মানতুর যাদু ছক্কা

মানতু এক বছর বারো-তেরোর ছেলে। ছোটবেলায়ই সে মা-বাবাকে হারিয়েছে, কাকা-কাকীমার কাছে মানুষ। কাকার দিলটা ছিলো দরাজ, কিন্তু আর্থিক সামর্থ্য ছিলো সীমিত। তার মধ্যেই তিনি মানতুর যতটা সম্ভব দেখভাল করতেন। নিজের ছেলেমেয়েদের সাথে স্কুলে পাঠিয়ে তাকে লেখাপড়া শেখাতেন।
মানতু খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করতো। তবে তার ঝোঁক ছিলো আঁকাজোকা আর গানবাজনার দিকে। সে স্বপ্ন দেখতো, বড় হয়ে একদিন নামী চিত্রশিল্পী বা গায়ক হবে।
সেদিন রাতে সে একটি গল্পের বই শেষ করে সবে বিছানায় শুতে গিয়েছে। কোনো কারণে ঘুম আসতে চাইছে না, এমন সময় কানে এলো পাশের ঘরে কাকা-কাকীমার কথোপকথন। তাঁরা গলা নামিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বিষয়ে আলোচনা করছেন। সব কথা শোনা যায় না, তবু তার থেকেই বুদ্ধিমান মানতু বুঝে নিলো যে তাঁর এই আশ্রয়দাতা দু’জন গভীর আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন। কিছুতেই তাঁরা আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য করে উঠতে পারছেন না। তবু এই উদার হৃদয় মানুষ দু’টি সেকথা মানতুর কাছে ঘুণাক্ষরে প্রকাশ করেননি। সে ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবেই এখন এ বিষয়ে আলোচনা করছেন।
“আমি যদি কিছু রোজগার করে ওঁদের সমস্যার একটু সুরাহা করতে পারতাম!” এই কথা ভাবতে ভাবতে মানতু একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। কতক্ষণ পর কে জানে, কার ডাকে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেলো। এক মহিলা মিষ্টিস্বরে ফিসফিসিয়ে বলছেন, “মানতু, তোমার দুঃখ আমার বুকে বেজেছে। আমি তোমায় সাহায্য করতে চাই।”
মানতু ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। বললো, “আপনি কোথায়? আপনাকে যে দেখতে পাচ্ছি না।”
“আমাদের দেখা যায় না মানতু, শুধু শোনা যায়।” মহিলা আবার বললেন।
অতি কষ্টে উত্তেজনা দমন করে মানতু বললো, “আপনি কি কোনো দেবী, আমায় বর দেবেন?”
“ঠিক তা নয়। আসলে আমি এক ভিনগ্রহের অধিবাসী। আমি তোমায় একটা যাদু ছক্কা দিয়ে যাচ্ছি, যার সাহায্য নিয়ে তুমি তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে।”
“এটা কি তবে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো কোনো জিনিস?” মানতু কিন্তু-কিন্তু করে বলে।
“অনেকটা, তবে একটু তফাত আছে।” মহিলা বলেন, “ইচ্ছেপূরণের জন্য তোমাকে দুটো শর্ত মানতে হবে।”
“কী সেই শর্ত?”
“প্রথমতঃ, তুমি কারো অনিষ্ট চাইবে না।”
“আমি কখনো কারো অনিষ্ট চাই না।”
“জানি, আমরা মন পড়তে পারি।” না দেখা স্বরে এবার একটু হাসির ছোঁয়া, “তোমার মনটা ভালো দেখেই আমরা এই ছক্কা তোমায় দিচ্ছি। তবে ক্ষমতা হাতে পেলে মানুষ বদলে যায়, তাই সাবধান করে দিচ্ছি – তুমি যদি এই ছক্কার কাছে কারো অনিষ্ট চাও তো তোমার নিজেরই অনিষ্ট হবে।”
“আমি যদি তেমন কিছু চাই তবে সেটাই আমার উচিত শাস্তি হবে। এবার বলুন, দ্বিতীয় শর্তটা?”
