আজ জমিদার চণ্ডীকা চরণ চৌধুরীর পারলৌকিক কাজ – হৈ হৈ ব্যাপার। দুই মেয়ে সপরিবারে এসেছে এ ছাড়াও দূর দূর থেকে আসা অনেক আত্মীয় স্বজনে এত বড় জমিদার বাড়ি একেবারে গম গম করছে। দুপুরে জমিদারির ছয় সাতটা গ্রামের প্রায় হাজার দুয়েক লোক পাত পেড়ে খাবে পাশের মাঠে – সেখানে বিরাট বিরাট সামিয়ানা খাটানো হয়েছে আর একদিকে কলাপাতার ঢাঁই – আশে পাশের গ্রামের কারুর বাড়িতে কলাপাতা বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। শ খানেকের উপর গ্রামের লোক বেগার খাটছে মাঠে, রান্নার কাজে। রান্নার বিশাল আয়োজন – সে এক এলাহি ব্যাপার – সারা রাত ধরে হ্যাজাকের আলোতে গ্রামের জনা কুড়ি বৌ ঝি তরকারি কুটে পাহাড় বানিয়েছে আর সেই সাথে জোগালিরা মশলা বেঁটে পরাতের উপর স্তুপ করেছে – এখন পোস্ত বাটা চলছে। কাক ভোর থেকেই রান্না শুরু – জনা দশেক রাঁধুনী বিরাট বিরাট কাঠের উনুনে বড় বড় হাণ্ডা ও কড়াই চাপিয়েছে পোলাও, ফুলকপির কালিয়া, আলু পোস্ত, পায়েস, ইত্যাদি রান্নার জন্য – ওদের সাথে জনা পনের লোক খেটে চলেছে অবিরাম। সবার গলদঘর্ম অবস্থা – রান্না ভালো না হলে কারুর ঘাড়েই মাথা থাকবে না। দুদিন আগে থেকেই মিষ্টি তৈরির ভিয়েন বসেছে তিন চার ধরনের মিষ্টি, দৈ ও বোঁদে বানানোর জন্য তাই দূর শহর থেকে চার পাঁচ জন ময়রা এসেছে এই কাজে মানে ওদের ধরে আনা হয়েছে। বিরাট সব কাঠের পরাতে মিষ্টি ও বোঁদের পাহাড় হয়ে আছে আর শ দুয়েক গাড়িতে দৈ বসানো হয়েছে। জমিদারবাবুর বড় ছেলে কন্দর্প কান্তি চৌধুরী বাবার শেষ কাজ খুবই ধুমধাম করে করছেন যাতে জমিদারির সমস্ত লোক বলে, হয়েছিলো বটে খাওয়া দাওয়া জমিদারবাবুর শ্রাদ্ধে – জীবনে এত ভালো কোথাও খাই নি। জমিদারবাবুর পেয়ারের লেঠেলরা চার দিকে নজর রেখেছে – ওদের ভয়ে রাঁধুনী বা অন্যান্য কাজের লোক তটস্থ – কারুর মুখেই কোন কথা নেই – একটু এদিক ওদিক হলেই ঘাড় থেকে মাথা নেমে যাবে। জমিদারবাবুর দৌলতে এই লেঠেলদের সাত খুন মাপ – পুলিশের মুখ উপযুক্ত দক্ষিণাতে বন্ধই থাকে। অনেককে মেরে বিলের কাদায় পুঁতে দিয়েছে – গ্রামের কারুর টুঁ শব্দ করার উপায় নেই – বাড়ির লোক ভয়ে কাঁদতে পারে নি শ্রাদ্ধ তো দূরে থাক।
ভোর বেলা থেকে জমিদার বাড়ির বিরাট উঠানে সামিয়ানা খাটিয়ে চলেছে শ্রাদ্ধের কাজের আয়োজন – বড় বড় ঝুড়িতে ফুল, মালা আর তার সাথে কলা, আপেল, মুসাম্বি, বেদানা ইত্যাদি নানা রকমের ফল, সুগন্ধী বাসমতি চাল, জমিদারবাবুর পছন্দের সব রকম তরকারি ইত্যাদি – শ্রাদ্ধের দানের জন্য প্রচুর কাপড়, ধুতি ও অন্যান্য জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। শ্রাদ্ধের