কাইল্লা চোরা(পর্ব:-০১) -সোহেল রানা

এক গ্রামে দুই যমজ ভাই ছিল। একজনের নাম কালু, আরেকজনের নাম ধলু। নাম কালু আর ধলু হলেও দুইজনই দেখতে কালো। আর কালুর নামের মতো তার কাজকর্মও সব কালো। এলাকার এমন একটা বাসা নেই, সে চুরি করতে ঢুকেনি। দা, বাটি, চামচ থেকে শুরু করে সে বড়বড় জিনিসও চুরি করতো। মাঝেমাঝে ধরা খেয়ে মারও খেতো, আবার অনেক সময় পালিয়ে যেতো।

ধলু কিন্তু ভালো। ভাইয়ের মতো সে চুরি করে না, চুরি সমর্থনও করে না। ভাইকে সে নিষেধ করে এসব চুরি ছেড়ে দিতে। নিষেধ করাটাই স্বাভাবিক—কারণ মাঝেমাঝে লোকে তাকে কালু মনে করে মারধর করে। এটা কি মেনে নেওয়া যায়?

এইতো সেদিন রাতে তার ভাই কালু ঘর একটাতে ঢুকে তাদের মুরগি চুরি করছিল। মুরগি যখন খক্ করে উঠে, তখন বাসার সবাই “চোর চোর” বলে বের হয়ে আসে। কালু মুরগির মুখটা চেপে ধরে যাতে চিৎকার করতে না পারে। তারপর ঐ অবস্থায় দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে দেখে মুরগিটা মারা গেছে—নিশ্বাস নিতে পারছে না। মরবেই তো, মুখটা যদি চেপে ধরে, তাহলে কি পাছা দিয়ে নিশ্বাস নেবে মুরগিটা?

মুরগিটাকে মরতে দেখে কালু আফসোস করে বললো,
— “ওরে মুরগি, তোরে এতো কষ্ট করে চুরি করে আনলাম, আমার কষ্টের কোনো দাম দিলি না তুই?”

কালুর মনে হলো, মুরগিটা হঠাৎ জিন্দা হয়ে তাকে বলছে,
— “তোকেও একদিন আমার মতো মরতে হবে। এর শাস্তি একদিন তুই পাবি।”

কথাটি বলেই মুরগিটা আবার মরে গেল। কালু ভয় পেয়ে গেল—মুরগি কী করে কথা বললো? তাও আবার মরা মুরগি। ভূত হয়ে গেল না তো মুরগিটা? ভয় পেয়ে হাত থেকে সে মরা মুরগিটা ফেলে দিলো। তখনও পাড়ার অনেক লোক এসে জড়ো হয়েছে। তাকে চিনতে পেরে ওরা চিৎকার করে বললো,
— “ওরে কাইল্লা চোরা, আজ তোর একদিন কী? আমাদের সতেরো থেকে আঠারো দিন!”

মুরগির মায়া ত্যাগ করে, লুঙ্গিটা একটু উপরে তুলে কালু এমন দৌড় দিলো—ওরা তার লুঙ্গির বাতাসও ধরতে পারলো না। একজন আফসোস করে বললো,
— “শালার, চোরগুলো এতো দৌড়াতে পারে কী করে?”

আরেকজন বললো,
— “পালিয়ে যাবি কোথায়? আজ তোকে তোর ঘর থেকে তুলে আনবো।”

সবাই কালুর ঘরের দিকে যেতে লাগলো। ঘরে গরম লাগায় ধলু তখন বের হয়ে শরীরটা ঠাণ্ডা করছিল—তখনই সবাই এসে তাকে ধরলো। চারজন তার চারটা হাতপা ধরে, আরেকজন মাথা ধরে তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। ধলু চিৎকার করে বললো,
— “তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”

একজন বললো,
— “তোকে আজ উপরে পাঠায় দিবো, শালার মুরগি চোর।”

— “আমি মুরগি চোর না! তোমরা ভুল করছো—আমি কালু না, আমি ধলু!” চিল্লাতে লাগলো ধলু।
কিন্তু তার মুখে একটা ঘুষি লেগে গেল। একজন বললো,
— “চুরি করে এখন ধলু সাজছি তাই না? সবাই ওকে এখানেই আছাড় মার।”

লোকটার কথা শুনে যারা ধলুকে ধরে রাখে তারা তাকে আছাড় মারলো। ধলু মুরগির মতো খক্ করে উঠলো—কোমরটা মনে হল ভেঙে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— “ভাই, একটু আস্তে আছাড় মারতে পারোনি?”

