আমার স্ত্রী তাকে খুব যত্ন করে খাওয়াল। খাওয়ার শেষে তাকে শাড়িটি দেওয়া হলো। মেয়েটি অভিভূত হয়ে গেল। এ রকম একটা উপহার বোধহয় তার কল্পনাতেও ছিল না। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে নিলাম। কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ রহিমা?
রহিমা ফিসফিস করে বলল, ভালো আছি ভাইজান।
‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’
‘পছন্দ হইব না! কী কন ভাইজান! অত দামি জিনিস কি আমরা কোনোদিন চউক্ষে দেখছি!’
‘তোমার ভাইয়ের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছিলাম। তুমি কী করে বুঝলে ভাই বেঁচে আছে?’
রহিমা অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, কী কইরা বুঝলাম আমি নিজেও জানি না ভাইজান। মৃত্যুর খবর শুইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসছি। বাড়ির উঠানে পাও দিতেই মনে হইল মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে।
‘কীজন্যে মনে হল?’
‘জানি না ভাইজান। মনে হইল।’
‘এইরকম কি তোমার আগেও হয়েছে? মানে কোনও ঘটনা আগে থেকেই কি তুমি বলতে পার?’
‘জ্বি না।’
‘মন্তাজ তোমাকে কিছু বলেনি? জ্ঞান ফিরলে সে কী দেখল বা তার কী মনে হল?’
‘জ্বি না।’
‘জিজ্ঞেস করনি?’
‘করছি। হারামজাদা কথা কয় না।’
রহিমা আরও খানিকক্ষণ বসে পানটান খেয়ে চলে গেল।
আমার টানা লেখালেখিতে ছেদ পড়ল। কিছুতেই আর লিখতে পারি না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলে কবরের বিকট অন্ধকারে জেগে উঠে কী ভাবল? কী সে দেখল? তখন তার মনের অনুভূতি কেমন ছিল? মন্তাজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, আমার মনে হয় জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলেকে ভয়স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়াটা অন্যায় কাজ। এই ছেলে নিশ্চয়ই প্রাণপণে এটা ভুলতে চেষ্টা করছে। ভুলতে চেষ্টা করছে বলেই কাউকে কিছু বলতে চায়
না। তবু একদিন কৌতূহলের হাতে পরাজিত হলাম।
দুপুরবেলা।
গল্পের বই নিয়ে বসেছি। পাড়াগাঁর ঝিম-ধরা দুপুর। একটু যেন ঘুম-ঘুম আসছে। জানালার বাইরে খুট করে শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি মন্তাজ। আমি বললাম- কী খবররে মন্তাজ?
‘ভালো।’
‘বোন আছে না চলে গেছে?’
‘গেছেগা।’
‘আয় ভেতরে আয়।’
মন্তাজ ভেতরে চলে এল। আমার সঙ্গে তার ব্যবহার এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রায়ই খানিকটা গল্পগুজব হয়। মনে হয় আমাকে সে খানিকটা পছন্দও করে। এইসব ছেলে ভালোবাসার খুব কাঙাল হয়। অল্পকিছু মিষ্টি কথা, সামান্য একটু আদর এতেই তারা অভভূত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে বলে আমার ধারণা।
মন্তাজ এসে খাটের এক প্রান্তে বসল। আড়ে আড়ে তোমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা
বলি, কেমন?
‘আইচ্ছা।’
‘ঠিকমতো জবাব দিবি তো?’
‘হুঁ।’
‘আচ্ছা মন্তাজ, কবরে তুই জেগে উঠেছিলি, মনে আছে?’
‘আছে।’
‘যখন জেগে উঠলি তখন ভয় পেয়েছিলি?’
‘না।’
‘না কেন?’
মন্তাজ চুপ করে রইল। আমার দিক থেকে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, কী দেখলি- চারদিক অন্ধকার?
‘হ।’
‘কেমন অন্ধকার?’
মন্তাজ এবারও জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে।
আমি বলালম, কবর তো খুব অন্ধকার তবু ভয় লাগল না?
মন্তাজ নিচুস্বরে বলল, আরেকজন আমার সাথে আছিল সেইজন্য ভয় লাগে নাই।
আমি চমকে উঠে বললাম, আরেকজন ছিল মানে? আরেকজন কে ছিল?
‘চিনি না। আন্ধাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না।’
‘ছেলে না মেয়ে?’
‘জানি না।’
‘সে কী করল?
‘আমারে আদর করল। আর কইল, কোনও ভয় নাই।’
‘কীভাবে আদর করল?’
‘মনে নাই।’
‘কী কী কথা সে বলল?’
‘মজার মজার কথা-খালি হাসি আসে।’
বলতে বলতে মন্তাজ মিয়া ফিক করে হেসে ফেলল।
আমি বললাম, কীরকম মজার কথা? দুএকটা বল তো শুনি?
‘মনে নাই।’
‘কিছুই মনে নাই? সে কে এটা কি বলেছে?’
‘জ্বি না।’
‘ভালো করে ভেবেটেবে বল তো-কোনোকিছু কি মনে পড়ে?’
‘উনার গায়ে শ্যাওলার মতো গন্ধ ছিল।’
‘আর কিছু?’
মন্তাজ মিয়া চুপ করে রইল।
আমি বললাম, ভালো করে ভেবেটেবে বল তো! কিছুই মনে নেই?
মন্তাজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা মনে আসছে।
‘সেটা কী?’
‘বলতাম না। কথাডা গোপন।’
‘বলবি না কেন?’
মন্তাজ জবাব দিল না।
আমি আবার বললাম, বল মন্তাজ, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।
মন্তাজ উঠে চলে গেল।
এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।বাকি যে-ক’দিন গ্রামে ছিলাম, সে কোনোদিন আমার কাছে আসেনি। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছি তবু আসেনি। কয়েকবার নিজেই গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে সে পালিয়ে গেল। আমি আর চেষ্টা করলাম না।
কিছু রহস্য সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়। রাখুক। এটা তার অধিকার। এই অধিকার অনেক কষ্টে সে অর্জন করেছে। শ্যাওলাগন্ধী সেই ছায়াসঙ্গীর কথা আমরা যদি কিছু নাও জানি তাতেও কিছু যাবে আসবে না।
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।