এক ছিল গাধা আর এক ছিল বলদ

অনেক দিন আগেকার কথা । এক ছিল ধনী পশুপালক ।সে বাস করতো এক নদীর ধারে এক বিস্তীর্ণ উর্বর শস্য ক্ষেতের পাশে ।তার ছিল একটা বলদ আর একটি গাধা ।
একদিন বলদটা গোয়ালে ঢুকে দেখে, গাধাটা যবের ভূষি মাখানো খেয়ে, পেটটা ডাঁই করে , বিচালী পাতা গদির ওপর শুয়ে দিব্যি নাক ডাকাচ্ছে ।
রোজ গাধাটার পিঠে চড়ে ক্ষেতের চারপাশে একটা চক্কর দিয়ে আসতো মনিবটি । তারপরই গাধার ছুটি । খেয়ে দেয়ে ঘুমানো ছাড়া তাকে আর কোনো কাজ করতে হয় না ।
বলদের আসাতে গাধার ঘুম ভেঙে গেল । বলদটা দুঃখ করে বলল-তোমার কি সুখ ভায়া । দিব্যি খাচ্ছো আর ঘুমোচ্ছ । এরকম সুস্বাদু দানাপানি আমরা চোখেও দেখি না ।
এই সময় ওদের মনিব গোয়ালের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল । বলদের কথা শুনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে সে কান খাড়া করে রইল । বলদ বলতে লাগল আমার মতো তো তোমাকে খেটে যেতে হয় না ভাই । এই দ্যাখো খেটে খেটে শরীরটা আমার কেমন হাড্ডিসার হয়ে গেছে । আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমার দেহটা কেমন নাদুসনুদুস হচ্ছে । কখনো –সখনো তোমার পিঠে চেপে একটু-আধটু ূঘুরে আসে মনিব । আর তারপর সারাদিন তোমার ছুটি । আর আমায় দ্যাখো , সেই যে সাত সকালে ঘাড়ে জোয়াল চাপায় , সন্ধ্যের আগে আর রেহাই পাই না ।
বলদের কথা শুনে গাধার বড় দুঃখ হলো । বলল শোনো, তোমাকে আমি একটা ফন্দি শিখিয়ে দিই । কাল সকালে চাকরটা যখন তোমাকে হালে নিয়ে যেতে আসবে তখন তুমি কিছুতেই উঠবে না । কিন্তু চাকরটা খুব মারবে । তা মারূক, তুমি সহজে যেতে চাইবে না । কিন্তু চাকর ব্যাটা তোমাকে ছাড়বে না ।মেরে ধরে মাঠে নিয়ে যাবেই । তুমি কিন্তু জোয়াল ঘাড়ে নেবে না । জোর করে চাপাবে চাকরটা । কিন্তু দু-এক পা টেনেই ধপাস করে মাটিতে শুয়ে পড়বে । চাকরটা আবার খুব মারবে ।তবু তুমি উঠবে না । তখন ওরা ভাববে নিশ্চয় কোনো অসুখ-বিসুখ করেছে ।দেখবে তখন তুমি রেহায় পেয়ে যাবে ।
ওদের সব কথা গোপনে শুনে নিল মনিব । তার পরদিন লক্ষ্য করলো, গাধা যেসব ফিকির শিখিয়ে দিয়েছিল বলদটা ঠিক ঠিক সেইভাবেই অভিনয় করে যেতে থাকলো । দানাপানি খেলো না । লাঠিপেটা করেও তাকে মাঠে নেয়া গেল না । জোয়াল কাঁধে চাপাতেই মাটিতে শুয়ে পড়লো । মনিব তখন চাকরটাকে ডেকে বলল-মনে হচ্ছে বলদটার কোনো অসুখ-বিসুখ করেছে । তুই এক কাজ কর, বলদটাকে গোয়ালে রেখে গাধাটাকে নিয়ে এসে জোড় ।
মনিবের কথামতো , গাধাটাকে এনে হালে জুড়ে সারাদিন ঠা ঠা রোদে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটালো চাকরটা । দিনের শেষে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে যখন গোয়ালে ফিরে এল, তখন বলদ তাকে দু’হাত তুলে অভিনন্দন জানাতে থাকে । ভগবান তোমার ভালো করবেন, ভাই । তোমার বুদ্ধিতে আজ একটু আরাম পেয়েছি ।
