মতো রঙ ধরিয়াছে । কলিকাতার গলির ভিতরকার ইষ্টকজর্জর অপরিচ্ছন্ন ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলির উপরেও এই রৌদ্রের আভা একটি অপরূপ লাবণ্য বিস্তার করিয়াছে ।
আমার ঘরে আজ রাত্রি শেষ হইতে না হইতে সানাই বাজিতেছে । সে বাঁশি যেন আমার বুকের পঞ্জরের হাড়ের মধ্য হইতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বাজিয়া উঠিতেছে । করুণ ভৈরবী রাগিণীতে আমার আসন্ন বিচ্ছেদব্যথাকে শরতের রৌদ্রের সহিত সমস্ত বিশ্বজগৎময় ব্যাপ্ত করিয়া দিতেছে । আজ আমার মিনির বিবাহ ।
সকাল হইতে ভারি গোলমাল , লোকজনের আনাগোনা । উঠানে বাঁশ বাঁধিয়া পাল খাটানো হইতেছে ; বাড়ির ঘরে ঘরে এবং বারান্দায় ঝাড় টাঙাইবার ঠুংঠাং শব্দ উঠিতেছে ; হাঁকডাকের সীমা নাই ।
আমি আমার লিখিবার ঘরে বসিয়া হিসাব দেখিতেছি , এমন সময় রহমত আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল ।
আমি প্রথমে তাহাকে চিনিতে পারিলাম না । তাহার সে ঝুলি নাই, তাহার সে লম্বা চুল নাই , তাহার শরীরে পূর্বের মতো সে তেজ নাই । অবশেষে তাহার হাসি দেখিয়া তাহাকে চিনিলাম ।
কহিলাম , “ কী রে রহমত , কবে আসিলি? ”
সে কহিল , “ কাল সন্ধ্যাবেলা জেল হইতে খালাস পাইয়াছি । ”
কথাটা শুনিয়া কেমন কানে খট করিয়া উঠিল । কোনো খুনীকে কখনো প্রত্যক্ষ দেখি নাই , ইহাকে দেখিয়া সমস্ত অন্তঃকরণ যেন সংকুচিত হইয়া গেল । আমার ইচ্ছা করিতে লাগিল , আজিকার এই শুভদিনে এ লোকটা এখান হইতে গেলেই ভালো হয় ।
আমি তাহাকে কহিলাম , “ আজ আমাদের বাড়িতে একটা কাজ আছে , আমি কিছু ব্যস্ত আছি , তুমি আজ যাও । ”
কথাটা শুনিয়াই সে তৎক্ষণাৎ চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল , অবশেষে দরজার কাছে গিয়া একটু ইতস্তত করিয়া কহিল , “ খোঁখীকে একবার দেখিতে পাইব না ? ”
তাহার মনে বুঝি বিশ্বাস ছিল , মিনি সেই ভাবেই আছে । সে যেন মনে করিয়াছিল , মিনি আবার সেই পূর্বের মতো ‘ কাবুলিওয়ালা , ও কাবুলিওয়ালা ‘ করিয়া ছুটিয়া আসিবে , তাহাদের সেই অত্যন্ত কৌতুকাবহ পুরাতন হাস্যালাপের কোনোরূপ ব্যত্যয় হইবে না । এমন-কি , পূর্ববন্ধুত্ব স্মরণ করিয়া সে একবাক্স আঙুর এবং কাগজের মোড়কে কিঞ্চিৎ কিস্মিস্ বাদাম বোধ করি কোনো স্বদেশীয় বন্ধুর নিকট হইতে চাহিয়া-চিন্তিয়া সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল — তাহার সে নিজের ঝুলিটি আর ছিল না ।
আমি কহিলাম , “ আজ বাড়িতে কাজ আছে , আজ আর কাহারো সহিত দেখা হইতে পারিবে না । ”
সে যেন কিছু ক্ষুণ্ন হইল । স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া একবার স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাহিল , তার পরে ‘ বাবু সেলাম ‘ বলিয়া দ্বারের বাহির হইয়া গেল ।
আমার মনে কেমন একটু ব্যথা বোধ হইল । মনে করিতেছি তাহাকে ফিরিয়া ডাকিব , এমন সময়ে দেখি সে আপনি ফিরিয়া আসিতেছে ।
কাছে আসিয়া কহিল , “ এই আঙুর এবং কিঞ্চিৎ কিস্মিস বাদাম খোঁখীর জন্য আনিয়াছিলাম , তাহাকে দিবেন । ”
আমি সেগুলি লইয়া দাম দিতে উদ্যত হইলে সে হঠাৎ আমার হাত চাপিয়া ধরিল; কহিল , “ আপনার বহুৎ দয়া , আমার চিরকাল স্মরণ থাকিবে — আমাকে পয়সা দিবেন না ।
