কাবুলিওয়ালা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-২য় অংশ

শুনিয়া মিনি শ্বশুর নামক কোনো-এক অপরিচিত জীবের দুরবস্থা কল্পনা করিয়া অত্যন্ত হাসিত ।

 

এখন শুভ্র শরৎকাল । প্রাচীনকালে এই সময়েই রাজারা দিগ্‌বিজয়ে বাহির হইতেন । আমি কলিকাতা ছাড়িয়া কখনো কোথাও যাই নাই , কিন্তু সেইজন্যই আমার মনটা পৃথিবীময় ঘুরিয়া বেড়ায় । আমি যেন আমার ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী , বাহিরের পৃথিবীর জন্য আমার সর্বদা মন কেমন করে । একটা বিদেশের নাম শুনিলেই অমনি আমার চিত্ত ছুটিয়া যায় , তেমনি বিদেশী লোক দেখিলেই অমনি নদী পর্বত অরণ্যের মধ্যে একটা কুটিরের দৃশ্য মনে উদয় হয় , এবং একটা উল্লাসপূর্ণ স্বাধীন জীবনযাত্রার কথা কল্পনায় জাগিয়া উঠে ।

এ দিকে আবার আমি এমনি উদ্ভিজ্জপ্রকৃতি যে , আমার কোণটুকু ছাড়িয়া একবার বাহির হইতে গেলে মাথায় বজ্রাঘাত হয় । এইজন্য সকালবেলায় আমার ছোটো ঘরে টেবিলের সামনে বসিয়া এই কাবুলির সঙ্গে গল্প করিয়া আমার অনেকটা ভ্রমণের কাজ হইত । দুইধারে বন্ধুর দুর্গম দগ্ধ রক্তবর্ণ উচ্চ গিরিশ্রেণী , মধ্যে সংকীর্ণ মরুপথ , বোঝাই-করা উষ্ট্রের শ্রেণী চলিয়াছে ; পাগড়িপরা বণিক ও পথিকেরা কেহ-বা উটের ‘ পরে , কেহ-বা পদব্রজে; কাহারো হাতে বর্শা , কাহারো হাতে সেকেলে চক্ মকি-ঠোকা বন্দুক — কাবুলি মেঘমন্দ্রস্বরে ভাঙা বাংলায় স্বদেশের গল্প করিত আর এই ছবি আমার চোখের সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইত ।

মিনির মা অত্যন্ত শঙ্কিত স্বভাবের লোক; রাস্তায় একটা শব্দ শুনিলেই তাঁহার মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত মাতাল আমাদের বাড়িটাই বিশেষ লক্ষ্য করিয়া ছুটিয়া আসিতেছে । এই পৃথিবীটা যে সর্বত্রই চোর ডাকাত মাতাল সাপ বাঘ ম্যালেরিয়া শুঁয়াপোকা আরসোলা এবং গোরার দ্বারা পরিপূর্ণ এতদিন (খুব বেশি দিন নহে) পৃথিবীতে বাস করিয়াও সে বিভীষিকা তাঁহার মন হইতে দূর হইয়া যায় নাই ।

রহমত কাবুলিওয়ালা সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ নিঃসংশয় ছিলেন না । তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখিবার জন্য তিনি আমাকে বারবার অনুরোধ করিয়াছিলেন । আমি তাঁহার সন্দেহ হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিলে তিনি পর্যায়ক্রমে আমাকে গুটিকতক প্রশ্ন করিলেন , “ কখনো কি কাহারো ছেলে চুরি যায় না । কাবুলদেশে কি দাস-ব্যাবসা প্রচলিত নাই । একজন প্রকাণ্ড কাবুলির পক্ষে একটি ছোটো ছেলে চুরি করিয়া লইয়া যাওয়া একেবারেই কি অসম্ভব । ”

আমাকে মানিতে হইল , ব্যাপারটা যে অসম্ভব তাহা নহে, কিন্তু অবিশ্বাস্য । বিশ্বাস করিবার শক্তি সকলের সমান নহে , এইজন্য আমার স্ত্রীর মনে ভয় রহিয়া গেল । কিন্তু তাই বলিয়া বিনা দোষে রহমতকে আমাদের বাড়িতে আসিতে নিষেধ করিতে পারিলাম না ।

 

প্রতি বৎসর মাঘ মাসের মাঝামাঝি রহমত দেশে চলিয়া যায় । এই সময়টা সমস্ত পাওনার টাকা আদায় করিবার জন্য সে বড়ো ব্যস্ত থাকে । বাড়ি বাড়ি ফিরিতে হয়, কিন্তু তবু একবার মিনিকে দর্শন দিয়া যায় । দেখিলে বাস্তবিক মনে হয় , উভয়ের মধ্যে যেন একটা ষড়যন্ত্র চলিতেছে । সকালে যেদিন আসিতে পারে না সেদিন দেখি সন্ধ্যার সময় আসিয়াছে। অন্ধকারে ঘরের কোণে সেই ঢিলেঢালা-জামা-পায়জামা পরা সেই ঝোলাঝুলিওয়ালা লম্বা লোকটাকে দেখিলে বাস্তবিক হঠাৎ মনের ভিতরে একটা আশঙ্কা উপস্থিত হয় । কিন্তু, যখন দেখি মিনি ‘ কাবুলিওয়ালা , ও কাবুলিওয়ালা ‘ করিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া আসে এবং দুই অসমবয়সী বন্ধুর মধ্যে পুরাতন সরল পরিহাস চলিতে থাকে তখন সমস্ত হৃদয় প্রসন্ন হইয়া উঠে ।