কাজ করছেন নর নারায়ণ তর্করত্ন মশাই – এই এলাকার সব থেকে বড় পণ্ডিত ও খুবই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ছোট বেলায় নবদ্বীপের টোলে পড়াশুনা করে অনেক বছর বারাণসীতে শাস্ত্র চর্চা করেছেন – বেদ উপনিষদ একেবারে কণ্ঠস্থ। গ্রামে ফিরে এসে নিজের একটা টোল খুলেছেন ওখানে জনা দশেক ছেলে বিনা পারিশ্রমিকে শাস্ত্র পড়ে। খুবই সাধারণ জীবন যাত্রা – কোন রকম অহংকার বা বাহুল্য নেই – বিয়েও করেন নি – স্বপাকেই খান। রোগা ছিপছিপে ফরসা চেহারা, মাথায় বেশ মোটা টিকি – বাকি চুল কামানো, কপালে শ্বেত চন্দনের ফোঁটা – শীত গ্রীষ্ম বারো মাস পরনে সাদা ধুতি আর গায়ে একটা চাদর – সাধারণতঃ খালি পায়ে নয়তো খড়ম পরেই থাকেন তবে দূরে কোথাও যেতে হলে ক্যানভাসের জুতো। জমিদারবাবুর শ্রাদ্ধের কাজটা নিতে ওকে প্রায় বাধ্য করা হয়েছে – জলে থেকে তো আর কুমিরের সাথে বিবাদ করা যায় না – সকালে লেঠেলদের সর্দার নিজে এসে ওকে নিয়ে এসেছে। আজ কাজের জন্য উপবাস করেছেন – একেবারে বাড়ি ফিরে খাবেন। শ্রাদ্ধের কাজটা অবশ্য খুবই নিষ্ঠার সাথেই করছেন – শেষ হতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো। জমিদারবাবুর প্রেতাত্মার শান্তি ও অক্ষয় স্বর্গ লাভের ব্যবস্থা করে শ্রাদ্ধ শেষ করলেন। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান থেকে কিছুই নেবেন না – শেষে কন্দর্প কান্তি জোর করে এক বিঘা জমি ওর নামে দেবোত্তর করে দেওয়ার দলিলটা ধরিয়ে দিলেন। ওদিকে দুপুর থেকেই মাঠে খাওয়া দাওয়া চলেছে – যত খুশি খাও – পেট পুরে খেয়ে গ্রামের লোকজন ছেলে মেয়েদের হাত ধরে প্রয়াত জমিদারবাবুর জয়ধ্বনি দিতে দিতে বাড়ির পথ ধরেছে সঙ্গে বাড়ির মেয়েদের জন্য খাবারের পোঁটলা। যারা লোভে পড়ে অতিরিক্ত খেয়ে নিয়েছে তারা আশে পাশের গাছের ছায়াতে শুয়ে পড়েছে – হেঁটে বাড়ি ফেরার অবস্থায় নেই। থানার দারোগাবাবু ও সেপাইরা আজ বিশেষ ভাবে আমন্ত্রিত – খাওয়া দাওয়ার পর সবাইকে উপযুক্ত ভেটও দেওয়া হয়েছে।
গোধূলির শেষে অন্ধকার হয়ে আসার মুখে তর্করত্ন মশাই রোওয়ানা দিলেন নিজের গ্রামের দিকে। পথে পেরুতে হয় মস্ত বড় ঠগীর মাঠ – প্রায় মাইল খানেকের উপর চওড়া – পাথরের নুড়ি ভরা রুক্ষ উঁচু নিচু জমি – মাঝে মাঝে বহু পুরাতন বট ও অস্বত্থ গাছ বিরাট বিরাট ঝুরি নামিয়ে অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে – এদিক ওদিক শ্যাওড়া গাছ আর কাঁটা গাছের ঝোপ ঝাড়। মাঠের একধারে বিরাট একটা মজে যাওয়া বিল – শ্যাওড়া ও বাবলা গাছের জন্য ওদিকে যাওয়া প্রায় অসম্ভব – পুরো বিলটাই পচা