কঙ্কাল-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-২য় অংশ

বৎসরের জীবন্ত, যৌবনতাপে উত্তপ্ত আরক্তিম রূপখানি একবার তোমার চোখের সামনে দাঁড় করাই , বহুকালের মতো তোমার দুই চক্ষে নিদ্রা ছুটাইয়া দিক , তোমার অস্থিবিদ্যাকে অস্থির করিয়া দেশছাড়া করি । ”

আমি বলিলাম , “ তোমার গা যদি থাকিত তো গা ছুঁইয়া বলিতাম , সে বিদ্যার লেশমাত্র আমার মাথায় নাই । আর তোমার সেই ভুবনমোহন পূর্ণযৌবনের রূপ রজনীর অন্ধকারপটের উপরে জাজ্বল্যমান হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে । আর অধিক বলিতে হইবে না । ”

“ আমার কেহ সঙ্গিনী ছিল না । দাদা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন , বিবাহ করিবেন না । অন্তঃপুরে আমি একা । বাগানের গাছতলায় আমি একা বসিয়া ভাবিতাম , সমস্ত পৃথিবী আমাকেই ভালোবাসিতেছে , সমস্ত তারা আমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে , বাতাস ছল করিয়া বার বার দীর্ঘনিশ্বাসে পাশ দিয়া চলিয়া যাইতেছে এবং যে তৃণাসনে পা দুটি মেলিয়া বসিয়া আছি তাহার যদি চেতনা থাকিত তবে সে পুনর্বার অচেতন হইয়া যাইত । পৃথিবীর সমস্ত যুবাপুরুষ ঐ তৃণপুঞ্জরূপে দল বাঁধিয়া নিস্তব্ধে আমার চরণবর্তী হইয়া দাঁড়াইয়াছে এইরূপ আমি কল্পনা করিতাম ; হৃদয়ে অকারণে কেমন বেদনা অনুভব হইত । ”

“ দাদার বন্ধু শশিশেখর যখন মেডিকেল কালেজ হইতে পাস হইয়া আসিলেন তখন তিনিই আমাদের বাড়ির ডাক্তার হইলেন। আমি তাঁহাকে পূর্বে আড়াল হইতে অনেকবার দেখিয়াছি । দাদা অত্যন্ত অদ্ভূত লোক ছিলেন — পৃথিবীটাকে যেন ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া দেখিতেন না । সংসারটা যেন তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট ফাঁকা নয় — এইজন্য সরিয়া সরিয়া একেবারে প্রান্তে গিয়া আশ্রয় লইয়াছেন । ”

“ তাঁহার বন্ধুর মধ্যে এক শশিশেখর । এইজন্য বাহিরের যুবকদের মধ্যে আমি এই শশিশেখরকেই সর্বদা দেখিতাম। এবং যখন আমি সন্ধ্যাকালে পুষ্পতরুতলে সম্রাজ্ঞীর আসন গ্রহণ করিতাম তখন পৃথিবীর সমস্ত পুরুষজাতি শশিশেখরের মূর্তি ধরিয়া আমার চরণাগত হইত । — শুনিতেছ ? কী মনে হইতেছে । ”

আমি সনিশ্বাসে বলিলাম , “ মনে হইতেছে , শশিশেখর হইয়া জন্মিলে বেশ হইত । ”

“ আগে সবটা শোনো । ”

একদিন বাদলার দিনে আমার জ্বর হইয়াছে । ডাক্তার দেখিতে আসিয়াছেন । সেই প্রথম দেখা ।

“ আমি জানলার দিকে মুখ করিয়া ছিলাম , সন্ধ্যার লাল আভাটা পড়িয়া রুগ্‌ণ মুখের বিবর্ণতা যাহাতে দূর হয় । ডাক্তার যখন ঘরে ঢুকিয়াই আমার মুখের দিকে একবার চাহিলেন তখন আমি মনে মনে ডাক্তার হইয়া কল্পনায় নিজের মুখের দিকে চাহিলাম । সেই সন্ধ্যালোকে কোমল বালিশের উপরে একটি ঈষৎক্লিষ্ট কুসুমপেলব মুখ ; অসংযমিত চূর্ণকুন্তল ললাটের উপর আসিয়া পড়িয়াছে এবং লজ্জায় আনমিত বড়ো বড়ো চোখের পল্লব কপোলের উপর ছায়া বিস্তার করিয়াছে । ”

ডাক্তার নম্র মৃদুস্বরে দাদাকে বলিলেন , ‘ একবার হাতটা দেখিতে হইবে । ‘

“ আমি গাত্রাবরণের ভিতর হইতে ক্লান্ত সুগোল হাতখানি বাহির করিয়া দিলাম । একবার হাতের দিকে চাহিয়া দেখিলাম , যদি নীলবর্ণ কাঁচের চুড়ি পরিতে পারিতাম তো আরো বেশ মানাইত । রোগীর হাত লইয়া নাড়ী দেখিতে ডাক্তারের এমন ইতস্তত ইতিপূর্বে কখনো দেখি নাই । অত্যন্ত অসংলগ্নভাবে কম্পিত অঙ্গুলিতে নাড়ী দেখিলেন। তিনি আমার জ্বরের উত্তাপ বুঝিলেন , আমিও তাঁহার অন্তরের নাড়ী কিরূপ চলিতেছে কতকটা আভাস পাইলাম । বিশ্বাস হইতেছে না ? ”

আমি বলিলাম , “ অবিশ্বাসের কোনো কারণ দেখিতেছি না — মানুষের নাড়ী সকল অবস্থায় সমান চলে না । ”