একদিন সকালে আমার ছোটো ঘরে বসিয়া প্রুফশীট সংশোধন করিতেছি । বিদায় লইবার পূর্বে আজ দিন-দুইতিন হইতে শীতটা খুব কন্‌কনে হইয়া উঠিয়াছে , চারি দিকে একেবারে হীহীকার পড়িয়া গেছে । জানালা ভেদ করিয়া সকালের রৌদ্রটি টেবিলের নীচে আমার পায়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে , সেই উত্তাপটুকু বেশ মধুর বোধ হইতেছে; বেলা বোধ করি আটটা হইবে, মাথায়-গলাবন্ধ-জড়ানো উষাচরগণ প্রাতর্ভ্রমণ সমাধা করিয়া প্রায় সকলে ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছে । এমন সময় রাস্তায় ভারি একটা গোল শুনা গেল ।

চাহিয়া দেখি , আমাদের রহমতকে দুইপাহারাওয়ালা বাঁধিয়া লইয়া আসিতেছে — তাহার পশ্চাতে কৌতূহলী ছেলের দল চলিয়াছে । রহমতের গাত্রবস্ত্রে রক্তচিহ্ন এবং একজন পাহারাওয়ালার হাতে রক্তাক্ত ছোরা । আমি দ্বারের বাহিরে গিয়া পাহারাওয়ালাকে দাঁড় করাইলাম; জিজ্ঞাসা করিলাম , ব্যাপারটা কী ।

কিয়দংশ তাহার কাছে কিয়দংশ রহমতের কাছে শুনিয়া জানিলাম যে , আমাদের প্রতিবেশী একজন লোক রামপুরী চাদরের জন্য রহমতের কাছে কিঞ্চিৎ ধারিত — মিথ্যাপূর্বক সেই দেনা সে অস্বীকার করে এবং তাহাই লইয়া বচসা করিতে করিতে রহমত তাহাকে এক ছুরি বসাইয়া দিয়াছে ।

রহমত সেই মিথ্যাবাদীর উদ্দেশে নানারূপ অশ্রাব্য গালি দিতেছে , এমন সময় ‘ কাবুলিওয়ালা , ও কাবুলিওয়ালা ‘ করিয়া ডাকিতে ডাকিতে মিনি ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল ।

রহমতের মুখ মুহূর্তের মধ্যে কৌতুকহাস্যে প্রফুল্ল হইয়া উঠিল । তাহার স্কন্ধে আজ ঝুলি ছিল না , সুতরাং ঝুলি সম্বন্ধে তাহাদের অভ্যস্ত আলোচনা হইতে পারিল না । মিনি একেবারেই তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল , “ তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে ? ”

রহমত হাসিয়া কহিল , “ সিখানেই যাচ্ছে । ”

দেখিল উত্তরটা মিনির হাস্যজনক হইল না , তখন হাত দেখাইয়া বলিল , “ সসুরাকে মারিতাম, কিন্তু কী করিব , হাত বাঁধা । ”

সাংঘাতিক আঘাত করা অপরাধে কয়েক বৎসর রহমতের কারাদণ্ড হইল ।

তাহার কথা একপ্রকার ভুলিয়া গেলাম । আমরা যখন ঘরে বসিয়া চিরাভ্যস্তমত নিত্য কাজের মধ্যে দিনের পর দিন কাটাইতাম তখন একজন স্বাধীন পর্বতচারী পুরুষ কারাপ্রাচীরের মধ্যে যে কেমন করিয়া বর্ষযাপন করিতেছে , তাহা আমাদের মনেও উদয় হইত না ।

আর , চঞ্চলহৃদয়া মিনির আচরণ যে অত্যন্ত লজ্জাজনক তাহা তাহার বাপকেও স্বীকার করিতে হয় । সে স্বচ্ছন্দে তাহার পুরাতন বন্ধুকে বিস্মৃত হইয়া প্রথমে নবী সহিসের সহিত সখ্য স্থাপন করিল । পরে ক্রমে যত তাহার বয়স বাড়িয়া উঠিতে লাগিল ততই সখার পরিবর্তে একটি একটি করিয়া সখী জুটিতে লাগিত । এমন-কি , এখন তাহার বাবার লিখিবার ঘরেও তাহাকে আর দেখিতে পাওয়া যায় না । আমি তো তাহার সহিত একপ্রকার আড়ি করিয়াছি ।

 

কত বৎসর কাটিয়া গেল । আর-একটি শরৎকাল আসিয়াছে । আমার মিনির বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইয়াছে । পূজার ছুটির মধ্যে তাহার বিবাহ হইবে । কৈলাসবাসিনীর সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘরের আনন্দময়ী পিতৃভবন অন্ধকার করিয়া পতিগৃহে যাত্রা করিবে ।

প্রভাতটি অতি সুন্দর হইয়া উদয় হইয়াছে । বর্ষার পরে এই শরতের নূতনধৌত রৌদ্র যেন সোহাগায়-গলানো নির্মল সোনার

গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!