কয়েকদিনেই গ্রামের সবার কাছে কালু নিজেকে চোর হিসেবে চিনিয়ে দিলো। লোকের বদনা থেকে শুরু করে গরু, ছাগলও—কিছুই বাদ রাখেনি সে। পারলে তো লোকের টয়লেটও চুরি করে নিয়ে যেতো। তবে টয়লেট চুরির চিন্তা যে তার মাথায় নেই, তা নয়। হাতে গ্লাভস পরে টয়লেটের সবকিছু পার্ট-পার্ট করে খুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা সে ইদানীং করে বেড়ায়।
তার এমন অত্যাচারে গ্রামটা অসহায় হয়ে উঠলো। একদিন গ্রামের সকলে মিলে একটা মিটিং করলো—এই চোরটাকে কী করা যায়। একজন উঠে বললো,
— “এই চোরকে ধরার পর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের ঘরের এমন কোনো জিনিস নেই যেটা এই শালার চোর চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে না। প্রতিটা ঘরে বদনা চুরি হয়েছে। নতুন বদনা কিনতে-কিনতে বাজারেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বলি, শালার চোর, তোর হাগু করতে কয়টা বদনার পানি লাগে? এতগুলো বদনা দিয়ে তুই কী করবে?”
আরেকজন বললো,
— “আরে বদনা তো পরে এসে পাওয়া যাবে; কিন্তু মেয়েদের ব্লাউজ নিয়ে সে কী করবে? আমার বউ ব্লাউজ শুকাতে দিয়েছিল—কিছুক্ষণ পর দেখলাম ব্লাউজটা নেই।”
একেকজন একে একে অভিযোগ তুলতে লাগল। শেষে একজন উঠে বললো,
— “আমার তো প্রথম দিনেই লুঙ্গিটাই খুলে নিয়ে গেছে! ভাবো তো কেমন চোর। আমি লুঙ্গি পরে ঘুমাচ্ছিলাম—হঠাৎ ও এসে টান মেরে নিয়ে গেল। ভাগ্যিস আমার বউ তখন সেখানে ছিল না।”
সবাই এক সুরে বলল—“না না, এমন চোরকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। মেরে ফেলতে হবে।” সবাই বলল, শুধু একবার ধরতে পারলেই হবে।
একদিন কালু ধরা পড়লো। লোকরা বাইরে দামি জিনিসগুলো রেখে দিয়েছিল—শুধু ওকে ধরার জন্য। কালু সেই ফাঁদ বুঝতে পারেনি। এক ঘরের বাইরে চটকে পড়ে থাকা মূল্যবান একটা জিনিস দেখে সে চুরি করতে গেল—তখনই কয়েকজন এসে তাকে ঘিরে ধরে।
কালু পালাতে চাইলো; লুঙ্গিটা উপরে তুলতেই একজন তার লুঙ্গি চেপে ধরল। টান মেরে লুঙ্গিটা কেটে নিলো তারা। হাসতে হাসতে একজন বললো,
— “কোথায় পালাবি বাচ্চা? আমার শরীর থেকে লুঙ্গি টান মেরে নিয়েছিলি; আজ তোকে খুলে নিলাম। সবাই মিলে তোকে আলুভর্তা বানাবো।”
কালু হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে রইল। ঝাঁকে ঝাঁকে লোক এসে তাকে লাথি, কিল, ইট, পাথর—যা পেলো তাই মারতে লাগলো। অনেক দিনের রাগ আজ মেটাল। এতো মার খাওয়ার পর কালু আর বাঁচলো না। মরার আগে সে মনে করলো—ওই মুরগি তাকে অভিশাপ দিয়েছে, এভাবেই মরতে হবে। পরে সবাই মিলে তার দেহ কবর দিলো।
এদিকে ধলু—বেচারা—সব জায়গায় মার খেয়ে এসে পৌঁছালো সেই গ্রামে যেখানে কালুকে মারা হয়েছে। ধলু ভেবেছিল হয়তো এখানে গিয়ে শান্তি পাবো, কিন্তু ভাবনায় ভুল ছিল। রাত হলে কোথায় থাকা যায়? ভয়ে ভয়ে সে কবরস্থানে চলে এলো—এটাই নিরাপদ জায়গা, মনে করে সে।
কবরস্থানের এক ধারে নতুন কবর দেখেই ধলু কবরের উপর শুয়ে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে কবরের দিকে বললো,
— “কবর রে, তুই দুই ফাঁক হয়ে যা—আমি ঢুকে পড়ি তোর ভেতর।”
কবরস্থানের পাশে দুই লোক হাঁটছিল—তারা থমকে গিয়ে বললো,
— “এই কবরস্থানে কি কারও শব্দ শোনা গেল?”
— “হ্যাঁ, ঠিক তাই…”
হালকা আলো তাদের কবরের দিকে পড়তেই দেখা গেল—কবরের উপরে কিছু একটা শুয়ে আছে মানুষের মত। আলো ফেলতেই ধলু আচমকা উঠে বসলো। লোক দুজন ভয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো—“কালু চোরা কবর থেকে উঠে এসেছে! ও আত্মা হয়ে ফিরে এসেছে!”
