কিছুমিছু

বড় ভাই হরি শ্বশুরবাড়ি যায়। সেখানে কত খাতির-আদর। এটা-ওটা খাইয়া আসিয়া

নানারকম গাল-গল্প করে।ছোট ভাই নেপাল শুনিয়া মুখ কাঁচুমাচু করে।তার তো বিবাহ হয় নাই।কে তাহাকে খাতির-যত্ন করিবে।

সে দিন নেপাল যাইয়া বড় ভাই হরিকে বলিল, “দাদা, প্রতিবার পূজাই তুমি শ্বশুর বাড়ি যাও। কত কি খাইয়া আস,

এবার তোমার বদলে আমি যাব!” বড় ভাই বলিল, আচ্ছা আমি এবার যাব না।তুই-ই আমার শ্বশুর বাড়ি বেড়াইয়া আসিস।শুনিয়া ছোট ভাই ভারি খুশি।

যাইবার সময় মা বলিল দিল। “ দেখ তুই তো তোর দাদার শ্বশুর-বাড়ি যাবি।শেখানে বউমা আছে। খালিহাতে কেমন করিয়া যাবি।

এই পাঁচটা টাকা নে। একটা কিছুমিছু কিনিয়া নিস।”

মা মনে করিয়াছিল, ছেলে বাজার হইতে কোন কিছু লইয়া যাবে। সন্দেশ, রসগোল্লা বা অন্য কিছু।কিন্তু নেপাল ভাবিল, কিছুমিছু না জানি কি একটা নতুন জিনিস, বাজার হইতে কিনিয়া লইতে হইবে। সে বাজারে যাইয়া এ দোকানে যায় সে দোকানে যায়।

মনোহরির দোকানে কত রঙ-বেরঙের জিনিস সাজানো রহিয়াছে। সে যাইয়া দোকানিকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার কাছে কি কিছুমিছু আছে?”দোকানি বুঝিতে পারেনা। কিছুমিছু কি। তাই উত্তর করে“না, নাই।”

মনোহরির দোকান ছাড়িয়া সে মিষ্টির দোকানে যায়,হাঁড়ি পাতিলের দোকানে যাই,

চাল-ডালের দোকানে যায়।“তোমাদের কাছে কিছুমিছু আছে? তোমরা আমাকে পাঁচ টাকার কিছুমিছু দাও।”

“এমন বোকা তো কোথাও দেখি নাই। কিছুমিছু আবার দোকানে বিক্রি হয়?” তাহারা কেহ তাহার গায়ে ধুলি ছিটাইয়া দিল।

কেহ তাহার মাথায় কেরোসিন তেল মালিশ করিতে আসিল, কেহ তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিল। মনের দুঃখে সে খালি হাতেই ভাই-এর শ্বশুর বাড়ি রওয়ানা হইল।

পথে যাইয়ে যাইতে দেখা হইল এক পুরুত ঠাকুরের সঙ্গে।তিনি গামছায় কিছু ধান-দূর্বা, তুলসী পাতা, বেল পাতা, আর শাক-সিন্দুর বাঁধিয়া চলিয়াছেন যজমান বাড়িতে শ্রাদ্ধের কাজ করিতেছে ।

চুপ করিয়া পথ চলিতে হয়রান হইতে হয়।ঠাকুর মহাশয়ের সঙ্গে গল্প করিয়া পথ চলিলে পথের কষ্ট মনে পড়িবে না। সে ঠাকুর মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “ ঠাকুর মহাশয় গামছায় বাঁধিয়া কি লইয়া যাইতেছেন? “ ঠাকুর উত্তর দিলেন ,“কিছুমিছু লইয়া যাইতেছি।”

ছোট ভাই ভাবিল, এবার তবে সে কিছু মিছুর খোজ পাইয়াছে! সে ঠাকুর মশাইয়ের পায়ের ধুলি মাথায় লইয়া বলিল, আপনি দয়া করিয়া আমাকে এই কিছুমিছু দান করিয়া যান।”ঠাকুর মহাশয় উত্তর করিলেন, তাঁহা কেমন করিয়া হইবে, এগুলি তো আমার কাজে লাগিবে।

ছোট ভাই তখন আরো অনুনয়-বিনয় করিয়া বলিল, “এই পাঁচটি টাকা লন, কিছুমিছু আমাকে দিতেই হবে।

পুরুত ঠাকুর ভাবিলেন, যজমান বাড়িতে পূজা করিয়া বড়যোর পাঁচ আনা পাইব! আর এই ছেলেটি পাঁচ টাকা সাধিতেছে! গামছায় বাঁধাফুল, বেলপাতা তো যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়।