উক্তি শেষ হতেই সবাই আবার কিল, ঘুষি, লাথি চালাতে লাগল। বেচারার হাড় ভেঙে গেল, কাপড় ছিঁড়ে গেল। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে সবাই চলে গেল। ধলু উঠে ধীরে ধীরে ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলো।

ঘরে এসে সে দেখলো, তার ভাই কালু মনের সুখে নাচছে। ধলুর এই অবস্থা দেখে কালু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “এ কী রে ভাই, তোর এই অবস্থা কী করে হলো?”

ধলু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— “চুপ। তুই আমাকে ধরবি না। তোর কারণে হয়েছে এসব। তুই চুরি করলি, সবাই আমাকে তুই ভেবে মেরে কী অবস্থায় ফেলেছে দেখ। আমি পরিশ্রম করে টাকা আয় করি—তারপরও মার খেতে হলো।”

কালু অক্সিজেনহীন হেসে বললো,
— “ইশ! আয় ভাই, তোকে তেল মালিশ করে দিই।”

ধলু কইলো,
— “লাগবে না তোর তেল মালিশ। কতবার বলেছি এসব চুরি ছেড়ে দে।”

কালু গর্ব করে বললো,
— “না না, চুরি তো ছাড়া যাবে না। চুরি আমার রক্তে মিশে গেছে।”

কালু চুরি ছাড়লো না। সেদিনের পর থেকে ধলুকে আরও কয়েকবার মার খেতে হলো—একাধিকবারই এমন হয়েছে। আজ আবার এক বিধবা মহিলার শাড়ি চুরির দায়ে ধলুকে মার পড়লো। শাড়ি চুরি করে পালিয়ে গেল কালু, আর পাবলিকের সব মার হজম করে ধলু। ধলু আফসোস করে বললো,
— “আল্লাহ, তুমি কেন আমার চেহারাটা কাইল্লা চোরের মতো করে দিলা?”

একদিন রাগে, অভিমানে ধলু এলাকা ছেড়ে চলে গেল। কিন্তু যেই এলাকায় সে গেল—সেই অঞ্চলে আগে থেকেই তার ভাই চুরিতে ‘পি.এইচ.ডি’ করে ফেলেছে। এলাকায় ভাতের ডেকচি পর্যন্ত চুরি করে নিয়ে গেছে কালু। লোকেরা এখন তাকে খুঁজছে। যেদিন ধলু ঐ গ্রামে যায়, সেদিনই সবাই মিলে তাকে ধরে মারতে থাকে। বেচারা এই এলাকায় এসেও শান্তি পেল না—তাই আবার অন্য এলাকায় যায়। সেখানে গিয়েও একই অবস্থা—আবার লাঠি, আঘাত। মার খেয়ে ধলু চিৎকার করে বললো,
— “ওরে কাইল্লা চোরা, তুই কি একটা এলাকাও বাদ রাখিসনি? সব এলাকায় চুরি করেছিস?”

তার নিজের এলাকায় কাইল্লা চোরের জন্য ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে—দেখলেই মেরে ফেলবে। তাই সে নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য এক দূরের এলাকায় আশ্রয় নেয়। প্রথমদিনেই বাজিমাত করার জন্য সে একটা ঘর হানা দিলো। দেখলো, বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে। চুরি করার জন্য জিনিস খুঁজতে লাগলো। মনে মনে গালি দিল—
— “শালার, এমন ফইন্নি বাড়িও থাকে? চুরি করার মতো কিছুই নেই?”

কিছু না নিয়ে গেলে তার চুরিবিদ্যা অপমানিত হবে—তাই সে কিছু না নিয়ে ফিরবে না। ঘরের গেরস্ত দেখে, লুঙ্গি পরে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। কালু ওর পাশে গিয়ে লুঙ্গিটা টান মেরে খুলে নিল। তারপর দৌড় দিলো লুঙ্গিটা নিয়ে। গেরস্তের ঘুম ভেঙে গেল। এখন কেবল লুঙ্গি হারানো—চোরের পেছনে তাড়া করলে নিজে সব হারাতে পারে…

(চলবে…..)

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!