না দেখা কণ্ঠস্বরে এবার দৃঢ়তার ছোঁয়া, “আমরা অলস, অপদার্থদের সাহায্য করি না। ইচ্ছেপূরণের জন্য তোমাকে আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করতে হবে, তবেই এই যাদু ছক্কা তোমায় উদ্দেশ্য পূরণে সাহায্য করবে। চলবে?”
“সে আর বলতে!” মানতু বিনা দ্বিধায় বললো, “পরিশ্রমে আমি কখনো পিছপা নই। শুধু আমি চাই তার ফলে যেন আমার আর আমার প্রিয়জনেদের উপকার হয়।”
“সেই জন্যেই এই যাদু ছক্কা। তুমি এটা হাতে ধরে মনে মনে আন্তরিকভাবে কিছু চাইবে, আর সাথে সাথে কোমর বেঁধে লক্ষ্যপূরণের জন্য কাজে নেমে পড়বে। তাহলেই তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে।”
“তাই হবে। কিন্তু – কোন কারণে যদি আমি ছক্কার কাছে যা চাইলাম তার জন্যে কোনো চেষ্টা না করি?”
“তবুও তোমার সেই মনস্কামনা পূর্ণ হবে।” কণ্ঠস্বরে এবার যেন একটু বিষণ্ণতার ছাপ, “কিন্তু সেই শেষবার। তারপর এই যাদু ছক্কা আবার আমাদের কাছে ফিরে আসবে।”

হঠাৎ যেন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেলো আর মানতু ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো। ওঃ, তাহলে স্বপ্ন!
কিন্তু তার শিয়রের কাছে ওটা কী জ্বলজ্বল করছে? মানতু আলো জ্বাললো, সাথে সাথে চোখে পড়লো সেখানে একটা লুডোর ছক্কার মতো জিনিস। তার ওপরে অবশ্য ছক্কার মতো এক-দুই ইত্যাদি ফোঁটার বদলে আছে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন। আলো জ্বালাবার পর এখন জিনিসটিকে নিস্প্রভ দেখাচ্ছে। মানতু সেটাকে হাতে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিতেই জ্বলজ্বলে ভাবটা আবার ফিরে এলো। অনিশ্চিত মন নিয়ে মানতু বালিশে মাথা দিলো, একটু পর ঘুমিয়েও পড়লো।

ভোর হয়েছে। রাতের মায়াবী পর্দা সরে গেছে। মানতু চোখ খুলে দেখলো, সেই ছক্কাটা হাতের কাছেই রয়েছে। সে খোলামনে ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করলো। কাল রাতে যা শুনেছে তা কি স্বপ্ন, না সত্যি? এ জিনিসটির কি সত্যিই কোনো যাদু ক্ষমতা আছে, নাকি কোনো আজেবাজে জিনিস কেউ ফেলে রেখে গেছে?
“কিন্তু আমি ব্যাপারটা সত্যি বলে বিশ্বাস করলেই বা ক্ষতি কী?” মানতু শেষ অবধি সিদ্ধান্তে এলো, “উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পরিশ্রম করলে তো খারাপ কিছু হতে পারে না। আর এই মুহূর্তে কিছু টাকা রোজগার করে কাকা-কাকীমাকে সাহায্য করার চেয়ে বড় উদ্দেশ্য আমার আর কী হতে পারে?”
এই কথা ভেবে ছক্কাটাকে হাতে ধরে সে একটু অন্যমনস্কভাবে পথ চলছে। এমন সময় দেখলো একটা ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছে। ভালো করে তাকিয়ে বুঝলো, ঘোড়াটি ক্ষেপে গিয়ে বেপরোয়া লাফঝাঁপ করছে আর পিঠে তার সওয়ার পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হবার ভয়ে সিঁটিয়ে কোনমতে লাগাম ধরে ঝুলে আছে।
কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই মানতু সেই ছুটন্ত ঝড়ের সামনে লাফিয়ে পড়লো। তাকে দেখে জন্তুটার গতি যেন এক মুহূর্তের দ্বিধায় জড়িয়ে গেলো। সেটুকু সুযোগকে কাজে লাগিয়েই আরোহী আপ্রাণ চেষ্টার পর ঘোড়াটিকে আবার আয়ত্তে নিয়ে এলো। মানতু ওর পিঠে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিলে লাগলো। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেলো জন্তুটা।
“বাহাদুর ছেলে!” ঘোড়ার সওয়ার মানতুর পিঠ চাপড়ে বললেন, “নিজের জীবন বিপন্ন করে তুমি আমাকে গুরুতর দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করেছো। এবার বলো, আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি?”
