ছুটি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রথম অংশ

বালকদিগের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট্ করিয়া একটা নূতন ভাবোদয় হইল, নদীর ধারে একটা প্রকাণ্ড শালকাষ্ঠ মাস্তুলে রূপান্তরিত হইবার প্রতীক্ষায় পড়িয়া ছিল ; স্থির হইল , সেটা সকলে মিলিয়া গড়াইয়া লইয়া যাইবে ।

যে ব্যক্তির কাঠ আবশ্যক-কালে তাহার যে কতখানি বিস্ময় বিরক্তি এবং অসুবিধা বোধ হইবে , তাহাই উপলব্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল ।

কোমর বাঁধিয়া সকলেই যখন মনোযোগের সহিত কার্যে প্রবৃত্ত হইবার উপক্রম করিতেছে এমন সময়ে ফটিকের কনিষ্ঠ মাখনলাল গম্ভীরভাবে সেই গুঁড়ির উপরে গিয়া বসিল ; ছেলেরা তাহার এইরূপ উদার ঔদাসীন্য দেখিয়া কিছু বিমর্ষ হইয়া গেল ।

একজন আসিয়া ভয়ে ভয়ে তাহাকে একটু-আধটু ঠেলিল কিন্ত সে তাহাতে কিছুমাত্র বিচলিত হইল না ; এই অকাল-তত্ত্বজ্ঞানী মানব সকলপ্রকার ক্রীড়ার অসারতা সম্বন্ধে নীরবে চিন্তা করিতে লাগিল ।

ফটিক আসিয়া আস্ফালন করিয়া কহিল , “ দেখ্‌, মার খাবি। এইবেলা ওঠ্‌ । ”

সে তাহাতে আরো একটু নড়িয়াচড়িয়া আসনটি বেশ স্থায়ীরূপে দখল করিয়া লইল ।

এরূপ স্থলে সাধারণের নিকট রাজসম্মান রক্ষা করিতে হইলে অবাধ্য ভ্রাতার গন্ডদেশে অনতিবিলম্বে এক চড় কষাইয়া দেওয়া ফটিকের কর্তব্য ছিল — সাহস হইল না । কিন্তু, এমন একটা ভাব ধারণ করিল , যেন ইচ্ছা করিলেই এখনই উহাকে রীতিমত শাসন করিয়া দিতে পারে কিন্তু করিল না; কারণ, পূর্বাপেক্ষা আর-একটা ভালো খেলা মাথায় উদয় হইয়াছে , তাহাতে আর-একটু বেশি মজা আছে । প্রস্তাব করিল , মাখনকে সুদ্ধ ঐ কাঠ গড়াইতে আরম্ভ করা যাক ।

মাখন মনে করিল , ইহাতে তাহার গৌরব আছে ; কিন্তু অন্যান্য পার্থিব গৌরবের ন্যায় ইহার আনুষঙ্গিক যে বিপদের সম্ভাবনাও আছে , তাহা তাহার কিংবা আর-কাহারো মনে উদয় হয় নাই ।

ছেলেরা কোমর বাঁধিয়া ঠেলিতে আরম্ভ করিল — ‘ মারো ঠেলা হেঁইয়ো , সাবাস জোয়ান হেঁইয়ো । ‘ গুঁড়ি একপাক ঘুরিতে-না ঘুরিতেই মাখন তাহার গাম্ভীর্য গৌরব এবং তত্ত্বজ্ঞান সমেত ভূমিসাৎ হইয়া গেল ।

খেলার আরম্ভেই এইরূপ আশাতীত ফললাভ করিয়া অন্যান্য বালকেরা বিশেষ হৃষ্ট হইয়া উঠিল , কিন্তু ফটিক কিছু শশব্যস্ত হইল । মাখন তৎক্ষণাৎ ভূমিশয্যা ছাড়িয়া ফটিকের উপরে গিয়া পড়িল , একেবারে অন্ধভাবে মারিতে লাগিল । তাহার নাকে মুখে আঁচড় কাটিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে গৃহাভিমুখে গমন করিল । খেলা ভাঙিয়া গেল ।

