সিলেটে ঘুরে দেখার মতো অনেক জায়গা আছে। চাইলেই একজন পর্যটক প্রকৃতির কোলে হারাতে পারেন। আমার পছন্দের তিনটি জায়গা আছে। যে তিনটি জায়গা আমাকে কাছে টানে তার প্রথমটি হলো সিলেট, তারপর নেত্রকোনার সুসং দূর্গাপুর এবং পাহাড়িকন্যা রাঙ্গামাটি। সিলেটের প্রতি ভালো করে দেখতে না পারার অতৃপ্ততা আমাকে বারবার যেন কাছে টানে। দূর্গাপুরের প্রতি আছে বিশেষ এক দূর্বলতা।রাঙ্গামাটির প্রতি ভাল লাগাটা হঠাৎ করেই হয়ে গেলো। যাই হোক এবার সিলেট প্রসঙ্গে আসা যাক।
আমি সিলেট থেকে বাড়িতে যাবার সময় যতো ঝামেলাই হোক না কেনো, লঞ্চ হতো আমার বাহন। একবার খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি আর আমার যাত্রাপথের আরেক সঙ্গী সবুজ, লঞ্চ ঘাটে আসার আগেই লঞ্চ হাওয়া। দু’জনই ভিজে একাকার, যেতে হলে বাসে করে নয়তো লঞ্চের জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আবার বাসে যেতেও মন সায় দিচ্ছে না। তার মধ্যে বাসের প্রতি অাছে আমার প্রচন্ড বিরক্তিবোধ। মুখে প্রচণ্ড দূর্গন্ধ নিয়ে আপনার সাথে একজন জোর করে কথা বলতে চাইলে যেরকম বিরক্তিবোধ হবে ঠিক সেরকম। কোনরকম পার পেতে পারলে বাঁচি। রাত হয়ে গেছে, ভেজা কাপড়ও বদলাতে হবে আবার বৃষ্টির কারণে কোথাও যেতেও পারছি না। চিন্তার গভীরে যখন হাবুডুবু খাচ্ছি ঠিক সেই মূহূর্তে এক দোকানদার ডুবুরীর মতো সাহায্যের হাত বাড়ালো। লোকটা অদূরে একটা থাকার জায়গা দেখালো। থাকার জায়গাটা টিনশেডের। বাহির থেকে বুঝার উপায় নেই ভিতরে কেমন হবে। মাত্র একশো টাকায় পেয়ে গেলাম থাকার কি সুন্দর একটা ঘর! ভাবতেই আমাদের দুজনের কাছেই নিজেদের বিজয়ী বিজয়ী মনে হচ্ছিল। ঘরের ভিতরে ঢুকেই মনে হল আমার জয় করা রাজ্যে সম্পদ বলতে একটি মাত্র ভাঙ্গা পায়ের ঘোড়া। মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ ঘরে সম্পত্তি বলতে একটি ভাঙ্গা খাট আর নিভু নিভু করছে এমন মান্দাতার আমলের একটি বাল্ব। ঘরটাকে যদি গোয়াল ঘর বলি খুব একটা ভুল হবেনা। কী আর করা পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে, তাই বাধ্য হয়েই থাকতে হলো। বাল্ব জ্বালিয়েই শুয়ে পরলাম। উপরে তাকিয়ে ঘরটাকে দেখছি, দেখলাম বাল্বের পাশে একটা টিকটিকি পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে। গোয়াল ঘরে যেরকম ময়লা রঙের টিকটিকি দেখা যায় ঠিক সেরকম কালো। দেখলেই কেমন যেন গা ঘিনঘিন করে। এরা শহুরে টিকটিকির মত সাদা না। চোখগুলোও ভয়ানক রকমের, মনে হয় আফ্রিকা থেকে আগত। আমি যদি রাজা হতাম আর কেউ যদি এরকম একটা টিকটিকি দেখিয়ে আমাকে বলতো,”এবার রাজা তোমার রাজ্য ছেড়ে দাও, নয়তো গায়ে ছেড়ে দিব”। আমি নির্দ্ধিধায় আমার রাজ্য ছেড়ে টিকটিকির হাত থেকে বাঁচতে চাইতাম। এসব যখন ভাবছি ঠিক তখনই টিকটিকিটা লাফ দিয়ে পোকা ধরতে গিয়ে আমার গায়ে এসে পড়লো। বুঝেন এবার তখন কী অবস্থা হতে পারে! আচমকা এ ঘটনায় আমি লাফ মেরে ওঠলাম। থাকার খাটটা কুকুরের লেজে হঠাৎ করে পা পড়লে যেমন অল্প শব্দে ঘেও করে ঠিক তেমনই কটমট করে ওঠলো। মনে হলো খাটের আয়ু ছ’মাস কমে গেছে। সুযোগ বুঝে টিকটিকিটা লাপাত্তা হয়ে গেলো। আমার এ কাণ্ডে সবুজ খুব মজা পেলো। মনে হচ্ছে তাকে লাফিং গ্যাস মারা হয়েছে। কাদুঁনে গ্যাস ছুড়লেও তার হাসির কমতি হবে ন।