কাদায় ভরা অনেকটা চোরা বালির মত – কিছু পড়লে ভুস্ ভুস্ করে কোথায় যে তলিয়ে যায় কেউ জানে না। রাত্রে বেলা মাঝে মাঝেই হুঁস হুঁস করে এদিক ওদিক আগুন জ্বলে ওঠে – আশে পাশের গ্রামের লোকের মধ্যে চলতি কথা যে বিলের কাদায় যাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিলো তেনারাই রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে ঘুরে বেড়ান। ঠগীদের সময় কেউই প্রাণ নিয়ে এই মাঠ পেরুতে পারতো না – কত লোককে যে মেরে এই বিলে ফেলে দিয়েছিলো তার হিসেব নেই – বড় দল করে দিনের বেলাতেই শুধু লোকে মাঠটা পেরুতো। এখন তো ঠগীদের দিন নেই তবে নামটা রয়ে গিয়েছে আর বদনামটা নানা মুখের গল্পে রং চং মেখে গ্রামের লোকের মনে ভিত গেড়ে নিয়েছে তাই সন্ধ্যের পর কেউই মাঠ পেরুতে সাহস করে না। তর্করত্ন মশাই অবশ্য এসব গল্প একেবারেই বিশ্বাস করেন না তবে সাপ খোপের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয় – বড় বড় কাল কেউটেরা এখানে স্বাধীন ভাবেই ঘোরা ফেরা করে। আজও নিজের মনে শ্রীবিষ্ণুর সন্ধ্যারতির স্লোকটা গাইতে গাইতে হন্হনিয়ে চলেছেন মাঠের ভেতর দিয়ে তবে দৃষ্টি সজাগ রয়েছে বাসুকী নন্দনদের জন্য। হঠাৎ মনে হলো অন্ধকারের মধ্যে ভুঁইফোড়ের মত ওর পাশে কে যেন হাঁটতে শুরু করেছে – কোথা থেকে এলো, কি ভাবে এলো ঠিক হিসেব পেলেন না – তর্করত্ন মশাই দাঁড়িয়ে পড়লেন।
‘পেন্নাম হই পণ্ডিত মশাই, জমিদার ব্যাটার স্বর্গে যাবার ব্যবস্থা তো করে এলেন – তা ওকে কি স্বর্গে ঢুকতে দেবে? চিত্রগুপ্তের খাতায় অনেক গুলো পাতা তো ওর কীর্তি কাহিনীতে ভরে আছে।’
দোর্দন্ড প্রতাপ জমিদার চণ্ডীকা চরণ চৌধুরী – যার ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো – তার নামে এই ভাবে অশ্রদ্ধার সাথে কথা বলা এই প্রথম শুনলেন – লোকটার বুকের পাটা আছে বলতে হবে – কে জানে কোথাকার লোক,
‘শাস্ত্রের যা বিধি সেই ভাবেই আমি করেছি – বাকিটা তো আমার হাতে নেই – ভগবানের যা বিধান সেটা তো হবেই। কেউই তা আটকাতে পারে না।’
‘তা অবশ্য ঠিক – আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত – আপনার কাজ আপনি করে দিয়েছেন। তা পণ্ডিত মশাই, আপনাকে যে একটু কষ্ট করে আমার সাথে যেতে হবে।’
‘এখন? কোথায়?? কেন???’
‘সেটা গেলেই বুঝতে পারবেন – ভয় নেই বেশী দেরি হবে না – আমি আপনাকে বাড়ি পৌছে দেবো।’
নর নারায়ণ এবার বিপাকে পড়লেন – একে তো অন্ধকার মাঠের মধ্যে লোকটা হঠাৎই কোথা থেকে এলো সেটাই চিন্তার বিষয় তার উপর কোথায় যেতে হবে, কেন যেতে হবে কিছুই বলছে না – লোকটার হাব ভাবও যেন কেমন ধরনের – অশরীরি আত্মা নয় তো?