ফটিক গোটাকতক কাশ উৎপাটন করিয়া লইয়া একটা অর্ধনিমগ্ন নৌকার গলুইয়ের উপরে চড়িয়া বসিয়া চুপচাপ করিয়া কাশের গোড়া চিবাইতে লাগিল ।

এমনসময় একটা বিদেশী নৌকা ঘাটে আসিয়া লাগিল । একটি অর্ধবয়সী ভদ্রলোক কাঁচা গোঁফ এবং পাকা চুল লইয়া বাহির হইয়া আসিলেন । বালককে জিজ্ঞাসা করিলেন , “ চক্রবর্তীদের বাড়ি কোথায় । ”

বালক ডাঁটা চিবাইতে চিবাইতে কহিল , “ ঐ হোথা । ” কিন্তু কোন্‌দিকে যে নির্দেশ করিল, কাহারো বুঝিবার সাধ্য রহিল না ।

ভদ্রলোকটি আবার জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কোথা । ”

সে বলিল , “ জানি নে । ” বলিয়া পূর্ববৎ তৃণমূল হইতে রসগ্রহণে প্রবৃত্ত হইল । বাবুটি তখন অন্য লোকের সাহায্য অবলম্বন করিয়া চক্রবর্তীদের গৃহের সন্ধানে চলিলেন ।

অবিলম্বে বাঘা বাগদি আসিয়া কহিল , “ ফটিকদাদা , মা ডাকছে । ”

ফটিক কহিল , “ যাব না । ”

বাঘা তাহাকে বলপূর্বক আড়কোলা করিয়া তুলিয়া লইয়া গেল; ফটিক নিষ্ফল আক্রোশে হাত পা ছুঁড়িতে লাগিল ।

ফটিককে দেখিবামাত্র তাহার মা অগ্নিমূর্তি হইয়া কহিলেন , “ আবার তুই মাখনকে মেরেছিস! ”

ফটিক কহিল , “ না , মারি নি । ”

“ ফের মিথ্যে কথা বলছিস! ”

“ কখ্‌খনো মারি নি । মাখনকে জিজ্ঞাসা করো । ”

মাখনকে প্রশ্ন করাতে মাখন আপনার পূর্ব নালিশের সমর্থন করিয়া বলিল , “ হাঁ , মেরেছে । ”

তখন আর ফটিকের সহ্য হইল না । দ্রুত গিয়া মাখনকে এক সশব্দ চড় কষাইয়া দিয়া কহিল , “ ফের মিথ্যে কথা! ”

মা মাখনের পক্ষ লইয়া ফটিককে সবেগে নাড়া দিয়া তাহার পৃষ্ঠে দুটা-তিনটা প্রবল চপেটাঘাত করিলেন । ফটিক মাকে ঠেলিয়া দিল ।

মা চীৎকার করিয়া কহিলেন , “ অ্যাঁ , তুই আমার গায়ে হাত তুলিস! ”

এমন সময়ে সেই কাঁচাপাকা বাবুটি ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন , “ কী হচ্ছে তোমাদের । ”

ফটিকের মা বিস্ময়ে আনন্দে অভিভূত হইয়া কহিলেন , “ ওমা , এ যে দাদা , তুমি কবে এলে । ” বলিয়া গড় করিয়া প্রণাম করিলেন ।

বহুদিন হইল দাদা পশ্চিমে কাজ করিতে গিয়াছিলেন, ইতিমধ্যে ফটিকের মার দুই সন্তান হইয়াছে , তাহারা অনেকটা বাড়িয়া উঠিয়াছে , তাহার স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে , কিন্তু একবারও দাদার সাক্ষাৎ পায় নাই । আজ বহুকাল পরে দেশে ফিরিয়া আসিয়া বিশ্বম্ভরবাবু তাঁহার ভগিনীকে দেখিতে আসিয়াছেন ।

