যিনি ইতিহাস গড়লেন

নাম ফুযাইল বিন আয়ায। পেশায় একজন ডাকাত। কিন্তু আল্লাহর কৃপায় তিনি একদিন এ মহাঘৃণ্য পেশা থেকে মুক্তি পেলেন। পরিবর্তন হলো তার জীবন পথ। বনে গেলেন বিখ্যাত মুহাদ্দিস। এখন হাতে তরবারী নিয়ে রাতের আঁধারে মানুষ হত্যা করে সম্পদ লুট নয়; বরং নূরানী পরিবেশে মানুষর মাঝে তিনি দ্বীনের আলো ছড়ান। শত শত মানুষ তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত। হাজার হাজার মানুষ তাঁর জ্ঞান-গরিমায় মুগ্ধ। তাঁর একটি হাদীস শুনার জন্য লক্ষ ছাত্রের ভীড় জমে মক্কার মসজিদে হারামে। তাহলে কীভাবে তিনি ফিরে এলেন সে অন্ধকার জগত থেকে আলোর দিগন্তে? কীভাবে সম্ভব হলো এমন নোংড়া জীবন পরিহার করে পবিত্র জীবন গ্রহণ করা?
হ্যাঁ, আপনাদেরকে তাঁর সেই পরিবর্তিত জীবন কাহিনীই শুনাবো।
ঘটনার সূত্রপাত
পেশায় ডাকাত হলেও কী মনে কোন এক যুবতি মেয়ের প্রেমে পড়লেন। পছন্দ করেছেন তো হয়েছে। তাকে ছাড়া তিনি যেন অন্য কিছু ভাবতেই পারেন না। শুরু হলো তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্নের ডানায় ভর করে স্বপ্নরাজ্যে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। সাথে কত শত প্লান আর ছঁক আকা। একটাই চিন্তা কীভাবে তাকে বশে আনা যায়? হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো। আচ্ছা রাতের আঁধারে মেয়েটির বাড়ির প্রাচীর টপকে ভীতরে ঢুকে মনের কথাটা বলে আসলে কেমন হয়? কারণ দিনের বেলায় তো আর এমন কোন সুযোগ পাওয়া সম্ভব না। যেই ভাবা সেই কাজ। সেদিন রাতেই রওয়ানা করলেন মেয়েটির বাড়ির দিকে। চারি দিকে ঘন অন্ধকার তবে হালকা মৃদুমন্দ বায়ু বইছে। আজ যেন তাঁর কাছে নিজেকে অন্যকম লাগছে। কারণ আজ সে মেয়েটিকে মনের জমানো কথাগুলো সব খুলে বলবে। আজ সে সরাসরি মেয়েটির সাথে সাক্ষাত করবে। এমন সব হাজার স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছিলো তার মনের জানালায়। আর তিনি হারিয়ে যাচ্ছিলেন অজানার দেশে- স্বপ্নপুরে। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলেন। ভাবলেন সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। কালক্ষেপণ না করে, নিঃসঙ্কোচে প্রাচীরের সামনে দাঁড়ালেন। বিশাল প্রাচীর। শুরু হলো প্রাচীরে আরোহণের চেষ্টা। একবার। দু’বার। তৃতীয়বার ঠিকই সক্ষম হলেন প্রাচীরের উপরে উঠতে। কিন্তু! হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো সুললিত কণ্ঠে কুরআনে কারিমের মধুর তেলাওয়াত কেমন যেন আবেগ মাখা সুর। মনে হচ্ছে হৃদয়ের সব দরদ উজাড় করে দিয়ে তেলাওয়াত করছে। তিনি তন্ময় হলেন। ভালো করে মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আয়াতটি  أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ“যারা ঈমান আনে তাদের হৃদয়ে ভক্তি বিগলিত হওয়ার সময় কি আসে নাই, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে?” [সূরা হাদিদ : ১৬]