‘দেখো ভাই, আমি সকাল থেকেই অভুক্ত – খুবই পরিশ্রান্ত – বাড়িতে গিয়ে স্বপাকে কিছু না খেলে যে আর চলতেও পারবো না। তাছাড়া বাড়িতে নারায়ণের সন্ধ্যারতিও তো করা হয় নি। তুমি না হয় কাল সকালে আমার বাড়ি এসো – তখন তোমার সাথে চলে আসবো।’
‘মাপ করবেন পণ্ডিত মশাই, সকালে যে আমি আসিতে পারবো না। এক কাজ করা যাক – এখন রাত তো বিশেষ হয় নি – আপনি বাড়ি গিয়ে পূজা আর্চা, খাওয়া দাওয়া করে নিন – তারপর আমি আপনাকে নিয়ে আসবো।’
নর নারায়ণ বুঝলেন এ ছাড়ার পাত্র নয় আর কি এমন দরকারি কাজ যে রাত্রে বেলাতেই যেতে হবে? ব্যাপারটা খুবই ঘোরালো মনে হচ্ছে – বেঘোরে প্রাণটা না গেলেই হয় তবে খুবই নম্র ভাবে কথা বলছে এই যা ভরসা।
‘ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছে মতই হবে।’
নর নারায়ণ বাড়ির কাছে আসতেই লোকটা হঠাৎ কোথায় যেন উবে গেলো।
সারা দিন অনিচ্ছার সাথে শ্রাদ্ধের কাজ করার পর নিজেকে কেমন যেন ক্লেদাক্ত মনে হচ্ছিলো – সোজা পুকুরে ডুব দিয়ে ভালো করে স্নান করে নিলেন তারপর নারায়ণের সন্ধ্যারতি করে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে বেশ সময় লাগলো – ভাবলেন দেরি দেখে হয়তো ব্যাটা চলে গিয়েছে। বাড়ির বাইরে আসতেই দেখেন লোকটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে,
‘চলুন পণ্ডিত মশাই, মাঠের পাশেই আপনার জন্য পালকি রাখা আছে।’
মাঠের কাছে এসে দেখতে পেলেন বট গাছের নিচে একটা চার বেহারার পালকি দাঁড়িয়ে কিন্ত আশে পাশে কোন পালকি-বেয়ারা নেই। এবার নর নারায়ণের ভয় হলো – সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন ভৌতিক। সাহস করে বললেন,
‘তোমার পরিচয় না দিলে বাপু তোমার সাথে যাওয়া তো সম্ভব নয়। তুমি কে? কোথা থেকে আসছো? কোথায় যেতে হবে? এর কিছুই তো বলো নি – তুমি যদি আমার প্রাণটা নিতে চাও আমার আপত্তি নেই – এই ত্রিসংসারে আমার কেউ নেই কিন্তু বিস্তারিত না জেনে আমি আর এগুচ্ছি না।’
‘ছিঃ ছিঃ পণ্ডিত মশাই, আপনি সবার পরম শ্রদ্ধার পাত্র – এসব কথা ভাবলেও পাপ। আপনি ভয় পাবেন বলেই এত সময় আমার পরিচয় দেই নি। আমার নাম ছিলো পরান – অনেকদিন আগে খাজনার টাকা সময় মত দিতে না পারায় জমিদারবাবুর লেঠেলরা পিটিয়ে আধমরা করে এই বিলের কাদায় ফেলে দিয়েছিলো আর আমিও ভুস্ করে নিচে তলিয়ে গেলাম। এখন বুঝতেই পারছেন আমি জীবিত মানুষ নই তবে ভয় পাবেন না – আপনাকে সুস্থ শরীরে বাড়ি পৌছে দেবার দায়িত্ব আমার। আপনার সাথে আমাদের একটু আলোচনা আছে – একটু তাড়াতাড়ি করুন – জানেনই তো দিনের আলোতে আমরা বেরুতে পারি না।’
