মেঘলা আকাশের কালো অন্ধকারটা ক্রমে ঘন হয়ে আসছে। অল্প অল্প হাওয়া বইছে। ছোট্ট শহরটার একেবারে শেষপ্রান্তে পুরোনো বাড়িটা একলা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তীব্র নিস্তব্ধতা চিরে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো বাড়িটার সামনে। ট্যাক্সি থেকে একজন আরোহী নেমে পকেট হাতড়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল। অন্যজন ট্যাক্সির ভেতর থেকে ভারী সুটকেসটা টেনে নামালো। ভাড়া মিটতেই ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে সেই হানাবাড়ি সামনে থেকে পালালো।
হ্যারি আর লুইস দুজনে ছেলেবেলার বন্ধু। বড় হওয়ার পর একসঙ্গেই দুজনে একটা কারখানার কাজে ঢুকেছিল। থাকতও একসঙ্গে, একটা ভাড়া বাড়িতে। কয়েকমাস হল কারখানা লকআউট হওয়ায় দুজনেই এখন বেকার। বাড়িওলা একমাস আগেই নোটিস দিয়েছিল। কিন্তু কম দামে ঘর না পাওয়ায় গতকাল পর্যন্ত মাটি কামড়ে পড়েছিল দুজনেই। আজ সকালে নতুন ভাড়াটে এসে গেছে আর বাড়িওলাও প্রায় গলাধাক্কা দিয়েই বিদায় করেছে তাদের। সারাদিন শহরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত চষে ফেলেও কোন ঘরের ব্যবস্থা না করতে পেরে দুজনেই ঠিক করেছে শহরের প্রান্তে এই হানাবাড়িতেই তারা থাকবে। যাইহোক ভূতে তো আর ভাড়া চাইবে না।
ভাঙ্গাচোরা বিশাল গেট পেরিয়ে চওড়া বাগান। গেটের তালায় মরচে ধরেছে। দরজার সামনে খানিকক্ষণ ইতস্ততঃ করে তালাটা ধরে টান দেয় হ্যারি। জোরে একটু টান দিতেই খুলে চলে আসে। অযত্নে জঙ্গল গজিয়ে ওঠা বাগানের মাঝখান দিয়ে আগাছায় ঢাকা রাস্তাটা বাড়ির দিকে চলে গেছে। দরজার কাছে পৌঁছতেই ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল সেটা। দু’জনেই একসাথে চমকে ওঠে।
‘কী হলো?’ – ভয়ার্ত গলায় লুইস জিজ্ঞাসা করে।
‘কিছু না, বোধহয় বাতাসে খুলে গেছে, চল ভিতরে যাই’ – শুকনো গলাটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে উত্তর দেয় হ্যারি।
দুজনে পা টিপে টিপে খুব সতর্কভাবে ভেতরে ঢোকে। ওদের টর্চের আলোয় মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা বড় বাদুড় উড়ে যায়। অনেকদিনের পুরোনো একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে আসে। কিন্তু আর কিছু অস্বাভাবিক চোখে পড়ে না। হাঁপ ছেড়ে দুজনেই শোয়ার ঘর খুঁজতে থাকে। প্রথমেই বেশ বড়সড় একটা ঘর চোখে পড়ে ওদের। মস্ত বড় একটা খাট ছাড়া ঘরে আর কোন আসবাব নেই। খাটটা পুরোনো হলেও বেশ শক্তপোক্তই আছে।
‘আমি বরং বিছানার বন্দোবস্ত দেখি, বড্ড ক্লান্ত লাগছে’, হ্যারি বলে লুইসকে। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে তার হাত-পা ভেঙ্গে আসছিল। লুইস এক কথাতেই রাজী হয়ে যায়। সুটকেসটা হ্যারির জিম্মায় রেখে সে বাকী বাড়িটার সরেজমিন তদন্তে বেরোয়।
হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয় ঝমঝম করে। খোলা জানলা দিয়ে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় হ্যারির গা শিরশির করে ওঠে। দু’এক ফোঁটা জল গায়ে পড়তে মাথা তুলে হ্যারি দেখে ছাদের বেশ কয়েকটা জায়গায় ফাটল ধরেছে, খাটের ওপরেও টপটপ করে বৃষ্টির জল পড়ছে। খাটের ওপর বিছানা পাতলে সারারাত ভিজতে হবে বরং খাটের তলাতেই শোয়া যাক, বৃষ্টি গায়ে পড়ার কোন সুযোগ থাকবেনা – মনে মনে ভাবে সে। সেকেলে উঁচু পায়ার খাটের নীচে অনেকটাই জায়গা। মেঝেটা পরিস্কার করে নিয়ে সে দুজনের বিছানা পেতে ফেলে। তারপর বালিশে মাথা ঠেকাতেই একেবারে ঘুমিয়ে কাদা।
এদিকে সারা বাড়ি্টায় চক্কর মেরে তেমন কিছু খুঁজে না পেয়ে লুইস সেই ঘরটায় ফিরে আসে। কিন্তু হ্যারি কোথায়? লুইস উদবিগ্ন গলায় হ্যারির নাম ধরে ডাকে – কোন উত্তর নেই। হ্যারির নাম ধরে ডাকতে ডাকতেই আবার এঘর-ওঘর খুঁজে বেড়ায়। প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কেউ উত্তর দেয় না। লুইসের গলা শুকিয়ে আসে – নিশ্চয় হ্যারিকে ভূতে ধরে নিয়ে গেছে, এবারে আমাকে ধরবে। দরজার দিকে প্রাণপনে ছুটতে থাকে সে। একেবারে হানাবাড়ির চত্ত্বর পেরিয়ে বাইরে পৌঁছে হাঁপাতে থাকে। এইরাতে আর কোথায় যাওয়া যায়, তাছাড়া হ্যারির কোন খোঁজ না করেই? নাহ্। বৃষ্টিটাও ইতিমধ্যে থেমে এসেছে। সামনের একটা গাছতলাতেই আশ্রয় নেয় লুইস।
শেষরাতে ঘুম ভেঙে যায় হ্যারির। তখনও সকালের আলো ফোটেনি। পাশ ফিরে লুইসকে খুঁজে না পেয়ে সে বেশ ঘাবড়ে যায়। টর্চটা জ্বালিয়ে এদিক-ওদিক ফেলে, তারপরে জোর গলায় ডাক দেয়। কিন্তু কোন উত্তর পায় না। সাহস করে এবারে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে আসে সে। তারপর এঘর-ওঘর খুঁজতে থাকে। হঠাৎই একটা ঘরে ঢুকতেই দেখে দূরে দেওয়ালের কাছে কে একজন দাঁড়িয়ে একেবারে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শিঁরদাড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। নিশ্চয় এই ভূতটাই লুইসকে ধরে নিয়ে গেছে – হ্যারি আর কোন দিকে না তাকিয়ে দরজার দিকে দৌড় দেয়।
হানাবাড়ির গেট দিয়ে বেরোতেই সামনে গাছের তলায় ঘুমন্ত লুইসকে চোখে পড়ে হ্যারির। নিশ্চয় ভুতটা ওকে মেরে এইখানে রেখে গেছে। তাও সাহস করে শুকনো গলায় সে লুইসের নাম ধরে ডাক দেয়। এক ডাকেই ধড়মড় করে উঠে বসে লুইস। লুইসকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে এক টান মেরে হ্যারি বলে, ‘দৌড়া, ভূত’। লুইসও আর দ্বিরুক্তি না করে ছুটতে শুরু করে।
ক্রমে ভোর হয়ে আসে।…
‘সারারাত কোথায় ছিলি?’ ছুটতে ছুটতেই লুইস এবার প্রশ্ন করে হ্যারিকে। হ্যারির কাছে খাটের তলায় বিছানা করা আর মরার মত ঘুমিয়ে পড়ার কথা শুনে সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। তারপরে হ্যারিকে জিজ্ঞাসা করে, সে যে ভূতটা দেখেছে তার চেহারা ঠিক কেমন? হ্যারির মুখে ভূতের বর্ণনা শুনে হাসতে হাসতে দাঁড়িয়ে যায় লুইস। বাড়িটা ঘুরে দেখার সময়ই একটা ঘরে যে দেওয়াল জোড়া আয়না আছে সেটা ও লক্ষ্য করেছিল। ভূত নয়, আয়নায় নিজেকেই দেখেছে হ্যারি। নিজের ভুল বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে ফেলে হ্যারিও।
হাসতে হাসতেই এবার তারা ফেরার পথ ধরে। ভূতই যখন নেই তখন হানাবাড়ির বাসিন্দা হতে আর ভয় কী?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।