একজন জেলা শিক্ষা অফিসারকে পাঠানো হলো একটি হাই স্কুল পরিদর্শনের জন্য। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হলো—পরিদর্শন শেষে স্কুলটি এম.পি.ওভুক্ত করার উপযোগী কি না, সে বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট মতামত পেশ করবেন।
শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের আগমন উপলক্ষে স্কুলটিকে পরিপাটি করে সাজানো হলো। ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দেশ দেওয়া হলো—স্যার যা জিজ্ঞেস করেন, সবাই যেন তার ঠিকঠাক জবাব দেয়।
শিক্ষা অফিসার মহোদয় স্কুলে পৌঁছালে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী সবাই তাঁকে স্বাগত জানাল। শিক্ষা অফিসার স্কুলের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে প্রধান শিক্ষককে বললেন, “বাহ! আপনার স্কুলটা দেখছি খুব সুন্দর।”
প্রধান শিক্ষক বিগলিত স্বরে বললেন, “সব আপনাদের দোয়া, স্যার। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, স্যার, আমার স্কুল দেখে আপনি যেরকম মুগ্ধ হয়েছেন, তার চাইতেও বেশি মুগ্ধ হবেন আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা দেখে।”
শিক্ষা অফিসার মহোদয় মাথা নেড়ে বললেন, “ভাল, খুব ভাল।”
এরপর তিনি প্রধান শিক্ষকের কক্ষে কিছুক্ষণ বসে শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শনে বের হলেন। সঙ্গে প্রধান শিক্ষকসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক।
প্রথমে তিনি ঢুকলেন সপ্তম শ্রেণির কক্ষে। তাঁকে দেখে সকল ছাত্র-ছাত্রী উঠে দাঁড়াল। শিক্ষা অফিসার সামনের বেঞ্চের এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, “বল তো, সোমনাথ মন্দির কে ভেঙেছে?”
ছাত্রটি ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে বলল, “স্যার, আমি জানি না।”
শিক্ষা অফিসার অষ্টম শ্রেণির কক্ষে গেলেন। সেখানেও একই প্রশ্ন করলেন। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলল, “স্যার, আমরা জানি না, স্যার। আমরা কোনো মন্দির ভাঙিনি।”
মহা বিরক্ত হয়ে তিনি নবম শ্রেণিতে গেলেন। সেখানেও জিজ্ঞেস করলেন, “সোমনাথ মন্দির কে ভেঙেছে?”
একটি চঞ্চল ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, আমরা ভাঙিনি। দশম শ্রেণির ছাত্ররা খুব দুষ্টু—ওরাই হয়তো ভেঙেছে।”
শিক্ষা অফিসার রাগে দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগলেন। প্রধান শিক্ষকের কপালে ঘাম। তিনি বুঝে ফেলেছেন, তাঁর স্কুলের এম.পি.ওভুক্তি এ যাত্রায় আর হচ্ছে না।
এবার শিক্ষা অফিসার দশম শ্রেণিতে গেলেন এবং যথারীতি একই প্রশ্ন করলেন। সবাই একবাক্যে বলল, “আমরা জানি না, স্যার।”
প্রচণ্ড রাগে শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের মুখ লাল হয়ে উঠল। তিনি হিংস্র চোখে প্রধান শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “সোমনাথ মন্দির কে ভেঙেছে বলতে পারে না—এই আপনার ছাত্র?”
প্রধান শিক্ষক ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “স্যার, বিশ্বাস করুন, আমার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের আমরা খুব কড়া শাসনের মধ্যে রাখি। এরা সত্যি বলছে, স্যার—সোমনাথ মন্দির এরা ভাঙেনি, কে ভেঙেছে সেটাও দেখেনি।”
শিক্ষা অফিসার মহোদয় হাসবেন না কাঁদবেন—কিছুই বুঝতে পারলেন না।
অফিসে ফিরে তিনি ঢাকায় রিপোর্ট পাঠালেন। রিপোর্টের সারমর্ম ছিল—
“সোমনাথ মন্দির কে ভেঙেছে, স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক কেউই বলতে পারছে না। এই স্কুলকে কোনো অবস্থাতেই এম.পি.ওভুক্ত করা যাবে না।”
এক মাস পর শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের কাছে একটি চিঠি এল। চিঠিতে ঐ স্কুলের এম.পি.ওভুক্তির ঘোষণা দেওয়া আছে।
চিঠি পড়ে শিক্ষা অফিসার মহোদয়ের মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। তিনি কালবিলম্ব না করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেন।
হেড অফিসে পৌঁছেই তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে চিঠিটি দেখিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “স্যার, এটা আপনি কী করলেন?”
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বললেন, “কেন, কী হয়েছে?”
শিক্ষা অফিসার বললেন, “এই স্কুলকে কীভাবে আপনি এম.পি.ওভুক্ত করলেন?”
“কেন, সমস্যা কোথায়?”
“আমি আমার রিপোর্টে লিখেছি—‘সোমনাথ মন্দির কে ভেঙেছে, এই স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক কেউ জানে না’…”
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“শুনুন, আপনাকে স্কুলে পাঠানো হয়েছিল পরিদর্শনের জন্য—জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নয়। আর এরা যদি সোমনাথ মন্দির ভেঙেও থাকে, সেটা কখনো আপনার কাছে স্বীকার করবে?”
শিক্ষা অফিসার মহোদয় অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলেন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।