নর নারায়ণ বুঝলেন ওঁর ধারনাই ঠিক – এ তো প্রেতাত্মা আর নিয়ে যাবে আরো অনেক প্রেতাত্মার সাথে আলোচনা করাতে। শরীরটা শিউরে উঠলেও ভাবলেন যা হবার তা তো হবেই – ভবিতব্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো – বাড়ি পৌছে দেবার কথা যখন দিয়েছে তখন দেখাই যাক। পালকিতে উঠে বসতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেলো তারপর ওটা ভীষণ জোরে চলতে শুরু করলো যেন চারটে ঘোড়া পালকিটাকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। হয়তো পরানের মতই আরো কিছু ছায়া পালকিটাকে নিয়ে চলেছে তবে কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বোঝা গেলো না। একটু পরে পালকিটা দাঁড়িয়ে পড়তে দরজা খুলে গেলো,
‘আসুন পণ্ডিত মশাই আমরা পৌছে গিয়েছি।’
পালকি থেকে বেরিয়ে নর নারায়ণ দেখলেন বিলের ধারে একটা খোলা জায়গাতে এসেছেন – চারদিকে পরানের মত অনেক ছায়ার ভিড় আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়াকে দেখিয়ে পরান বললো,
‘পণ্ডিত মশাই, ইনি হলেন ভূতনাথ – অনেক বছর আগে এই গ্রামের মোড়ল ছিলেন। অহেতুক খাজনা বাড়ানোতে জমিদারের কাছে প্রতিবাদ করে নতুন খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন। লাভের লাভ হলো এক রাত্রে ওর বাড়িতে লেঠেলরা আগুন ধরিয়ে দেয় আর সেই আগুনে পুড়ে ওর ছেলে মেয়ে ও স্ত্রী মারা যান আর ওর আধ পোড়া শরীরের জায়গা হয় এই বিলের কাদায়। এখানে যাদের দেখছেন সবাই আশে পাশের গ্রামের বাসিন্দা ছিলো কিন্ত লেঠেলদের দয়ায় এদের ঠাঁই মিলেছিলো এই বিলের চোরা কাদায়। অপঘাতে মৃত্যু ও ভয়ে শেষ কৃত্য কেউ করে নি বলে এই ভূত জন্ম থেকে আমাদের তো আর উদ্ধার নেই। কন্দর্প কান্তি তো বাপের উপর দিয়ে যায় আর ওর বৌ একেবারে যোগ্য সহধর্মিনী – বাড়িতে ঝি চাকরদের তো পান থেকে চুন খসার উপায় নেই – একটু এদিক ওদিক হলেই চাবকে পিঠের ঝাল চামড়া তুলে দেয় আর আধমরাদের লেঠেল দিয়ে এই বিলে পাঠিয়ে দেয়। এই অত্যাচারের একটা বিহিতের জন্য আজ আপনাকে এখানে কষ্ট দিয়ে নিয়ে এসেছি যাতে ভবিষ্যতে যেন আর কাউকে এই ভাবে বিনা কারনে লেঠেলদের হাতে মরতে না হয় আর আশে পাশের সব গ্রামের লোক যেন সুখে সাচ্ছ্যন্দে বেঁচে বর্তে থাকতে পারে। আমরা সব চাষা ভূষো ছিলাম – আমাদের বুদ্ধিতে এই সমস্যার কোন সমাধান পাচ্ছি না।’
মানুষ যে কতটা অত্যাচারি হতে পারে তার কোন ধারনা নর নারায়ণের ছিলো না – আজ এক সাথে এত ঘটনা শুনে আর সেই অত্যাচারের ভুক্তভোগী এত প্রেতাত্মাদের দেখে মনে হলো মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। নর নারায়ণ নিজেকে সামলালেন – মাথা গরম করে কিছু করা যাবে না। গ্রামের লোকজনকে দিয়েও হবে না কারণ অত্যাচারের ভয়ে কেউই এগিয়ে আসবে না আর সরকারের আইন আদালতের সাহায্য চেয়েও কোন লাভ নেই – সবই জমিদারের হাতের মুঠোয়। ছায়ারা অনেক আশা নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে – ওদের কাছে নর নারায়ণ হচ্ছেন এক মাত্র সহায়। মাথা নিচু করে অনেক ক্ষণ ভেবে ধীরে ধীরে বললেন,
