আল্লাহ কোন কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করেননি

“তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত কিছু নিয়োজিত করেছেন?” [সূরা লোকমান  : ২০]
“আকাশ ও পৃথিবী এবং এদের অন্তর্বর্তী কোন কিছুই আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করি নাই।’’ [সূরা আম্বিয়া : ১৬, সূরা দুখান : ৩৮]
উক্ত আয়াতসমূহের দাবি অনুসারে বলা যায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সবকিছুই মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন। বিনা কারণে বা বিনা প্রয়োজনে কোন কিছুই সৃষ্টি করেন নি। তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে বজ্রপাত, ঘূর্ণিঝড়, হিংস্র প্রাণী যেমন বাঘ, সিংহ  অথবা জোঁক-কেঁচোও কি মানুষের উপকারে সৃষ্টি ? নিম্নে আল্লাহর অতি ক্ষুদ্র একটি সৃষ্টির উপকারিতার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো-
জোঁক! কোন একটা অজ্ঞাত কারণে অনেক মানুষই জোঁককে খুব ভয় পায়, জোঁকের কথা শুনেই ভয়ে, আতংকে এবং ঘৃণায় তাদের সারা শরীর রি-রি করে উঠে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, আল্লাহর এই ক্ষুদ্র সৃষ্টি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জোঁক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এতই জনপ্রিয় যে, ১৮৬৪ সালে শুধুমাত্র ফ্রান্সেই ২-৩ কোটি জোঁক আমদানি করা হয়। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ছয় শ’ ধরণের জোঁক রয়েছে। জোঁক একেবারে ছোট কয়েক মিলিমিটার থেকে শুরু করে প্রায় এক হাত পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এদের গঠন খুবই সহজ ও সরল। এদের দেহের এক পাশে মুখ আর অন্য পাশে বহির্গমণ পথ। এ দুটি আবার চুষণির মতো, শক্ত করে আকড়ে ধরে রাখতে পারে। জোঁকের চোয়াল ৩টি, তিন চোয়ালে তিন পাটি দাঁত। জোঁকের লালা খুব গুরত্বপূর্ণ। এটি নিয়ে এখনও অনেক গবেষণা চলছে।
জোঁক যখন কোনো প্রাণীকে ধরে রক্ত খাওয়ার জন্য, সে স্থানটা কেটে ফেললে সেই প্রাণি কোন ব্যথা পায় না। কারণ জোঁকের লালায় যে রাসায়নিক দ্রব্য থাকে তা ব্যথা নিবারণকারী। শুধু তাই নয় রক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য রক্ত যেন জমাট বেঁধে না থাকে তার ব্যবস্থাও আছে জোঁকের লালায়। জোঁকের লালাতে থাকে ঐরৎঁফরহ নামক রাসায়নিক পদার্থ যা রক্ত জমাট বাঁধতে বাঁধা দেয় এবং জমাট রক্ত তরল করে দেয়। জোঁকের লালার অন্যান্য উপাদান রক্তনালীকে প্রসারিত করে।
জোঁক নিশ্বাস নেয় তার শরীর দিয়ে। যে সকল জোঁক পানিতে থাকে তারা পানি থেকে অক্সিজেন নেয় তার শরীর দিয়ে। তাই পানিতে অক্সিজেন কমে গেলে তাদের উপরে উঠে আসতে হয়। নিম্ন চাপের সময় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে আসে বলে জোঁকেরা তখন উপরে উঠে আসে।
প্রাচীন আবহাওয়াবিদগণ অনেক সময় এই জোঁকদের দেখে আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বানী করতেন।
প্রাচীন কালে প্রায় সব রোগেই জোঁক ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন সে রকম নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন শরীরের ভিতরে কি হয় তার খুঁটিনাটি আরো ভালোভবে জানে। তাই জোঁককে এখন সত্যিকার সমস্যা সমাধানে লাগাতে পারে। এরকম একটি সমস্যা হচ্ছে শরীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন। ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন শহরে পাঁচ বছরের একটি ছোট বাচ্চার একটা কান কুকুর কামড়ে আলাদা করে ফেলেছিল। ডাক্তাররা দীর্ঘ সময় ধরে অপারেশন করে কানটি পুনস্থাপন করতে সমর্থ হয় ঠিকই, কিন্তু একটা সমস্যাও থেকে যায়। রক্ত সঞ্চালনের জন্য ধমনি, শিরা-উপশিরাগুলো যতটুকু সম্ভব জোড়া দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিকভাবে কাজ করছিলো না। কারণ ছিন্নভিন্ন ধমনি, শিরা-উপশিরাগুলো থাকে দুর্বল এবং তার ভিতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে চায় না। বস্টনের হাসপাতালের সার্জনরা তখন বাচ্চাটির কানে কয়েকটা জোঁক লাগিয়ে দেন। ক্ষুধার্ত জোঁকগুলো জমা হয়ে থাকা রক্ত খেয়ে ক্ষতস্থানটির আরোগ্যলাভে সহায়তা করলো। শুধু তাই নয়, জোঁকগুলো রক্ত টেনে নিচ্ছিল বলে সেখানে পর্যাপ্ত রক্তও সঞ্চালিত হচ্ছিল। তাই ক্ষতস্থানটা আরোগ্য লাভ করলো অনেক দ্রুত। (সুবহানাল্লাহ)।