কিছুদিন খুব সমারোহে গেল । অবশেষে বিদায় লইবার দুই-একদিন পূর্বে বিশ্বম্ভরবাবু তাঁহার ভগিনীকে ছেলেদের পড়াশুনা এবং মানসিক উন্নতি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলেন । উত্তরে ফটিকের অবাধ্য উচ্ছৃঙ্খলতা , পাঠে অমনোযোগ , এবং মাখনের সুশান্ত সুশীলতা ও বিদ্যানুরাগের বিবরণ শুনিলেন ।

তাঁহার ভগিনী কহিলেন , “ ফটিক আমার হাড় জ্বালাতন করিয়াছে । ”

শুনিয়া বিশ্বম্ভর প্রস্তাব করিলেন , তিনি ফটিককে কলিকাতায় লইয়া গিয়া নিজের কাছে রাখিয়া শিক্ষা দিবেন ।

বিধবা এ প্রস্তাবে সহজেই সম্মত হইলেন ।

ফটিককে জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কেমন রে ফটিক , মামার সঙ্গে কলকাতায় যাবি ? ”

ফটিক লাফাইয়া উঠিল বলিল , “ যাব । ”

যদিও ফটিককে বিদায় করিতে তাহার মায়ের আপত্তি ছিল না , কারণ তাঁহার মনে সর্বদাই আশঙ্কা ছিল — কোন্‌দিন সে মাখনকে জলেই ফেলিয়া দেয় কি মাথাই ফাটায় কি কী একটা দুর্ঘটনা ঘটায় , তথাপি ফটিকের বিদায়গ্রহণের জন্য এতাদৃশ আগ্রহ দেখিয়া তিনি ঈষৎ ক্ষুণ্ন হইলেন ।

‘ কবে যাবে ‘, ‘ কখন্‌ যাবে ‘ করিয়া ফটিক তাহার মামাকে অস্থির করিয়া তুলিল ; উৎসাহে তাহার রাত্রে নিদ্রা হয় না ।

অবশেষে যাত্রাকালে আনন্দের ঔদার্য-বশত তাহার ছিপ ঘুড়ি লাটাই সমস্ত মাখনকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগদখল করিবার পুরা অধিকার দিয়া গেল ।

কলিকাতায় মামার বাড়ি পৌঁছিয়া প্রথমত মামির সঙ্গে আলাপ হইল । মামি এই অনাবশ্যক পরিবারবৃদ্ধিতে মনে মনে যে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন তাহা বলিতে পারি না । তাঁহার নিজের তিনটি ছেলে লইয়া তিনি নিজের নিয়মে ঘরকন্না পাতিয়া বসিয়া আছেন , ইহার মধ্যে সহসা একটি তেরো বৎসরের অপরিচিত অশিক্ষিত পাড়াগেঁয়ে ছেলে ছাড়িয়া দিলে কিরূপ একটা বিপ্লবের সম্ভাবনা উপস্থিত হয় । বিশ্বম্ভরের এত বয়স হইল , তবু কিছুমাত্র যদি জ্ঞানকাণ্ড আছে ।

বিশেষত , তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই । শোভাও নাই , কোনো কাজেও লাগে না । স্নেহও উদ্রেক করে না , তাহার সঙ্গসুখও বিশেষ প্রার্থনীয় নহে । তাহার মুখে আধে-আধো কথাও ন্যাকামি , পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্‌ভতা । হঠাৎ কাপড়চোপড়ের পরিমাণ রক্ষা না করিয়া বেমানানরূপে বাড়িয়া উঠে ; লোকে সেটা তাহার একটা কুশ্রী স্পর্ধাস্বরূপ জ্ঞান করে । তাহার শৈশবের লালিত্য এবং কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা সহসা চলিয়া যায়; লোকে সেজন্য তাহাকে মনে মনে অপরাধ না দিয়া থাকিতে পারে না । শৈশব এবং যৌবনের অনেক দোষ মাপ করা যায় , কিন্তু এই সময়ের কোনো স্বাভাবিক অনিবার্য ত্রুটিও যেন অসহ্য বোধ হয় ।