‘দেখো, আমি ব্রাহ্মণ – হিংসা বা খুন জখম আমার চিন্তায় আনাও পাপ। তবে চাণক্যও ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্তু বৃহত্তর জনতার স্বার্থে তিনিও কূট কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমার মনে হয় এর ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে – আর কোন উপায় নেই। তোমাদের তো ভয়ের কোন কারণ নেই – নতুন করে আর কোন ক্ষতি তো কেউ করতে পারবে না। প্রথমে লেঠেলগুলোর ব্যবস্থা করো – ওরাই জমিদারের প্রধান শক্তি – ওদের এক এক করে তুলে এনে এখানে বেঁধে রাখো আর এমন ভয় দেখাও যে বাছাধনদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় – লেঠেলদের সর্দারকে সব থেকে আগে তুলবে।’
এর মধ্যে কোথা থেকে একটা ছায়া দৌড়ে এসে পরানকে বললো,
‘পরানদা, এক্ষুনি একজন রাঁধুনীকে লেঠেলরা ওপাশে বিলের কাদায় ফেলে দিয়েছে – বেচারির দোষ হলো পায়েসে মিষ্টি কেন কম হয়েছে।’
‘নাঃ, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না – আজ থেকেই তোমরা কাজ শুরু করে দাও। সব কটা লেঠেল যেন আজ রাত্রেই এখানে চলে আসে – তারপর জলবিছুটির ডাল দিয়ে ওদের আচ্ছা করে চাবকাবে। আগামী কাল রাত্রে এরপর কি করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।’
পর দিন সকালে সব কটা গ্রামে হৈ চৈ শুরু হয়ে গিয়েছে – একজন লেঠেলকেও পাওয়া যাচ্ছে না – এমন কি লেঠেলদের সর্দারও নেই। কন্দর্প কান্তি পেয়াদাদের সাথে বন্দুক নিয়ে চার দিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন – হুমকি দিয়েছেন আজকের মধ্যে লেঠেলদের বের করতে না পারলে গ্রাম কে গ্রাম পুড়িয়ে দেবেন। গ্রামের লোকেরা ভয়ে দরজা বন্ধ করে হরিনাম জপছে। নর নারায়ণ মনে মনে হাসলেন – ওষুধ ধরেছে – এবার দ্বিতীয় পর্বের শুরু। সেদিন সন্ধ্যের পর নর নারায়ণকে পালকিতে করে পরান বিলের ধারে নিয়ে এলে নর নারায়ণ আশে পাশে কোথাও লেঠেলদের দেখতে পেলেন না তবে দূর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ শুনতে পেয়ে পরানের দিকে তাকাতে পরান হাসলো,
‘পণ্ডিত মশাই, আপনার কথা আমাদের মনে সাহস জুগিয়েছে – মনে হচ্ছে অনেক দিন আগেই এটা করা উচিত ছিলো। লেঠেল ব্যাটাদের তুলে আনতে কোন অসুবিধা হয় নি – সব কটাকে উড়িয়ে নিয়ে বিলের মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে – ওখান থেকে কোন জ্যান্ত মানুষ চার দিকের চোরা কাদা পেরিয়ে জীবনেও এ পাড়ে আসতে পারবে না। আমাদের কয়েকজন জলবিছুটির চাবুক মেরে ওদের নাচ খুব উপভোগ করছে।’