গাধা কিন্তু গম্ভীর । কোনো জবাব দিলো না । নিজের বোকামির জন্যে নিজেই জ্বলে পুড়ে মরতে লাগল ।
পরদিন চাকরটা এসে আবার গাধাকে নিয়ে হালে জুড়লো । সারাদিন ধরে আবার সেই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি । জোয়ালের ঘষায় ঘাড়ের ছাল চামড়া উঠে ঘা হয়ে গেল । সারা শরীর অসহ্য ব্যথায় টনটন করতে লাগলো । হালের জোয়াল টানতে টানতে তার চোখে জল এল । গাধা ভাবছিল তার নিজের দোষে সে সুখের দিনগুলো হারিয়েছে । এখন তাকে সারাটা জীবন এই জোয়াল টানতে হবে । না না , এর একটা উপায় বের করতেই হবে ।
সন্ধ্যেবেলায় গোয়ালে ফিরে গাধাটা কোনো কথাবার্তা না বলে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লো । বলদ কাছে এসে মুখ বাড়িয়ে বলে, কি ভায় , অমন মন মরা হয়ে শুয়ে পড়লে কেন ? এসো, একটু গল্পসল্প করি ।
গাধা বলল, কি আর বলব ভাই ! তোমার দুঃখে আমি মুষড়ে জড়েছি । এতকাল একসঙ্গে আছি আমরা । কিন্তু আজ যা শুনলাম…মনিব আর রাখবে না তোমাকে ।
–সে কি ! রাখবে না মানে ? বলদটা আঁতকে ওঠে । তবে কী করবে আমাকে? মেরে টেরে ফেলবে না তো? কী শুনেছো , বলো না, ভাই—
কসাই এর কাছে বেচে দেবে । লোকটাকে বলছিল মনিব, বলদটা বোধহয় বাঁচবে না । ওটা যদি মরে যায় আমার অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে ।তার চেয়ে কসাই এর কাছে বেচেই দিই, কি বলো? তবু যা হোক মোটামুটি ভালোই দাম পাওয়া যাবে । মনিবের এই কথা শুনে অবধি আমি কাঁদছি ভাই । কী করে এতো বড় দুঃসংবাদ দেবো আমি তোমাকে , তাই ভেবে আমি কিনারা করতে পারছিলাম না । এতকাল আমরা একসঙ্গে আছি । এতদিনের প্রাণের ভালোবাসা আমাদের । আজ যদি তোমাকে ওরা কসাই এর হাতে তুলে দেয়, তাহলে আমি বাঁচবো কী নিয়ে? এবার বাঁচার একটা উপায় বার করো ভাই ।
বলদ কৃতঙ্গ হয়ে বলল, খবরটা জানিয়ে তুমি আমার জান বাঁচালে ভাই । কী বলে যে তোমাকে সুক্রিয়া জানাবো, ভেবে পাচ্ছি না । কাল সকালেই আমি টগবগিয়ে উঠে দাঁড়াবো । আজ থেকেই আমি পেট পুরে দানাপানি খাবো । ফুর্তিতে হাল টেনে মনিবকে বুঝিয়ে দেবো অসুখ-বিসুখ সব আমার সেরে গেছে ।
এই বলে বলদটা উঠে গিয়ে জাবনা খেতে শুরু করলো । এদিকে গোয়ালের পিছনে দাঁড়িয়ে মালিক বলদ আর গাধার কথাবার্তা সব শুনে নিল ।
পরদিন সকালে চাকরটা গোয়ালে ঢুকে তো অবাক । বলদটা উঠে দাঁড়িয়ে চনমচ করছে । গাধাকে রেখে আজ সে বলদটাকে নিয়ে মাঠে বলল । গাধা হাসলো মনে মনে ।
উপদেশ : বিপদে মাথা ঠান্ডা করে বুদ্ধি খাটিয়ে বিপদ মুক্ত হতে হয় ।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!