কিছুক্ষণ দ্বিধা-সঙ্কোচের পর মানতু অবশেষে বলতে পারলো যে তার কিছু অর্থ উপার্জন করা খুব দরকার আর তার জন্য সে কিছু খুচরো কাজ খুঁজছে।
“কিন্তু তোমার তো এখনো কাজ করার মতো বয়েস হয়নি।” আরোহী বললেন, “তবে আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি আর এ ব্যাপারে তুমি ঠিক লোকের কাছেই সাহায্য চেয়েছো। আমি একটা যাত্রাদলের মালিক। আমরা কয়েক দিন আগে যাত্রার পালা করবার জন্যে এই শহরে এসেছি আর অন্ততঃ মাসখানেক এখানেই থাকবো। এই ঘোড়াটাও কিছুক্ষণের জন্য যাত্রায় নামবে, তাই ওকে তালিম দেওয়া দরকার। সেই জন্যে আজ সহিসকে ছুটি দিয়ে আমি ওকে নিয়ে পড়েছিলাম। ঘোড়াটা শিক্ষিত, কিন্তু কী যেন দেখে ক্ষেপে উঠেছিলো। বড় বিপদ হতো, যদি তুমি এসে না পড়তে।
“তা, আমি খুচরো ফাই-ফরমাস খাটার জন্য একজন বিশ্বাসী ছেলে খুঁজছিলাম। তুমি চাইলে এখন থেকে সে কাজ তুমিই করবে। স্টেশনের কাছের ময়দানে আমাদের তাঁবু পড়েছে। আজ বিকেলে তাহলে সেখানে গিয়ে আমার সাথে দেখা ক’রো।”
যাত্রার মালিক ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে গেলেন আর মানতু উৎসাহে ফুটতে লাগলো। ছক্কাটি পাওয়ার পর সবে কয়েক ঘণ্টা কেটেছে, এর মধ্যেই তার প্রথম ইচ্ছেটা সফল হতে চলেছে!

সেদিন সন্ধ্যেয় মানতু যাত্রার মালিক দত্তবাবুর সাথে যাত্রার তাঁবুতে গিয়ে দেখা করলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কাকা শেষ অবধি তাকে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। দেখা গেলো মালিক হিসেবে দত্তবাবু খুবই দয়ালু। তিনি মানতুকে হালকা কাজই দিতেন। তবে তাকে খুব বিশ্বাস করতেন দেখে প্রায়ই টাকা লেনদেনের মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তার হাতে ছাড়তে দ্বিধা করতেন না।
মানতুর অবশ্য সবচেয়ে ভালো লাগতো রাঘবের কাজে সাহায্য করতে। রাঘব যাত্রার দৃশ্যপট আঁকতো। মানতু তার ফাই-ফরমাস খাটতো আর সুযোগ পেলেই বসে বসে তার আঁকা লক্ষ করতো। দুঃখের বিষয়, রাঘব মানতুর প্রতি মোটেই সদয় ছিলো না। ছুতোয়-নাতায় সে মানতুকে হেনস্থা করতো। তার দুর্ব্যবহার অবশ্য মানতু গায়ে মাখতো না। সে দৃশ্যপটগুলির দিকে তাকিয়ে ভাবতো, কবে সে-ও অমন আঁকতে পারবে।
একদিন দুপুরে রাঘব খেতে গেছে আর মানতুকে বসিয়ে রেখে গেছে তার আদ্ধেক আঁকা একটা ছবির সামনে। দেখতে দেখতে মানতু ভাবছে, “আহা রে, আমি যদি এমন করে ছবি আঁকার সুযোগ পেতাম তো দেখিয়ে দিতাম আমিও কেমন পারি।” ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার গা কেমন শিরশির করে উঠলো। ঝট করে তাকিয়ে দেখে, নিজের অজান্তেই সে যাদু ছক্কাটা কখন হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছে।
হঠাৎ মনে হলো কে যেন তাকে বলছে – সুযোগ কেউ দেয় না মানতু, সুযোগ তৈরি করে নিতে হয়। চমকে এদিক-ওদিক তাকায় মানতু – কই, কেউ তো নেই! এবার সে ভালো করে দৃশ্যপটের দিকে মন দেয়। একটা পাহাড়, তার ওপরে আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ। আর পাহাড়ের গা বেয়ে সামনে এসে পড়েছে এক বহতা নদী। চমৎকার!