‘ঠিক আছে, এবার দ্বিতীয় পর্ব। আজ রাতেই তোমরা ওই জমিদার বাড়িতে ঢিল পাটকেল মারতে শুরু করো তবে কাউকে প্রাণে মারবে না আর কোন বাচ্চা বা মেয়েদের যেন কিছু না হয়। বাড়ির ভেতরে ও বাইরে বিলের পচা কাদাতে বাড়ি যেন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় আর কন্দর্প কান্তিকে বিশেষ যত্নে ওর সাধের লেঠেলদের কাছে পৌছে দিও।’
মাঝ রাতে জমিদার বাড়িতে প্রচণ্ড গণ্ডগোল শুরু – চারদিক থেকে ইট পাটকেল পড়তে শুরু করেছে। দারোয়ানরা গেটের পাশে খাটিয়াতে ঘুমাচ্ছিলো – ওদের গোঁফ, টিকি আর চুলের মুঠো ধরে উঠিয়ে কারা যেন সমস্ত মুখে গায়ে পচা গোবর আর কাদা মাখিয়ে দিলো। দুর্গন্ধের চোটে ওরা দৌড়ালো পুকুরের ডুব দিতে – পুকুরে নামতেই শুরু হয়ে গেলো চোবানো – হাস্ফাস্ করে জল থেকে মাথা তুললেই আবার জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে – প্রায় আধ মরা অবস্থায় ছাড়া পেয়ে পুকুরের জলে পেট ফুলিয়ে কোন রকমে পাড়ে উঠে ওখানেই ওরা পড়ে রইলো। চেঁচামেচি শুনে পেয়াদারা বন্দুক নিয়ে ঘরের বাইরে এসে কিছুই দেখতে না পেয়ে ভয়ে এলো পাথারি গুলি চালাতে শুরু করতে হঠাৎ বন্দুকগুলো ওদের হাত থেকে বেরিয়ে উড়ে পুকুরের জলে ডুবে গেলো আর কারা যেন ওদের ধুতি লুঙ্গি টান দিয়ে খুলে হাওয়াতে ভাসিয়ে দিলো। পেয়াদারা প্রাণের ভয়ে পাঁচিল টপকে বাইরে যেতেই কারা ওদের পেছনে জলবিছুটির চাবুক মারতে মারতে গ্রামের বাইরে বের করে দিলো। এর মধ্যে সবাই হতবাক হয়ে দেখলো কন্দর্প কান্তি হাওয়াতে ভেসে চলেছেন আর আগে আগে ওর সিল্কের লাল লুঙ্গি পতাকার মত চলেছে – রাতের অন্ধকারে কন্দর্প কান্তি কোথায় হারিয়ে গেলেন কেউ জানলো না। এদিকে বাড়ির সমস্ত দরজা জানালা ভেঙ্গে প্রত্যেকটা ঘরের জিনিষ পত্রের একেবারে লণ্ড ভণ্ড অবস্থা – পচা গোবর, কাদা আর আবর্জনাতে বাড়ি ভরে গিয়েছে – দুর্গন্ধে টেঁকা যাচ্ছে না। রান্না ঘরের সমস্ত বাসন কোসন পুকুরের জলে ডুবে গেলো – উনুন ও অন্যান্য জিনিষ ভেঙ্গে একাকার অবস্থা। জামা, কাপড়, বিছানা, ইত্যাদির ছেঁড়া টুকরো বাগানের গাছে ঝুলছে। বাচ্চারা ও মেয়েরা ভয়ে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছে তবে এর মধ্যে জমিদার গিন্নীর বিলাপই সব থেকে বেশী। আধ ঘন্টা খানেক তাণ্ডব চলার পর হঠাৎ সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেলো যেন কাল বৈশাখির ঝড় থেমে যাওয়ার ঠিক পরের অবস্থা। ঝি চাকররা সব ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে – বাড়ির বাকি লোকজন রাতটা বাইরের মাঠে বসে কাটালো। গোলমাল শুনে গ্রামের লোকেরা সব বেরিয়ে এসেছিলো কিন্তু ভয়ে দূর থেকেই দেখেছে – কাছে আসার সাহস কারুরই হয় নি।