ঘুমাতে চেষ্টা করছি কিছুতেই ঘুম আসছেনা। অনেকদিন পর বাড়িতে যাচ্ছি কী করব না করব এ ধরণের আকাশ কুসুম কল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। সবুজ নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পরেছে। কিছু কিছু মানুষ আছে তারা যা পায় সেটাকে স্বাভবিক ভাবেই নেয়। তারা মহাসমারোহ করে কষ্ট করতে চায় না। এদের ভাবনার আকাশে কখন কি আসলো আর কি গেলো তার হিসেব রাখেনা। এ কারনেই তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। আমার কাছে সবুজকে তাই মনে হচ্ছে। আমার ভাবনার সুখি মানুষদের বেশির ভাগই নাক ডেকে ঘুমায়। সবুজও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি ভূমিকম্পও হয়, সে নিশ্চিন্তে বলবে”ভূমিকম্প হওয়ার দরকার হয়েছে তাই হচ্ছে। চিন্তা করার কিছু নাই। আরেকটু ঘুমিয়ে নেই”। আসলে সে তাই করতো। অনেকদিন ধরে তার সাথে ট্রেইনিং করেছি তাই তার সম্পর্কে বলতে পারি।
হঠাৎ দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দ শুনতে পেলাম। রাত একটা অথবা দেড়টা বাজবে হয়তো কিন্তু কিছুতেই আমি চোখ মেলতে পারছিনা। শব্দটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কে যেন আমার হাত পা বেঁধে রেখেছে। চিৎকার করতে চাইছি কিন্তু কিছুতেই পারছিনা। সারারাত এরকম আরো ভয়ানক কিছু স্বপ্ন দেখলাম। একটা সময় শুনতে পেলাম বিকট শব্দে কয়েকটা গরু একটু পরপর ডেকে চলেছে। ঘুম ভাঙলো ওই গোয়াল ঘরের গৃহস্ত অর্থাৎ মালিকের ডাকে। এতক্ষণ যা শুনেছি তা গরুর ডাক না,লঞ্চের হর্ণ। লঞ্চ আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, গোয়াল ঘরের মালিকের কল্যাণে শেষ রক্ষা হলো। গোয়াল ঘরের মালিক নিশ্চিত ভালো মানুষ, নয়তো উনি আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই লঞ্চকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলতেন না। অবশেষে লঞ্চে চরলাম। লঞ্চে চরতেই মনে পড়লো টিকেট তো কাটা হয়নি। অনেক কষ্টে ওই লঞ্চের একজনের কাছ থেকে দু’টি টিকেট সংগ্রহ করলাম। লঞ্চে আমার মায়ের বান্ধবীর সাথে দেখা। উনি এরকম ভাব করছেন যেন আমাকে চিনেন আবার চিনেনও না। অনেকক্ষণ এভাবে চলে গেলো। সবুজও তার গন্তব্যে থেমে গেলো। এবার আমি ওই আন্টির কাছে সালাম দিয়ে বললাম, “আন্টি কেমন আছেন? আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?”
আমি আমার পরিচয় দেয়ার পর এমনভাবে তাকালেন যেন আমাকে নয়, ভিনগ্রহ থেকে আগত কোন এলিয়েন দেখছেন। ওনার চোখকেও তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি ঠিক দেখছেন কী না! এর পেছনে অবশ্য একটা কারণও আছে। দীর্ঘ নয়মাস ট্রেইনিং করার পর আমিতো আমাকেই চিনতে পারছিলাম না। যদিও প্রতিদিন আয়নার সামনে শেভ করা হতো তারপরও এতো তাড়াতাড়ি করতে হতো যে নিজেকে ভাল করে দেখাও হতো না। তার ওপর খাবার দাবারে আমার নাক সিঁটকানোর অভ্যাস সেই ছোটবেলা থেকেই। ওই আন্টি আমাকে দেখার পরে প্রায় যেন কেঁদেই দিয়েছিলেন। যাইহোক অবশেষে ওই আন্টিও গন্তব্যে থেকে গেলেন। ভদ্রমহিলা নাছোড়বান্দা, আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়েই যাবেন। অনেক বলে কয়ে ওনার হাত থেকে বাঁচা গেল। অবশেষে আমিও আমার গন্তব্যে পৌছলাম।
পাখি যেমন ওড়ে গেলে পালক রেখে যায় আমিও সিলেটে কিছু একটা ফেলে এসেছি। আর তা হল আমার হৃদয়, অামার ভালো লাগা।