“বাবু , তোমার যেমন একটি লড়কী আছে , তেমনি দেশে আমারও একটি লড়কী আছে । আমি তাহারই মুখখানি স্মরণ করিয়া তোমার খোঁখীর জন্য কিছু কিছু মেওয়া হাতে লইয়া আসি , আমি তো সওদা করিতে আসি না । ”
এই বলিয়া সে আপনার মস্ত ঢিলা জামাটার ভিতর হাত চালাইয়া দিয়া বুকের কাছে কোথা হইতে একটুকরা ময়লা কাগজ কাবুলিওয়ালা বাহির করিল । বহু সযত্নে ভাঁজ খুলিয়া দুই হস্তে আমার টেবিলের উপর মেলিয়া ধরিল ।দেখিলাম , কাগজের উপর একটি ছোটো হাতের ছাপ । ফোটোগ্রাফ নহে , তেলের ছবি নহে , হাতে খানিকটা ভুসা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে । কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতিবৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে — যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশুহস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চয় করিয়া রাখে ।দেখিয়া আমার চোখ ছল্ছল্ করিয়া আসিল । তখন , সে যে একজন কাবুলি মেওয়াওয়ালা আর আমি যে একজন বাঙালি সম্ভ্রান্তবংশীয় , তাহা ভুলিয়া গেলাম – তখন বুঝিতে পারিলাম , সেও যে আমিও সে , সেও পিতা আমিও পিতা । তাহার পর্বতগৃহবাসিনী ক্ষুদ্র পার্বতীর সেই হস্তচিহ্ন আমারই মিনিকে স্মরণ করাইয়া দিল । আমি তৎক্ষণাৎ তাহাকে অন্তঃপুর হইতে ডাকাইয়া পাঠাইলাম । অন্তঃপুরে ইহাতে অনেক আপত্তি উঠিয়াছিল । কিন্তু, আমি কিছুতে কর্ণপাত করিলাম না । রাঙা-চেলি-পরা কপালে-চন্দন-আঁকা বধূবেশিনী মিনি সলজ্জ ভাবে আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল ।
তাহাকে দেখিয়া কাবুলিওয়ালা প্রথমটা থতমত খাইয়া গেল , তাহাদের পুরাতন আলাপ জমাইতে পারিল না । অবশেষে হাসিয়া কহিল , “ খোঁখী , তোমি সসুরবাড়ি যাবিস্ ? ”
মিনি এখন শ্বশুরবাড়ির অর্থ বোঝে , এখন আর সে পূর্বের মতো উত্তর দিতে পারিল না, রহমতের প্রশ্ন শুনিয়া লজ্জায় আরক্ত হইয়া মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল । কাবুলিওয়ালার সহিত মিনির যেদিন প্রথম সাক্ষাৎ হইয়াছিল , আমার সেই দিনের কথা মনে পড়িল । মনটা কেমন ব্যথিত হইয়া উঠিল ।
মিনি চলিয়া গেলে একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রহমত মাটিতে বসিয়া পড়িল । সে হঠাৎ স্পষ্ট বুঝিতে পারিল , তাহার মেয়েটিও ইতিমধ্যে এইরূপ বড়ো হইয়াছে , তাহার সঙ্গেও আবার নূতন আলাপ করিতে হইবে — তাহাকে ঠিক পূর্বের মতো তেমনটি আর পাইবে না । এ আট বৎসরে তাহার কী হইয়াছে তাই বা কে জানে । সকালবেলায় শরতের স্নিগ্ধ রৌদ্রকিরণের মধ্যে সানাই বাজিতে লাগিল , রহমত কলিকাতার এক গলির ভিতরে বসিয়া আফগানিস্থানের এক মরু পর্বতের দৃশ্য দেখিতে লাগিল ।
আমি একখানি নোট লইয়া তাহাকে দিলাম । বলিলাম , “ রহমত , তুমি দেশে তোমার মেয়ের কাছে ফিরিয়া যাও ; তোমাদের মিলনসুখে আমার মিনির কল্যাণ হউক । ”
এই টাকাটা দান করিয়া হিসাব হইতে উৎসব-সমারোহের দুটো-একটা অঙ্গ ছাঁটিয়া দিতে হইল । যেমন মনে করিয়াছিলাম তেমন করিয়া ইলেকট্রিক আলো জ্বালাইতে পারিলাম না , গড়ের বাদ্যও আসিল না , অন্তঃপুরে মেয়েরা অত্যন্ত অসন্তোষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন , কিন্তু মঙ্গল-আলোকে আমার শুভ উৎসব উজ্জ্বল হইয়া উঠিল ।
সমাপ্ত