ভোরের আগেই দারোয়ানরা পুকুর পাড় থেকে কোন রকমে উঠে পালিয়ে গেলো নিজেদের বাড়ি আড়া ছাপড়ার দিকে – এত বড় বাড়ি একেবারে শুনশান। সকাল বেলাতেই চণ্ডীকা চরণের মেয়েরা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা এক কাপড়ে রওয়ানা দিলো নিজেদের বাড়ির দিকে – টাকা পয়সা, সোনা দানা, কাপড় চোপড় সবই রয়ে গেলো বাড়ির ভেতরে পচা কাদা ও গোবরে মাখামাখি হয়ে। শুধু জমিদার গিন্নী একা বুক চাপড়ে কেঁদে গেলেন সারা দিন – ওকে সান্তনা দেওয়ারও কেউ রইলো না। বিকেলের দিকে নর নারায়ণ হাজির হলেন গ্রামে যেন এই মাত্র খবর পেয়েছেন। ওকে দেখে গ্রামের লোক ঘিরে ধরেছে – হাজার প্রশ্ন চার দিক থেকে। নর নারায়ণ ধীরে ধীরে বললেন,
‘সবই ভগবানের বিচার – বোধ হয় পাপের পাল্লা বেশী ভারি হয়ে যাওয়াতে স্বয়ং মহাদেব নিজের চেলা চামুণ্ডাদের পাঠিয়েছিলেন শাস্তি দেওয়ার জন্য না হলে এরকম ঘটনা তো ঘটতে পারে না। আমার মনে হয় কারুরই ও বাড়িতে ঢোকা আর উচিত হবে না।’
গ্রামের সাধারণ মানুষ এক বাক্যে স্বীকার করে নিলো পণ্ডিত মশাইর কথা। বয়স্ক লোকেরা মাথা নেড়ে বললো,
‘পণ্ডিত মশাই সর্বজ্ঞ – উনি ঠিকই বলেছেন – এ রকম ভূতের নেত্যর কথা তো আমরা বাপের জন্মেও শুনি নি। ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় আমরা আর যাচ্ছি না।’
সেদিন রাত্রে বিলের ধারে আবার জমায়েত – ছায়ারা সবাই ভীষণ খুশি – ওদের আনন্দ দেখবার মত – অনেকে তো চারদিকে নেচে বেড়াচ্ছে। নর নারায়ণ সবাইকে থামিয়ে দিলেন।
‘এবার সব থেকে দরকারি কাজ – আমি ভূতনাথকে অনুরোধ করবো জমিদারির সমস্ত গ্রামে অরাজকতা শুরু হবার আগেই এক জন করে মোড়ল ঠিক করে দিতে – নাম পরিচয় জানালে আমি নিজে প্রত্যেকটা গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে মোড়ল নির্বাচন করে দেবো। জমিদার বাড়িতে যত টাকা পয়সা, সোনা দানা চার দিকে ছড়িয়ে আছে সেগুলো এক জায়গায় জড়ো করে সিন্দুকে ঢুকিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে। কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো কিছু সাহসী লোক টাকা পয়সার লোভে ওই বাড়িতে হানা দিতে পারে তাই তোমাদের কয়েকজনকে বাড়ি পাহারার জন্য ওখানে থাকতে হবে। এই সবের বিলি ব্যবস্থা কি ভাবে করা হবে সেটা ভূতনাথের সাথে বসে তোমরাই ঠিক করবে। চণ্ডীকা চরণ যাদের জমি জবর দখল করেছিলো তার সমস্ত দলিল সিন্দুক থেকে বের করে আসল মালিকদের ফেরৎ দিয়ে দাও। গ্রামের যারা এত দিন জমিদারের দালালি করতো ওদের জলবিছুটির কয়েক ঘা দিয়ে ছেড়ে দেবে তার বেশী দরকার হবে না। জমিদার বাড়িও যেন ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয় যাতে কেউ কোন দিনও ওখানে বসবাস করতে না পারে। এই সমস্ত কাজ শেষ হবার পরই তোমাদের ছুটি !