তবে নদীর জলে যেন ঠিক স্রোতের উদ্দামতা নেই। কী মনে হয়, রং-তুলি হাতে তুলে নেয় মানতু। তারপর ধীরে ধীরে নদীর বুকে আলতো তুলির টানে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টা করতে থাকে। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানে না, হঠাৎ এক ক্রুদ্ধ গর্জনে তার সম্বিত ফেরে। ঝট করে পেছন ফিরে দেখে, রাঘব দাঁড়িয়ে। রাগে তার চোখমুখ টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।
“হতচ্ছাড়া ছোঁড়া, আমার ছবিটার বারোটা বাজিয়ে দিলি! তোকে আজ দেখাচ্ছি!” বলে রাঘব ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে যায়। একটু পরই সে মালিক দত্তবাবুকে টানতে টানতে সেখানে নিয়ে আসে। অবাক দত্তবাবু ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছেন, এমন সময় হুড়মুড় করে সেখানে ঢোকে কয়েকজন পুলিশ কনেস্টবল আর একজন ইনস্পেক্টর। তাদের দেখে রাঘব দৌড়ে পালাতে যায়, কিন্তু তার আগেই কনেস্টবলদের শক্ত বাহুবন্ধনে সে ধরা পড়ে গেছে।
জানা গেলো, লোকটা একজন কুখ্যাত অপরাধী আর এখানে এসে গা ঢাকা দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। সুযোগ পেলেই মালিককে ফাঁক করে সে আবার লম্বা দিতো। সময়মতো খবর পেয়ে পুলিশ এসে পড়ায় বেঁচে গেলেন দত্তবাবু।
“তবুও তো আমার বারোটা বাজলো!” কপাল চাপড়ে বললেন দত্তবাবু, “এই ছবিটা এখন শেষ করবে কে? আজ সন্ধ্যের পালার জন্যে যে এটা আমার চাই।” তারপর তিনি ছবিটার দিকে ফিরে তাকালেন আর দেখতে দেখতে তার মুখে ফুটে উঠলো অবাক বিস্ময়ের ছাপ।
“ওই নদীর জলের ভেতরকার কারুকার্যটা কে করেছে?” তিনি নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
“আজ্ঞে, আমি”, কুণ্ঠিত মানতু উত্তর দিলো।
“অসাধারণ!” দত্তবাবু প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন আর পরমুহূর্তেই বিস্মিত মানতুকে বুকে টেনে নিলেন। বলা বাহুল্য, মানতুই এরপর ছবিটা শেষ করলো আর সেটা সবার উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও অর্জন করলো।
এভাবে মানতুর আর একটি মনোবাসনাও পূর্ণ হলো – তার গোপন শিল্পীপ্রতিভা স্বীকৃতি পেলো। মানতুর কাকার সম্মতি নিয়ে দত্তবাবু তাকে যাত্রাদলের প্রধান চিত্রশিল্পী হিসেবে নিয়োগ করলেন। অবশ্য মালিকের সদয় সহযোগিতায় সে লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে লাগলো।

ছবি আঁকা ছাড়া যা মানতুর মন টানতো তা হচ্ছে গান। যাত্রা চলার সময় যখন পেছনে প্লে-ব্যাকে গান চালানো হতো, তার সাথে সাথে মানতু গুনগুনিয়ে গলা মেলাতো। বলাই বাহুল্য তার গলা নয়, রেকর্ডের গানই সাউণ্ড চ্যানেলে শোনা যেতো। “ইস, আমিও যদি প্লে-ব্যাক গায়ক হতে পারতাম!” সে প্রায়ই ভাবতো।
কিন্তু একদিন একটা ‘গোলমাল’ হয়ে গেলো। যাত্রাদলের এক টেকনিশিয়ান মানতুর এই গুনগুনিয়ে গান গাওয়ার অভ্যেস লক্ষ করে তার সাথে এক নিষ্ঠুর তামাসার পরিকল্পনা করলো। একদিন সে সবার অলক্ষ্যে সাউণ্ড চ্যানেলে সিডি প্লেয়ারের বদলে গ্রীনরুমের মাইক্রোফোন জুড়ে দিলো। ফলে অভিনেতা যখন ‘লিপ’ দিচ্ছিলো, কয়েক সেকেণ্ড চারদিক নিঃশব্দ। কিন্তু তারপরই মাইকে বেজে উঠলো এক কচি, কিন্তু সতেজ ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর – মানতুর অজান্তে তার খালি গলার গান!
