তুলতুলি আর বুলবুলি দুই বোন। সকলের কাছে তুলি আর বুলি। বুলি বয়সে বড়, শান্ত স্বভাবের, কিন্তু তুলি হচ্ছে বিশ্বপাকা। বকবক করে সর্বদাই সকলকে অস্থির করে রাখে। বয়স মোটে চার, কিন্তু এখনই তার নিজের নামটা মোটেই পছন্দ নয়। কারণ? বড় হলে তো ওই নাম আর ওকে মানাবে না। এই নিয়ে মা’র কাছে প্রায়ই ঘ্যানঘ্যান করে। মা শুনে কেবল হাসেন, চুমু খেয়ে আদর করেন, কিন্তু পাত্তা দেন না। শেষে ও গিয়ে পড়ল বাবার কাছে। “বাবা, আমার নামটা বদলে দাও।” বাবা হলেন একজন জীববিজ্ঞানী; ড: অরণ্য মিত্র, বর্তমানে দার্জিলিংএর চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা। ছোট্ট চিড়িয়াখানাতে কলকাতার মত এতো তো পশুসমাহার নেই, কিন্তু পাহাড়ী অঞ্চলের প্রাণীবৈচিত্র্যের ভালো সংরক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। এই জন্তু-জানোয়াররা তাঁর প্রাণ। প্রায়ই তিনি নিজেকে নিয়ে বলেন তিনি যে অরণ্যের মিত্র, মানে বন্ধু। তুলি যখন বাবার কাছে এল তখন তিনি একটা বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত বিশেষ কিছু তথ্য মন দিয়ে পড়ছিলেন। তিনি হ্যাঁ-না কিছুই জবাব দিলেন না। তুলি বাবাকে চিনত, সে একটু হতাশ হয়ে চলে গেল। তারপর গাল ভারী করে বাড়ির পিছন দিকের বাগানে গিয়ে বসে রইল। সেখানে কত পাখি, ছোট বড় কাঠবিড়ালি, ওর বন্ধুরা ওর আশেপাশে উড়ে, শিষ দিয়ে ওর মন ভাল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটুক্ষণের মধ্যেই তুলি ভুলে গেল ওর মনখারাপের কথা। সে হেসে লাফিয়ে মেতে গেল ওদের সঙ্গে খেলায়।
ছোটোবেলা থেকেই বুলি-তুলি বাবার হাত ধরে, কোলে চেপে পাহাড়ের জঙ্গলে কত ঘুরে বেড়িয়েছে। এইভাবে তারা গাছ, পাখি, পশুদের চিনেছে, তাদেরকে বন্ধু বলে ভাবতে শিখেছে। তুলি একটু বেশি ছটপটে, কৌতূহলী বলে তার বাবাকে নানান প্রশ্নে সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত করে রাখে; ডঃ মিত্রও বিরক্ত না হয়ে সব প্রশ্নের উত্তর দেন। অরণ্যকে নিয়ে নিজের ভালোবাসা, স্বপ্নকে হয়তো বা রক্ষিত করতে চান তাঁরই আত্মজার মধ্যে। এখন বুলি তুলি দুজনেই পাখিদের ডাকাডাকি চলনবলন দেখলেই বুঝতে পারে কেন পাখিটা অমন করে ডাকছে বা তারা কখন ডিম পাড়বে; বাঁদরগুলো কেন হঠাৎ হুপহাপ করে লাফালাফি বাড়িয়ে দেয়। তুলি রোজ সকালে কিম্বা স্কুল থেকে ফিরে তাদের বাড়ির পিছনে বিরাট বিরাট গাছে ঢাকা ছোট্ট বাগানটাতে যখন গিয়ে বসে, দুটো বাঁদরছানা সড়াৎ করে গাছ বেয়ে নেমে এসে তার সঙ্গে ভাব জমাতে বসে। পেটে হাত দিয়ে দেখায় বা হাত পাতে কিছু দেবার জন্য। তুলিও তার টিফিন থেকে বাঁচিয়ে কিছু না কিছু রেখে দেয় ওদের জন্য। খাওয়া হলে তিনটি বাচ্চা, হলই বা অসম প্রাণী, মেতে ওঠে নানা গল্পে খেলায়। তুলি এখন ওদের সর্দার; সে ওদের তার স্কুলের গল্প বলে, গান বা কবিতা শেখায়, আর ওরা খালি কিচ-কিচ করে তার প্রত্যুত্তর দেয়। এতে ওদের কারুরই কোনো অসুবিধা হয় না। মা দেখেন আর হাসেন, কিছু বলেন না। এই আসরে নিয়মিত না হলেও একটা কাঠবিড়ালি আর দুটো পাখিও আসে। কাঠবিড়ালিটার সম্প্রতি দুটো ছানা হয়েছে। তুলি তাদের চুমু খেয়ে আদর করেছে। তার কাজ বেড়েছে কারণ রোজ তাদের দেখতে যেতে হয়। যাবার সময় সে মা-কাঠবিড়ালির জন্য দু-তিন টুকরো বাদাম নিয়ে যেতে ভোলেনা।