এছাড়াও দূর্ঘটনায় কেটে যাওয়া আঙ্গগুলো পুনস্থাপনে জোঁক ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক সার্জারী, মাইক্রো সার্জারীতেও জোঁক ব্যাবহার করা হয়।
যে সকল রোগীদের শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যায় তাদেরকে হেপারিন ইনজেকশন আকারে দেওয়া হয়। আর যাদের হেপারিন এর প্রতি এলার্জিক তাদের জন্য ঐরৎঁফরহ   প্রয়োগ করা হয় যা জোঁকের দেহ থেকে সংগ্রহ করা হয়।
উপরোক্ত ক্ষেত্রসমূহ ছাড়াও আরো যেসব রোগে জোঁক ব্যাবহার করা যেতে পারে তার একটি তালিকা নিম্নরূপ-
–    রিউমেটিজম বা বাতরোগ
–    হারপিস জোস্টার
–    ভ্যারিকোসিস
–    টিনাইটিস
–    থ্রম্বোসিস
–    ফোঁড়া
–    নালীতে ঘা
–    টনসিলে ফোঁড়া
–    গল ব্লাডার প্রদাহ
–    রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারী
–    ধমনীতে প্রদাহ
–    হাড়ের জোড়া ব্যথা
–    অস্থি-সন্ধি প্রদাহ
–    টেন্ডিনাইটিস
–    হাইপারটোনিয়া
–    এপোপ্লেক্সি
–    এনজাইনা পেক্টোরিস
–    থ্রম্বোফ্লিবাইটিস
আল্লাহর অতি নগন্য এই সৃষ্টির মাঝেও মানবজাতির জন্য রয়েছে বিস্ময়কর কল্যাণ। আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমাদের প্রতি কতই না সদয়।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অপার করুনার আরো একটি উদাহরণ তাঁর অপর এক ক্ষুদ্র সৃষ্টি মাছি।
মাছি : মানুষের শরীরের কোন অংশে যখন পচন ধরে যায়, তখন অপারেশন করে সেটা পরিস্কার করা খুব সহজ নয়। তার চাইতে অনেক কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে মাছির ডিম ঢুকিয়ে দেয়া। সেই ডিম থেকে (লার্ভা) কৃমি বের হয়ে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে সেগুলো বেছে বেছে পঁচা মাংস খেয়ে একসময় মাছি হয়ে উড়ে বের হয়ে যায়! বর্ণনা শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যিই এটা করা হয় এবং মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা সত্যিকার ডাক্তাররাই তা করেন। মহান আল্লাহ তার সৃষ্টি জগতে আমাদের জন্য কত কল্যাণ রেখেছেন। কোন কিছুই আল্লাহ অনর্থক সৃষ্টি করেন নি। (সুবহানাল্লাহ)।
কেঁচো! একে আমরা প্রায় অপ্রয়োজনীয় মনে করি। কিন্তু নীরবে নিভৃতে এই ছোট মেরুদন্ডহীন প্রাণীটিই আমাদের অনেক উপকার করে যাচ্ছে। যমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য  অতিপ্রয়োজনীয় উপাদান হলো নাইট্রোজেন। বাতাসের নাইট্রোজেন সরাসরি মাটিতে আসে না। এই নাইট্রোজেনকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে জমিতে সংবন্ধন করতে হয়। কেঁচো রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে বাতাসের মুক্ত নাইট্রোজেনকে সংবন্ধন করে মাটিতে নিয়ে আসে। এভাবে কেঁচো মাটিকে উর্বর করে। ঘাস লতাপাতা পঁচিয়ে কমপোস্ট সার তৈরি করে। এই সার কেঁচো কমপোস্ট সার নামে পরিচিত। কেঁচো মাটিকে নরম করে। এই অনন্য গুণের জন্য কেঁচোকে বলা হয় প্রকৃতির লাঙ্গল।
আল্লাহর সৃষ্টি জগতের অসংখ্য সৃষ্টির মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। তাঁর এই সৃষ্টির আরো অনেক উপকারিতাই হয়তো আমরা এখনো জানতে পারি নি, আমাদের অগোচরেই রয়ে গেছে। পরম করুণাময় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শ্রেষ্ঠত্ব, মহাত্ব, তাঁর দয়া ও করুণা তাঁর সৃষ্টির মাঝেই বিরাজমান। আল্লাহ যেন আমাদেরকে সেই উপকারী জ্ঞান দান করেন যাতে আমরা তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন-“নিশ্চয়ই আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে এবং দিন ও রাতের পরিবর্তনে জ্ঞানীদের জন্য স্পষ্ট নিদর্শনাবলি রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও যমীনের সৃষ্টি বিষয়ে চিন্তা করে এবং বলে যে, হে আমাদের রব! তুমি এটি বৃথা সৃষ্টি করো নি; তুমিই পবিত্রতম, তুমি আমাদের দোযখ হতে রক্ষা করো।’’ [সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১]
তথ্যসূত্র :
‘অভিযোগের জবাবে কুরআন ও বিজ্ঞান’- ড. শাহ মুহাম্মদ হেমায়েত উল্লাহ।
‘আরো একটুখানি বিজ্ঞান’- ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!