“ কালক্রমে আরো দুই-চারিবার রোগ ও আরোগ্য হইবার পরে দেখিলাম আমার সেই সন্ধ্যাকালের মানস-সভায় পৃথিবীর কোটি কোটি পুরুষ-সংখ্যা অত্যন্ত হ্রাস হইয়া ক্রমে একটিতে আসিয়া ঠেকিল , আমার পৃথিবী প্রায় জনশূন্য হইয়া আসিল । জগতে কেবল একটি ডাক্তার এবং একটি রোগী অবশিষ্ট রহিল । ”

“ আমি গোপনে সন্ধ্যাবেলায় একটি বাসন্তী রঙের কাপড় পরিতাম , ভালো করিয়া খোঁপা বাঁধিয়া মাথায় একগাছি বেলফুলের মালা জড়াইতাম , একটি আয়না হাতে লইয়া বাগানে গিয়া বসিতাম । ”

“ কেন । আপনাকে দেখিয়া কি আর পরিতৃপ্তি হয় না । বাস্তবিকই হয় না । কেননা, আমি তো আপনি আপনাকে দেখিতাম না । আমি তখন একলা বসিয়া দুইজন হইতাম । আমি তখন ডাক্তার হইয়া আপনাকে দেখিতাম , মুগ্ধ হইতাম এবং ভালোবাসিতাম এবং আদর করিতাম , অথচ প্রাণের ভিতরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস সন্ধ্যাবাতাসের মতো হূ হূ করিয়া উঠিত । ”

“ সেই হইতে আমি আর একলা ছিলাম না; যখন চলিতাম নত নেত্রে চাহিয়া দেখিতাম পায়ের অঙ্গুলিগুলি পৃথিবীর উপরে কেমন করিয়া পড়িতেছে, এবং ভাবিতাম এই পদক্ষেপ আমাদের নূতন-পরীক্ষোত্তীর্ণ ডাক্তারের কেমন লাগে; মধ্যাহ্নে জানলার বাহিরে ঝাঁ ঝাঁ করিত , কোথাও সাড়াশব্দ নাই , মাঝে মাঝে এক-একটা চিল অতিদূর আকাশে শব্দ করিয়া উড়িয়া যাইত ; এবং আমাদের উদ্যানপ্রাচীরের বাহিরে খেলেনাওয়ালা সুর করিয়া ‘ চাই খেলেনা চাই, চুড়ি চাই ‘ করিয়া ডাকিয়া যাইত; আমি একখানি ধব্‌ধবে চাদর পাতিয়া নিজের হাতে বিছানা করিয়া শয়ন করিতাম ; একখানি অনাবৃত বাহু কোমল বিছানার উপর যেন অনাদরে মেলিয়া দিয়া ভাবিতাম , এই হাতখানি এমনি ভঙ্গিতে কে যেন দেখিতে পাইল , কে যেন দুইখানি হাত দিয়া তুলিয়া লইল , কে যেন ইহার আরক্ত করতলের উপর একটি চুম্বন রাখিয়া দিয়া আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া যাইতেছে। মনে করো এইখানেই গল্পটা যদি শেষ হয় তাহা হইলে কেমন হয় । ”

আমি বলিলাম , “ মন্দ হয় না । একটু অসম্পূর্ণ থাকে বটে , কিন্তু সেইটুকু আপন মনে পূরণ করিয়া লইতে বাকি রাতটুকু বেশ কাটিয়া যায় । ”

“ কিন্তু তাহা হইলে গল্পটা যে বড়ো গম্ভীর হইয়া পড়ে । ইহার উপহাসটুকু থাকে কোথায় । ইহার ভিতরকার কঙ্কালটা তাহার সমস্ত দাঁত ক ‘ টি মেলিয়া দেখা দেয় কই । ”

“ তার পরে শোনো । একটুখানি পসার হইতেই আমাদের বাড়ির একতলায় ডাক্তার তাঁহার ডাক্তারখানা খুলিলেন । তখন আমি তাঁহাকে মাঝে মাঝে হাসিতে হাসিতে ঔষধের কথা , বিষের কথা , কী করিলে মানুষ সহজে মরে , এই-সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতাম । ডাক্তারির কথায় ডাক্তারের মুখ খুলিয়া যাইত । শুনিয়া শুনিয়া মৃত্যু যেন পরিচিত ঘরের লোকের মতো হইয়া গেল । ভালোবাসা এবং মরণ কেবল এই দুটোকেই পৃথিবীময় দেখিলাম ।

“ আমার গল্প প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে- আর বড়ো বাকি নাই । ”

আমি মৃদুস্বরে বলিলাম , “ রাত্রিও প্রায় শেষ হইয়া আসিল । ”

কিছুদিন হইতে দেখিলাম ডাক্তারবাবু বড়ো অন্যমনস্ক এবং আমার কাছে যেন ভারি অপ্রতিভ । একদিন দেখিলাম তিনি কিছু বেশিরকম সাজসজ্জা করিয়া দাদার কাছে তাঁহার জুড়ি ধার লইলেন , রাত্রে কোথায় যাইবেন । ”

আমি আর থাকিতে পারিলাম না । দাদার কাছে গিয়া নানা কথার পর জিজ্ঞাসা করিলাম , ‘ হাঁ দাদা , ডাক্তারবাবু আজ জুড়ি লইয়া কোথায় যাইতেছেন । ‘

সংক্ষেপে দাদা বলিলেন , ‘ মরিতে । ‘

আমি বলিলাম , ‘ না , সত্য করিয়া বলো-না । ‘

তিনি পূর্বাপেক্ষা কিঞ্চিৎ খোলসা করিয়া বলিলেন , ‘ বিবাহ করিতে । ‘

আমি বলিলাম ‘ সত্য নাকি । ‘— বলিয়া অনেক হাসিতে লাগিলাম ।

গল্পের তৃতীয় অংশ পড়িতে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!