তুলি মাঝে মাঝে চিড়িয়াখানায় যায় বাবার কোনো একজন পিওনের হাত ধরে। বাড়ির পাশেই চিড়িয়াখানা, বাবার অফিসও বটে। আর পিওনরা তাকে খুব ভালবাসে। তাই মা ওদের সঙ্গে যেতে আপত্তি করেন না। আর এখন তো বাড়িতে অতিথি এলে তুলিই গাইড দার্জিলিং ঘোরার জন্য। চিড়িয়াখানায় দুটো লাল রঙের পান্ডা এসেছে। তুলির কি আনন্দ! সে তাদের নাম দিল হুয়া-বুয়া। কিছুদিন ধরে সে রোজ তাদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। বারবার তাদের নাম ধরে ডাকে। এখন তো এমন অবস্থা, যেদিন তুলি না যায় সেদিন পান্ডাদুটো এমন লম্ফঝম্ফ জুড়ে দেয় যে বাধ্য হয়ে কেউ না কেউ তুলিকে ডেকে নিয়ে আসে। তাকে দেখলেই সব ঠান্ডা।
এভাবেই জীবজন্তুদের ছানাপোনাদের নিয়ে তুলির সংসারযাত্রা এগিয়ে চলে। এইসব বন্ধুদের নিয়ে সে বেশ আছে। এর মধ্যে সে ক’দিন খুব জ্বরে ভুগে উঠল। তার বন্ধুদেরও মন খুব খারাপ। আজ সকাল থেকে তার আর জ্বর আসেনি। শরীর দুর্বল হলেও ঘরে থাকতে ভালো লাগছিল না তার। সে ধীরে ধীরে তাদের বাগানের একটা বড় গাছের তলায় গিয়ে বসল। তাকে দেখে মা কাঠবিড়ালিটা তার দুই ছানাকে নিয়ে সড়াৎ করে নেমে এল। কিচমিচ করে সম্ভাষণ করে জিজ্ঞাসা করল এই ক’দিনের অনুপস্থিতির কারণ; তারপর গায়ে মাথায় উঠে কানের কাছে চুমু খেয়ে অনেক আদর করে চলে গেল। তুলি অলস চোখে নির্মেঘ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। পাহাড়টা কি আকাশের খুব কাছে? আকাশটাকে কি ভীষণ নীল দেখাচ্ছে! আবেশে তুলির চোখটা বুজে এল।
চকচকে রোদ্দুরের মধ্যে প্রজাপতিটা এফুল থেকে ওফুলে ঘুরে ঘুরে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছিল। এদিক দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ দেখে তুলি হাসি হাসি মুখে শুয়ে আছে। ফরফর করে এক পাক দিয়ে তুলির মুখের উপর এসে জিজ্ঞাসা করল, “কিগো বন্ধু, কেমন আছো?” তুলি দেখল, দু’টো পরী তার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ধড়মড় করে উঠে বসতেই, ওমা, বলা নেই কওয়া নেই পরী দু’টো তার হাত দু’দিক থেকে ধরে তাকে নিয়ে উড়তে শুরু করল! তুলি ভয়ে চিৎকার করে উঠল, “পড়ে যাব, পড়ে যাব, ছেড়ে দাও।” পরীরা হেসে বলল, “কেন পড়ে যাবে, আমরা তো তোমায় ধরে আছি। তোমার কি খুব ভয় করছে? তুমি চোখ বন্ধ করে ফেল।” সে তাই করল, আর একটু পরেই শুনল, “চোখ খোলো তুলি, আমরা এসে গেছি।” তুলি চোখ খুলে দেখে, ওমা, এ কোন জায়গা! কি সুন্দর চারদিকে সবুজ। সে ভারী খুশি হয়ে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। সে