পথ হইতে তুলিয়া লইলেই হইবে।কিন্তু গামছায় কি বাঁধা আছে এই বোকা ছেলেটি যদি বুঝতে পারে, তবে আর তাকা দিবে না।

তাই প্রকাশ্যে তাহাকে বলিবে,এগুলি আমার দরকার ছিল, কিন্তু তুমি যখন এমন করিয়া বলিতেছে তোমাকে বেজার করিতে চাহি না।

এই গামছা ধরিয়া কিছুমিছু লইয়া যাও। পথে কোথাও খুলিও না।বাড়িতে লইয়া গিয়া তুলসী তলায় রাখিয়া দিও।”

মনের সুখে সেই গামছা সমেত ফুল বেলপাতা লইয়া ছোট ভাই খুব তাড়াতাড়ি পথ চলিতে লাগিল।

বড় ভাই-এর স্বশুরবাড়িতে আসিয়া সে পুটলিটি তুলসী তলায় রাখিয়া চুপটি করিয়া বসিয়া রহিল। তার ভাইয়ের বউ একাজে,সে- কাজে এদিকে আসিয়া দেখিল, দেবর তুলশী গাছের তলায় বসিয়া আছে।

“ওকি! তুমি এখানে বসিয়া আছ কেন? বাড়িতে সকলে কেমন আছে?” মাঐআসিয়া জিজ্ঞাসা করিল,“এই যে পুত্তা যে,তোমার দাদার তো আসার কথা ছিল। তা সে আসিল না কেন?”

ছোট ভাই তো দাদা কে অনেক অনুরোধ- উপরোধ করিয়া তাহার বদলে কুটুম্ব বাড়িতে আসিয়াছে।কিন্তু সে কথা তো বলা যায় না।

সে কোন উত্তর না করিয়া তুলশী তলায় রাখা সেই পুটলিটি দেখাইয়া দিল।

পুটলিটি খুলিয়া শাশুড়ি ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল। হায়!হায়!তার জামাই তো মরিয়া গেছে।তাই তো পুত্তা ফুল-বেলপাতা আর   শাঁক-সিন্দুর লইয়া সেই খবর ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি দিতে আসিয়াছে।

মায়ের কান্না দেখিয়া মেয়েও আছাড়ি-পিছাড়ি কাঁদিয়া লাগিল।তার পর পাড়া-প্রতিবেশি, আত্নীয়-পরিজন সকলে মিলিয়া কান্না জুড়িয়া দিল। কেহ তলাইয়া দেখিল না কি হইয়াছে।

ছোটভাই আসিয়াছিল দাদার শ্বশুর বাড়িতে এটা-ওটা খাইতে, সে খাওয়ার কপালে ছাই।সকলে মিলিয়া কান্না জুড়িয়াছে। অনেক্ষণ বসিয়া থাকিয়া সে বাড়ি ফিরিয়া আসিল।

বাড়ি আসিলে মা জিজ্ঞাসা করে, বড় ভাই আসিয়া জিজ্ঞাসা করে,-“ সেখানে গেলি আর ফিরিয়া আসিলি, তারা সব ভাল আছে তো?”

ছোট ভাই বলিল, সে বাড়িতে মানুষ মরিয়াছে।তাড়া সব কান্নাকাটি করিতেছে।তাই দেখিয়া আমি চলিয়া আসিয়াছি।”

“কে মরিয়াছে?”জিজ্ঞাসা করিতে ছোট ভাই বলিল,“তা আমি কি করিয়া বলিব? আমাকে দেখিয়া সকলে কাঁদিয়া উঠিল। তাই আমি বাড়ি চলিয়া আসিলাম।”

বড় ভাই ভাবিল, নিশ্চয়ই তার বউ মরিয়াছে। তাই ভাই কে দেখিয়া সবাই কাঁদিয়া উঠিয়াছে। সে তখন কাঁদিতে কাঁদিতে শ্বশুর-বাড়িছুটিল।

শাশুড়ি ও বউ তাহাকে দেখিয়া ঘিরিয়া ধরিল,“আমরা তো জানিতাম তুমি মরিয়া গিয়াছ!”

বড় ভাই বউ কে বলিল,“আমিও তো ভাবিয়াছিলাম তুমি মরিয়া গিয়াছ!”তখন সকলে বোকা-ভাইয়ের কান্ড দেখিয়া অবাক হইল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!