টিয়া কথন

এখন আমি শহুরে হয়ে গেছি। থাকি শাহরের একটি অভিজাত এলাকায়। দোতলা বাড়র নিচিতলায় ঝুল বারান্দায় একটা কালচে রংয়ের ঝোলানো খাঁচায় আমার বাসা। এখান থেকে দিব্যি দুবেলা মানুষজন, ঘর-বাড়ি, কুকুর-বেড়াল, কাক-শালিক আরো কত কি যে দেখা যায়! এক্ষুনি হয়তো মাথায় ঝাঁকা করে কলা বেচা ফেরিওয়ালাটা অদ্ভুৎ ডাক দেবে – “ক-লা-চা-ই, ক-লা—” পরক্ষনে হয়তো লম্বা ঢ্যাঙ্গা লুঙ্গি পরা হাফ হাতা লালচে গেঞ্জি পরা দর্জি কাঁধে তুলো পেঁজার যন্ত্রটার দড়িতে টান দিয়ে “ঘ্যাঁ-ও-ও, ঘ্যাঁ-ও-ও” শব্দ তুলে চলে যাবে পাশের গলিতে। এদিকে রাস্তার উল্টো দিকে “গোপাল ভান্ডার” এ দোকানদার খদ্দের সামলাছে একইভাবে। দোকানের মাথায় ঠান্ডা পানিয়র বিশাল বিজ্ঞাপনের ব্যানার। বিশাল আকৃতির একটি পানিয়র বোতল, গায়ে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ছে। আপনা থেকেই তৃষ্ণা পাবেই। তাকে ছাড়িয়ে একটু দুরে বিশাল ছাতিম গাছের ছাওয়ায় দুটো রিক্সা পা ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছে।

তক্ষুনি স্কুল ফেরত ইচ্ছামতী দু’দিকে বিনুনী দুলিয়ে নীলচে স্কুল ফ্রক উড়িয়ে মায়ের হাত ছেড়ে আমার খাঁচার নিচে এসে লাফাতে লাফাতে চ্যাঁচায় ” এই টিঁয়া – টিঁয়া – তুই ঘুমোচ্ছিস – টিঁয়া?!” ওর লাফানো দেখে আমায় খেলায় পেয়ে বসে। আমিও ডানা ঝাপটে চ্যাঁচাতে থাকি – “মঁতি – মঁতি!” ইচ্ছামতী বড্ড বড় নাম, তাই ছোট করে আদর করে বলি – “মঁতি”। ও এবার মাষ্টারি করতে শুরু করে, কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বিজ্ঞের মতো জিজ্ঞেস করে – “বল প্যারট”। আমি গলার স্বর গম্ভির করে বলি-“প্যাঁর-র-ট”। ও অনুষাশন করে বলে – “মানে বল ?” আমি আবারও বলি-“প্যাঁর-র-ট”। ও অনুযোগের সুরে বলে – “এর মধ্যেই ভুলে গেলি ? কাল যে তোকে শেখালাম!” আমি মজা করে ঘাড় বেঁকিয়ে গায়ের পালকগুলো ফুলিয়ে আবার বললাম – “প্যাঁর-র-ট”। ওতো হেসে কুটোপাটি!

মা পেছন থেকে ইচ্ছামতীকে টেনে ঘরে নিয়ে যায়। ও কিছুতেই যেতে চাইছেনা। আর একটু আমার সঙ্গে খেলতে চায়। মা ওকে বকুনি দিতে দিতে ঘরে টেনে নিয়ে যায়। বলে – ” চলো, চলো জামা কাপড় ছেড়ে চান করে ঘুমোবে। বিকেলে টিচার আসবে। হোম টাস্ক — ওঃ বড্ড অবাধ্য!” ও হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে মার সঙ্গে ঘরে যায়। আমার ভালো লাগে না। এখন শুধু শুধু বসে থাকা ছাড়া কোন কিছু করার নেই।

ঝিমুনি ধরা দুপুরের রোদটা শহরের এই গলিটাকে আরো বেশি করে তন্দ্রাছন্ন করে তুলছে। রাস্তা প্রায় ফাঁকা, মাঝে মধ্যে দু’একটা গাড়ি বা বাইকের আওয়জে তন্দ্রায় ছেদ পড়ছে বইকি ! এদিকে চারদিকে তখন উঁচু নিচু বাক্সঘর থেকে ভেসে আসছে টিভি সিরিয়ালের দাপাদাপি ও দামামা। আমার ঝিমুনি আসে। চোখ বন্ধ করে ঘাড় গুঁজে বসে রইলাম।

চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই বন-বাদাড়ে ভরা নোনা নদীর চর। চরের বাঁক ছাড়িয়ে নদীটা এঁকে বেঁকে মিশেছে দু’র দিকচক্রাবালে। দিন দুবেলা জোয়ার ভাটা খেলা করে যায় এই চরের জঙ্গলে। আর চরের এপারে মোটা নদী বাঁধ পেরিয়ে মাঠ ভরা সোনালী আদিগন্ত ধানের ক্ষেত। মাঝে মধ্যে সবুজ আলবাঁধগুলো সোনালী ক্যানভাসে আঁকিবুকি কেটে মায়াবী রুপরেখা তৈরী করেছে। আরো দূরে গাছ-গাছালির দিগন্ত রেখায় দু’একটা পাংশুটে খড়ের ঘর বা কালচে লাল রঙের টালির ছাউনি মাটির ঘর। পেছন থেকে হয়তোবা কোন তাল-নারকেল তেড়ে ফুড়ে উঠে গেছে শুধু নীল দীগন্তে ভেসে থাকা কোন মেঘের ডানা ছুঁতে।

চরের জঙ্গলে একটা বুড়ো নধর বানী গাছের কোটরে আমাদের বাসা। আমরা তিন ভাইবোনে একসঙ্গে গায়ে গায়ে, গাদা-গাদি হয়ে বসে থাকি। আমরা একে অপরে ধাক্কা-ধাক্কি করে কোটর থেকে মুখ বের করে বাইরের জগতটা দেখে নেই। একজনের দেখা হয়ে গেলে তাকে সরিয়ে অন্যজন। বেশ লাগে নদীর চর, ধানক্ষেত, আকাশ-মেঘ আর অপেক্ষা করি মা কখন ফিরবে ! নয়তো সময় কাটাতে পাশের ঝোপের বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে ক্যাচর ম্যাচর করে গল্প জমাই। গল্পের কোন ঠিক ঠকানা নেই। মায়ের কাছে শোনা কোন রাক্ষস-খোক্ষসের বা কোন রুপকথার গল্প নয়তো ধাঁধাঁ অথবা মজার চুটকি।

তক্ষুনি মা মুখে করে খাবার নিয়ে উড়ে এসে গর্তের মুখে ধরে। আমরা মহানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের মুখ থেকে খাবারের টুকরোগুলো ছিঁড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলি এক নিমেষে। মা এবার শাষন করে বলে – ” তোমরা বড্ড দুষ্টু হয়েছ, কতবার না বলেছি গর্ত থেকে বের হবে না … এখনো ভালো করে উড়তে শিখলে না। কাল থেকে আমার সঙ্গে ওড়া প্র্যাক্টিস করবে। শত্রুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবে কি করে ?!

বিকেলে হঠাৎ গাছটায় প্রবল ঝাঁকুনি সঙ্গে ঠক-ঠক করে বিকট শব্দ, যেন সমস্ত পৃথিবীটা দুলে উঠছে – একবার নয় দুবার নয় বার বার ! মূখ বাড়িয়ে গর্ত থেকে মুখ বাড়িয়ে যেইনা দেখবার চেষ্টা করেছি, দেখি কি কালো মতো একটা লোক গাছটায় চড়ে বসে আছে, হাতে জাল ! সর্ব্বনাশ – এটাতো শিকারী ! আমরা তিনজন কোটরের একেবারে ভিতরে ডুকে বসে রইলাম। বুক দুরু দুরু, ভয়ে কাঁপছি। কান্না পাচ্ছে ভিষন কিন্তু মাকে ডাকতে পারছ না। এমন সময় কোটরের মুখ বন্ধ হয়ে গেল, এখন শুধু অন্ধকার।

দম বন্ধ হয়ে আসছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, ভিষন কষ্ট, পারছিনা… নিজেদের বাঁচাতে কপাল ঠুকে কোটরের মুখ থেকে বেরোবার জন্য শত চেষ্টা করছি অমনি দুটো কালো হাত এসে আমাদের জালে জড়িয়ে ফেলল। আমরা প্রাণপনে চ্যাঁচিয়ে প্রতিবাদ করছি কিন্তু লাভ কোন লাভ হচ্ছে না। আত্মরক্ষার জন্য আমাদের লাল ঠোঁট দিয়ে লোকটার কালো হাতে আচ্ছা করে কামড় বসাই। হাত দুটো ক্ষনিকের জন্য সরে গেলেও পরক্ষনে আবার পেছন থেকে ডানাদুটো জাপটে ধরে একটা খাঁচার মধ্যে চালান করে দিল। আমারা তখন সমানে কঁদে কাঁদে অনুরোধ করছি – ” ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, আমদের ভিষণ লাগছে, কি অপরাধে আমাদের ধরে বাঁধে নিয়ে যাচ্ছ ?”