দেখল তার বন্ধুরা, শালিখ দুটো, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালী তার ছানাপোনা সমেত সবাই হাজির। একজন নতুন বন্ধুকেও দেখতে পেল। একটা মস্ত হরিণ, তার মাথায় অনেক ডালপালা। ওকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সবাই হেসে বলল, “তুলি, ও আমাদের নতুন বন্ধু। ওর নাম রানু। ওর শিং-এর বাহার দেখ!” মজায়, হাসিতে সবাই মেতে উঠল।
এত সুখ বোধহয় বিধাতার সইল না। সবাই যখন গানে গল্পে হৈচৈ করে মেতে রয়েছে, রূপু বাঁদর গাছ বেয়ে বেয়ে হুপহাপ শব্দ করে হাজির হল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “তুলি, শিগগির চল, ওদিকে ধুন্ধুমার লেগে গেছে। তোমাদের বাড়ির পিছনের দিকের গাছগুলো একদল লোক কাটতে এসেছে। তোমার বাবা বাধা দিয়েছেন। তাই ভীষণ চেঁচামেচি হচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।” তুলির সব খেলা নিমেষে ভেঙ্গে গেল। সে ব্যাকুল হয়ে বলল, “আমি কি করে এতো তাড়াতাড়ি যাব। আমি যে রাস্তা চিনিনা।” পরীরা বলল, “তুলি, একটা পাখা পরে নাও। এক্ষুণি পৌঁছে যাবে।” তুলির পিঠে ওরা পাখা জুড়ে দিল। তুলির একটু ভয় ভয় করলেও তা দিয়ে সে সাঁ করে এসে পৌঁছল গন্ডগোলের জায়গায়। মস্ত মস্ত করাত নিয়ে লোকেরা গাছগুলো কাটতে শুরু করেছে। ওরা ওখানে একটা হোটেল করবে বলে জায়গা পরিষ্কার করতে এসেছে। তুলি দৌড়ে গিয়ে একটা বড় গাছকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। চিৎকার করে বলে উঠল, “না, না, এরা সব আমার বন্ধু। এদের কাটতে আমি দেবনা।” একটা হোঁৎকা মতন লোক, গোলগোল চোখ, এসে বলল, “খুকুমনি, বন্ধুদের তো এবার ছাড়তে হবে। আমরা এখানে হোটেল বানাবো। কত আলো জ্বলবে, হৈচৈ হবে, লোকজন গমগম করবে। কতো মজা হবে বলো?” ফুঁপিয়ে উঠে তুলি বলল, “তাহলে তো সব পাখিরা চলে যাবে। ওদের খাওয়া, ঘর কিছুই থাকবে না। আর গাছরাও কি তোমারও বন্ধু নয়? তারা কতো ছায়া দেয়। বাবা বলেছেন ওরা এই বিরাট বিরাট পাহাড়ের মাটি ধরে রেখেছে নিজেদের শিকড় দিয়ে। ওরা সকলের বন্ধু। না না তোমরা ওদের কিছুতেই কাটতে পারবে না।” সে আরো নিবিড় করে গাছটাকে জড়িয়ে ধরল। লোকটা ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে তুলিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ধাক্কা খেয়ে তুলি ছিটকে পড়ল তার মায়ের কোলে। তাকিয়ে দেখে মা তাকে কোলে নিয়ে বলছেন, “তুলি, তুলি কাঁদছিস কেন? আর এখানে এসে কখন থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিস। খেয়ালই করিনি। ইস, স্বপ্ন দেখছিলি নাকি, জ্বর বেড়েছে?” আদর করে মা তার মুখটা মুছিয়ে দিলেন। মায়ের কোলে বসে তুলি দেখল একপাশে একদঙ্গল কাক জটলা করে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু বাকি সব কিছুই আগের মতই আছে। নিশ্চিন্ত মনে মার গলা জড়িয়ে ধরে সে বলল, “মা, ঘরে চল, খিদে পেয়েছে।”