সেও সর্বদা মনে মনে বুঝিতে পারে , পৃথিবীর কোথাও সে ঠিক খাপ খাইতেছে না ; এইজন্য আপনার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সর্বদা লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী হইয়া থাকে । অথচ এই বয়সেই স্নেহের জন্য কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত কাতরতা মনে জন্মায় । এই সময়ে যদি সে কোনো সহৃদয় ব্যক্তির নিকট হইতে স্নেহ কিংবা সখ্য লাভ করিতে পারে তবে তাহার নিকট আত্মবিক্রীত হইয়া থাকে । কিন্তু তাহাকে স্নেহ করিতে কেহ সাহস করে না; কারণ সেটা সাধারণে প্রশ্রয় বলিয়া মনে করে । সুতরাং তাহার চেহারা এবং ভাবখানা অনেকটা প্রভুহীন পথের কুকুরের মতো হইয়া যায় ।

অতএব , এমন অবস্থায় মাতৃভবন ছাড়া আর-কোনো অপরিচিত স্থান বালকের পক্ষে নরক । চারি দিকের স্নেহশূন্য বিরাগ তাহাকে পদে পদে কাঁটার মতো বিঁধে । এই বয়সে সাধারণত নারীজাতিকে কোনো-এক শ্রেষ্ঠ স্বর্গলোকের দুর্লভ জীব বলিয়া মনে ধারণা হইতে আরম্ভ হয় , অতএব তাঁহাদের নিকট হইতে উপেক্ষা অত্যন্ত দুঃসহ বোধ হয় ।

মামির স্নেহহীন চক্ষে সে যে একটা দুর্গ্রহের মতো প্রতিভাত হইতেছে , এইটে ফটিকের সবচেয়ে বাজিত । মামি যদি দৈবাৎ তাহাকে কোনো-একটা কাজ করিতে বলিতে , তাহা হইলে সে মনের আনন্দে যতটা আবশ্যক তার চেয়ে বেশি কাজ করিয়া ফেলিত — অবশেষে মামি যখন তাহার উৎসাহ দমন করিয়া বলিতেন , “ ঢের হয়েছে , ঢের হয়েছে । ওতে আর তোমায় হাত দিতে হবে না । এখন তুমি নিজের কাজে মন দাওগে । একটু পড়োগে যাও । ”— তখন তাহার মানসিক উন্নতির প্রতি মামির এতটা যত্নবাহুল্য তাহার অত্যন্ত নিষ্ঠুর অবিচার বলিয়া মনে হইত ।

ঘরের মধ্যে এইরূপ অনাদর , ইহার পর আবার হাঁফ ছাড়িবার জায়গা ছিল না । দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়িয়া কেবলই তাহার সেই গ্রামের কথা মনে পড়িত ।

প্রকাণ্ড একটা ধাউস ঘুড়ি লইয়া বোঁ বোঁ শব্দে উড়াইয়া বেড়াইবার সেই মাঠ , ‘ তাইরে নাইরে নাইরে না ‘ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বরচিত রাগিণী আলাপ করিয়া অকর্মণ্যভাবে ঘুরিয়া বেড়াইবার সেই নদীতীর , দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া সাঁতার কাটিবার সেই সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী , সেই-সব দল-বল উপদ্রব স্বাধীনতা, এবং সর্বোপরি সেই অত্যাচারিণী অবিচারিণী মা অহর্নিশি তাহার নিরুপায় চিত্তকে আকর্ষণ করিত ।

জন্তুর মতো একপ্রকার অবুঝ ভালোবাসা — কেবল একটা কাছে যাইবার অন্ধ ইচ্ছা , কেবল একটা না দেখিয়া অব্যক্ত ব্যাকুলতা , গোধূলিসময়ের মাতৃহীন বৎসের মতো কেবল একটা আন্তরিক ‘ মা মা ‘ ক্রন্দন — সেই লজ্জিত শঙ্কিত শীর্ণ দীর্ঘ

গল্পটির শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!