মা তক্ষুনি আকাশ চিরে চিৎকার করে উড়ে এসে গাছের উপরে চক্কর দিচ্ছে। মা প্রতিবাদ করছে – “এই বদমানুষটা, আমার বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, কি ক্ষতি করেছে ওইটুকুনি কচি বাচ্চগুলো ? ভালো হবে না কিন্তু… ছেড়ে দে বলছি…” মায়ের সঙ্গে আমরাও সমানে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করছি, অমনি আমাদের পাশের প্রতিবেশিরাও জঙ্গলের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে চক্কর দিতে দিতে তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। মুহুর্তে জঙ্গলে যেন আলোড়ন উঠল। মাকে আমরা কাঁদতে কাঁদতে বলছি – “আমাদের বাঁচাও মা, আমাদের বাঁচাও…” মা তীব্র গতিতে সোজা উড়ে এসে লোকটার মাথায় একটা টক্কর দিল, লোকটা হাত দিয়ে ‘হুস-হুস’ করে মাকে তাড়াতে থাকল। তারপর খাঁচার মুখটা ভালো করে বন্ধ করে বাঁকের পেছনে খাঁচাটা ঝুলিয় দিল। এবার মা হাঁউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করছে – “হেই মানুষ, ওদের ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। তোমরা শক্তিধর, বুদ্ধিমান, আমরা ক্ষুদ্র-ক্ষীণ, তাই বলে আমাদের এভাবে ধরে বাঁধে বিনা দোষে খাঁচার জেলে পচিয়ে মারবে ! কেন – কেন ?”

পাষন্ড লোকটা তখন নির্বিকার নির্লিপ্তভাবে আমাদের বাঁকে ঝুলিয়ে সোনালী ক্ষেতের মাঝের সবুজ আলবাঁধ ধরে এগিয়ে চলে। আমরা ডানা ঝাপটে ঝাপটে ক্লান্ত হয়ে ফ্যাঁস-ফ্যাঁসে গলায় অনুরোধ করে যাচ্ছি – “ছেড়ে দাও – ছেড়ে দাওনাগো আমাদের…” মা তখনো আকাশে চক্কর দিতে দিতে আকাশ ফাটা চিৎকার মিনতি করছে – “দয়া করো – দয়া করো তুমি, আমার সোনার ধন বাচ্চাগুলকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও…”

তারপর সন্ধ্যে নেমে এসেছিল সেই সনালী ক্ষেতে। মা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আর কোনোদিন মায়ের ডাক শুনতে পাই না। মায়ের অনুষনও এখন শুনতে পাই না। মায়ের মুখের খাবার স্বাদ আর পাই না। এখন আমি একা একা খেতে শিখে গেছি। আমি একা একাই কথা বলি। আমারতো আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। মায়ের জন্য আমার ভিষন কষ্ট হয় – ভিষন। কান্না পায়। কোঁকিয়ে কেঁদে উঠি। ডানা ঝাপটে খাঁচার মধ্যে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি – ” মা-মা-মা, মা-মা-মা”

দুফুরের অলস ঘুম জড়ানো চোখে ইচ্ছামতীর মা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। দরজার আওয়াজে আমিও সম্বিৎ ফিরে পাই। উনি দরজায় দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে আমাকে জিজ্ঞেস করেন – ” কি হয়ছে ? ডাকছিস কেন ? ক্ষিদে পায়েছে ? আচ্ছা দাঁড়া দিচ্ছি” বলেই ঘরে ফিরে যায়। আমি ডানা ঝাপটে ভিষন চিৎকার করি – ” আমাকে ছেড়ে দাও, মুক্তি দাও, এক্ষুনি এক আকাশ পাড়ি দিয়ে আমি আমার মায়ের কাছে চলে যাই।”

আমার কান্নার বাঁধ মানছে না, সব শক্তি সঞ্চয় করে তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছি – “মা-মা-মা…”

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!