যে তামাসা করতে চেয়েছিলো, তার উদ্দেশ্য ছিলো মানতু এভাবে সবার সামনে অপদস্থ হবে। কিন্তু কিছুক্ষণ অবাক হয়ে থাকার পর দর্শকরা যখন বুঝতে পারলো কোনো কিশোর শিল্পী ‘লাইভ’ গাইছে, সহর্ষ করতালিতে তারা এই নবীন প্রতিভাকে স্বাগত জানালো। গ্রীনরুমে তখনও ভ্যাবাচাকা ভাব কাটেনি। যখন আসল ব্যাপারটা ধরা পড়লো, ততক্ষণে মানতু স্টেজ মাত করে দিয়েছে।
হিংসুটে টেকনিশিয়ানটির কপালে জুটলো বিস্তর বকাঝকা। মালিক তাকে সতর্ক করে দিলেন যে আবার অমন করলে তাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। এবার যাত্রাদলের সঙ্গীত পরিচালক মানতুর কাছে এসে নরম স্বরে বললেন, “তুমি চমৎকার ছবি আঁকো। কিন্তু তোমার গানের গলা, এক কথায়, অতুলনীয়! প্রথম সারির গায়ক হবার সমস্ত লক্ষণই তোমার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু উঁচুতে উঠতে হলে আগামী দিনগুলিতে তোমাকে এ ব্যাপারে অনেক মেহনত করতে হবে।”
“আমি জানি, স্যার!” হাতে ধরা যাদু ছক্কাটির দিকে তাকিয়ে মানতু যেন স্বগতোক্তি করার মতোই ফিসফিসিয়ে বললো।

শুধু বলা নয়, কাজেও সে করে দেখালো মেহনত কাকে বলে। তার গান শেখার হাতেখড়ি হলো সঙ্গীত পরিচালকের স্নেহের ছায়ায়। পরে মালিকের নির্দেশে ও সাহায্যে সে একজন নামকরা সঙ্গীত গুরুর কাছে শেখার সুযোগ পেলো। গুরুটি ছিলেন খুবই কঠোর, আবার মানতুকে তিনি খুব ভালোও বাসতেন। তাঁর ছত্রছায়ায় মানতু দ্রুত উন্নতি করতে লাগলো, তার নাম আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো।
তারপর একদিন এক চলচ্চিত্র প্রযোজক মানতুর প্রতিভার সন্ধান পেয়ে অনেক টাকার বিনিময়ে তাকে তাঁর সিনেমায় প্লে-ব্যাকে গাইবার জন্য চুক্তিবদ্ধ করলেন। এইভাবে যাদু ছক্কার কাছে চাওয়া তার আর একটি ইচ্ছেও পূর্ণ হলো। নিজের এতদিনের শহর ছেড়ে সে চললো ভারতীয় সিনেমার যাদুনগরী মুম্বইয়ে। প্রযোজকের লোকই তার প্লেনের টিকিট ও অন্যান্য ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত করে দিলেন।
মানতু তাঁর পিতৃতুল্য মালিক দত্তবাবু, যাত্রার সঙ্গীত পরিচালক ও গুরুজীর কাছ থেকে বিদায় নিলো। এঁদের সাহায্য ও প্রাণঢালা ভালোবাসা ছাড়া সে কিছুতেই এত বড় হতে পারতো না। তারপর সে সজল চোখে বিদায় নিলো এতদিনের অভিভাবক কাকা-কাকিমার কাছ থেকে। আসার সময় মানতু বলে এলো যে এবার থেকে তাঁদের আর টানাটানি করে চলতে হবে না, সে নিয়মিত মুম্বই থেকে টাকা পাঠাবে।