তারা পালিয়ে গেল, ভয়ে ভয়ে। তাদের দৌড় দেখে ধলু বুঝলো—ওরা হয়তো আরও লোক আনতে যাচ্ছে তাকে মারার জন্য, তাই না হলে এমন পল্মানো আচরণ কেন? ধলুও ভয় পেয়ে পেছনে ফিরে যাওয়ার সাহস পেল না—সে নিজেও “ওরে বাপরে” করে পালাতে শুরু করল।
গ্রামের মানুষ সব মিলিয়ে কবরস্থান জুড়ে জড়ো হয়ে পড়ে। যে দুজন বলেছিল কালু ফিরে এসেছে—তাদের কথাবার্তাই ছড়িয়ে পড়ে। সবাই কবরস্থানে এসেছিল নিজের চোখে দেখতে। ধলু ভয়ে কাঁপছিল—ঠিক যা সে ভেবেছিল তাই হলো। লোক দুজন সবাইকে নিয়ে এসেছে তাকে মারার জন্য; এখন পালাবার উপায় নেই—ওদের পা ধরে ক্ষমা চাইতেই হবে।
ধলু উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাওয়ার উদ্দেশ্যে সামনে এগিয়ে গেল। সবাই তখন লাইটের আলো দিয়ে তাকে আলোকিত করে দেখল—কিন্তু আচমকাই, একেক জন “ওরে বাপরে” করে ফিরে পালাতে লাগলো। কেউ স্যান্ডেল ফেলে দৌড়ালো, কেউ লুঙ্গি তুলে পালালো, কেউ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল—সবাই খানিকটা বেহাল। ধলু অবাক হয়ে দেখছিল—সবাই কেন পালালো? নাকি ওখানে কোন ভূত/ভূত দেখেছে?
ভয়ের কথা মাথায় এলে ধলুও পালানোর চেষ্টা করল। লোকেরা তখন চিৎকার করে বলল—“দেখ! কালুর আত্মা পাচ্ছে আমাদের!” তারা ছড়াতে লাগলো। ধলু রাতে কোথায় থাকবে—কেউ জানে না। একটিবার ঠিক করলো কোনো একটা ঘরে রাত কাটাবে। কিন্তু এই চেহারায় কাউর বাড়িতে ঢুকলেই তাকে কালু ভেবে মারবে—তাই কৌশল ভাবলো।
ধলু বলল,
— “পেয়েছি! মুখে মাটি মেখে ঢুকব।”
মাটি মেখে প্রথম বাড়িতে গেলে গিন্নি দরজার ফাঁক থেকে জিজ্ঞেস করলো,
— “কে?”
— “আমি ধলু…” বলতেই গিন্নি ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো—ভেবে ফেললো কালুর আত্মা এসেছে। স্বামী এসে বললো,
— “কি হয়েছে? ভয়ে কাঁপছ কেন?”
দরজার ফাঁক দিয়ে ধলুর মাটির গন্ধ এসে পড়তেই গিন্নি চিৎকার করে বলল—বাতাসে ভীষণ বাজে গন্ধ! তারা দরজা খুলতে মানা করলো—ধলু বুঝলো এখানে থাকা যাবে না।
পরের বাড়িতে গিয়ে ধলু নাম বলতেই থেমে গেল—“ধলু” বলতে ভয় পেলো। তাই নাম পরিবর্তন করে বললো,
— “আমি ধলাৎকার।” গিন্নিটা কানে কম শুনে “বলাৎকার” শুনে ভেবে ফেলল—ভাবা শুরু করলো অন্য কিছু! সে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— “বাই, আমি বিধবা, এইরকম সর্বনাশ কোরো না!”
ধলু তাড়াতাড়ি অন্য বাড়িতে গেল। ওই বাড়ির দরজায় বললো,
— “আমি কাশেম।”
লোকটা বললো, “কোন কাশেম? আমি চিনি না।”
ধলু বললো, “আমি মানুষ—তাড়াতাড়ি দরজা খুলুন, বাইরে ভয়ে মৃত্যু ভয় হয়।” দরজা খুললে লোকটা ধলুকে দেখে বললো,
— “এই কী! মাটির মেকআপ?”
ধলু বলল,
— “মাটির মেকআপ—ত্বকের জন্য ভালো, আপনি চাইলে কাল থেকে ব্যবহার করবেন।”
লোকটা ধীরে ধীরে ভয় পেলো—ধলুর চেহারা কালুর মতো। তবু ধলুকে জায়গা দিলো। ধলু জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনার বাসায় আর কেউ থাকে?”
— “আমি আর রাজা।”
লোকটি একটি বিড়ালের দিকে ইশারা করল—“ঐ তো।”
ধলু মনে মনে বলল, ‘শালার বিলাই, তুই বিলাই হয়েও খানদানি নাম পেয়ে গেছিস, আর আমি কী পেলাম?’ বিড়ালটি কটমট করে ধলুকে দেখলো—মনে হলো বলে উঠছে, ‘তুই আমাকে গালি দিলি? দাঁড়ায়ে, আজ তোকে দেখব।’
ধলু ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে কোনো একটা বস্তুর উপর থেকে পানি পড়ে ঘুম ভেঙে গেল। ধলু আশ্রয়দাতাকে বললো,
— “ও ভাই, বাড়িতে কি বৃষ্টি পড়ে?”
কিন্তু পানির গন্ধ অদ্ভুত—নোনতা আর বাজে। তখন সে দেখলো বিড়াল “ম্যাও ম্যাও” করে মাচার ওপর দিয়ে যাচ্ছে; বিড়ালের নলকূপের পানিতেই ধলুর মুখে মাখা মাটি ধুয়ে মুছে গেল। আশ্রয়দাতা এসে দেখলে চিৎকার করে ফেলে—“ওরে! কাইল্লা চোর—এটা কে?” শুনেই দরজা খুলে সবাই পালিয়ে গেল। ধলু বুঝলো—এখানে আর থাকা যাবে না। সে দ্রুত মুখ মুছে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।
(চলবে…)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।