের এই উচ্ছ্বসিত তপ্তশ্বাস যেন আনন্দ-পুরবির মুখরতানে চিরদিনই এমনই ঢাকা পড়ে যায়, শুধু এইটুকুই এখন তোমার কাছে চাইবার আছে। আর যদি এই অজানার অচিন ব্যথায় কোনো অবুঝ হিয়া ব্যথিয়ে ওঠে, তবে সে যেন মনে মনে আমার প্রার্থনায় যোগ দিয়ে বলে, – ‘আহা, তাই হোক!’ কেননা এমনিতর স্নেহ-কাঙাল, যারা, – যাদের মৃত্যুতে এক ফোঁটা আঁসু ফেলবারও কেউ নেই এ দুনিয়ায়, যারা কারুর দয়া চায় না, অথচ এক বিন্দু স্নেহ-সহানুভূতির জন্যে উদ্বেগ-উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকে, – তাদের দেওয়ার এর বেশি কিছু নেই, আর থাকলেও তারা তা চায়ও না। এই একটু স্নিগ্ধ বাণীই গুহার ম্লান বুকে জ্যোৎস্নার শুভ্র আলোর মতো তাদের সান্ত্বনা দেয়।