শেষ অবধি মানতুর স্বপ্ন পূরণের মুহূর্ত এলো। এই প্রথম সে প্লেনে চড়ছে। জানালার পাশের সিটে বসে সে বাইরের সমস্ত দৃশ্য দু’চোখ ভ’রে দেখতে লাগলো। প্লেন রানওয়ের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলার পর সাঁ করে আকাশে উঠে পড়লো। নীচের দ্রুত বিলীয়মান ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট দেখতে দেখতে হঠাৎ মানতুর বুকটা ধক করে উঠলো।
নীচের দৃশ্যাবলীর মধ্যে কোথাও এক আগুনের রেখা ফুটে উঠেছে। এত বড় সে আগুন যে এত উঁচু থেকেও মানতুর অনভিজ্ঞ চোখে তা ধরা পড়ে গেছে। আটকে পড়া অসহায় মানুষ, যাদের এখান থেকে প্রায় পিঁপড়ের মতো দেখাচ্ছে, তারা বৃথাই এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে মরছে। মানতুর যেন মনে হলো সেই মানুষের ভীড়ে কিছু নারী ও শিশুও আছে।
কয়েকটি অনিশ্চিত মুহূর্ত, তারপর মানতু তার কর্তব্য স্থির করে ফেললো। সে যাদু ছক্কাটিকে শক্ত করে হাতে ধরে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো, “হে উপকারী বন্ধু, এবার সেই সময় এসেছে। নীচের অসহায় মানুষের দুর্দশা আমি আর দেখতে পারছি না। কিন্তু তাদের সাহায্য করার জন্য যে মেহনত দেবো, তার কোনো উপায়ই আমার এখন নেই। তাই আমি ঐ ভয়াবহ আগুন নেভানোর জন্য তোমার যাদুশক্তির সহায়তা প্রার্থনা করছি। এর ফল যে কী হবে, তা আমি ভালো করেই জানি।”
মানতু যখন এই কথা বলছিলো, সে খেয়াল করেনি কখন আকাশে বিরাট একখণ্ড কালো মেঘ জমা হয়েছে। তার কথা শেষ হতে না হতেই সেই মেঘ প্রবল বর্ষণের রূপ নিয়ে ঝ’রে পড়লো মাটির বুকে। দেখতে না দেখতে সেই ভয়াবহ আগুন শান্ত হলো, মানুষ পেলো স্বস্তি।
কিন্তু প্লেনটা সেই মুহূর্তে ঝোড়ো বাতাসের পাল্লায় পড়ে এক বিরাট ঝাঁকুনি খেলো। ভেতরের সবকিছু যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য বেসামাল। তারপর যখন আবার সব ঠিক হয়ে গিয়েছে, মানতু দেখলো যাদু ছক্কাটি তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে কোথায় চলে গেছে। মানতু বুঝতে পারলো, সেটা চিরদিনের মতোই হারিয়ে গেছে!
“তবে তার জন্যে দুঃখ নেই।” সে নিজের মনে বলে, “হে অদেখা বন্ধু, সঙ্কটের মুহূর্তে আমাকে মদত দেওয়ার ও শক্তি জোগাবার জন্যে তোমাদের অজস্র ধন্যবাদ। তোমাদের সহায়তা আর পাবো না। কিন্তু এতদিনে আমি নিজের মেহনতে ও হিম্মতে পৃথিবীর বুকে উঠে দাঁড়াবার মতো শক্তি অর্জন করেছি।”

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!