এতটুকু শুনেই তার হৃদয় রাজ্য দোলা লাগলো। মনের মধ্যে সত্যের সু-বাতাস বইতে শুরু করলো। এতো দৈব্যবাণী! সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হে আমার প্রতিপালক! হ্যাঁ, সময় এসেছে নিজেকে বদলাবার। আর নয়, আমি লাববাইক বললাম হে আমার প্রভু! আমি আপনার সুমহান দরবারে আত্মসমর্পণ করলাম। ভুলে গেলেন সব ফন্দি। হারিয়ে গেলেন ভাবনার দরিয়ায় দূরে বহুদূরে। যিনি রাতের আঁধারে ত্রাস। লোকেরা যার ভয়ে রাত্রিবেলা পথে ঘাটে পথ চলতে সাহস করে না। আজ সেই ফুযাইল নিজেকে কোথায় লুকাবে স্থির করতে পারছিলেন না। তিনি পেরেশান। হঠাৎ রাতের আন্ধকারের মধ্য দিয়ে তারার আলোয় কিছুদূরে একটি ভাঙ্গা দালান দেখে সেখানেই ছুটে গেলেন। বাড়িটি অনেক পুরাণ। দেয়ালগুলো ধ্বংস প্রায়। ক্ষণে ক্ষণে শুনা যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার কৌতূহলি ডাক। আর পত্র-পল্লবের মর্মর ধ্বনি। যেখানে ডাকাতি শেষে ফুযাইলের আরামের বিছানা আর মনোরম বাড়িতে ফিরে যাবার কথা। আজ তিনি ভয়ে বাড়ি না ফিরে জীর্ণশীর্ণ একটি পুরাণ বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাবেন। সতর্কতার সাথে ভয়ে ভয়ে বাড়িটিতে প্রবেশ করলেন। ইচ্ছে এক কোনে নিজেকে লুকিয়ে রাতটি পার করা। ওদিকে কেউ দেখে ফেলে কী না এই চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ ঘটলো আরেক কাণ্ড। মানুষের ফিস ফিসানির আওয়াজ! তিনি তো ভয়ে একেবারে জড়সড়। ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করলেন লোকগুলো কারা। তারা অন্য ডাকাত দল না তারই খোঁজে আসা প্রহরীদল। লোকগুলো পরস্পর কী যেন বলাবলি করছে। তিনি সাহস যোগিয়ে তাদের কথাগুলো ভালো করে বুঝার চেষ্টা করলেন। খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। এবার তার ভুল ভাঙ্গলো। তাদের একদল বলছে, চলো এবার রওয়ানা করা যাক। অনেক বিশ্রাম হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই কাফেলার অন্য লোকেরা বাঁধা দিয়ে বললো। না কাফেলা রওয়ানা করে শুধু শুধু নিজেদের ওপর বিপদ টেনে আনা ঠিক হবে না। কারণ আর কারো হাত থেকে রেহাই পেলেও ফুযাইল ঠিকই আমাদের ওপর আক্রমণ করে সকল মালামাল ছিনিয়ে নিবে। এবার আর তার বুঝতে বাকি রইলোনা। এরা তারই ভয়ে আশ্রয় নেওয়া একদল মুসাফির। শতশত মানুষ হত্যা করে মাল লুট করতে যার হাত কোন দিন সামান্য কাঁপেনি, ঝড়েনি এক ফুটা অশ্র“। তিনি আজ নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না; কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। দু’গাল বেয়ে অশ্র“ গড়িয়ে পড়লো। অঝোরে কান্না করলেন। কেন যেন আজ মনকে সামলাতে পারছেনা। চোখের পানিতে দাড়ি ভিঁজে গেল। নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো। তিনি নিজেকে ভর্ৎসনা করে বললেন, তুমি তো আল্লাহর গোলাম গোলামি করে তাঁর মনোরঞ্জন করাই তোমার দায়িত্ব। তুমি কীভাবে তাঁর অবাধ্য হলে? কীভাবে অন্যায় অপরাধে নিজেকে জড়ালে? আজ তোমার ভয়ে ভীত হয়ে নির্জন এলাকায় একদল মুসাফির রাত কাটাবে? না, না, এ হতে পারে না। হে আল্লাহ! আমি নিজেকে আপনার হাতে সঁপে দিলাম। আমি আপনার নিকট আত্মসমর্পণ করলাম। দয়া করে আপনার পবিত্র কাবাগৃহে আমাকে আশ্রয় দান করুন হে দয়াময়। সত্যিই আল্লাহ তা’আলা এই পবিত্র দিলের ডাক উপেক্ষা করতে পারলেন না। রহমতের কোলে টেনে নিয়ে দান করলেন পবিত্র জীবন। ফিরে গেলেন তিনি আপন গৃহে। তবে আজকের প্রত্যাবর্তন অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন; আজকের আগমন অন্য দিনের চেয়ে শ্রেয়। অন্য দিন আসতেন লুটের মাল নিয়ে; তবে আজ এলেন খালি হাতে। তবুও হৃদয় ভীষণ পোলক; মনে অজানা প্রশান্তি। সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেকে বদলে ফেলবেন; দ্বীনে ইল্ম অর্জন করে ধন্য হবেন। আর নয় বিপথে সময় নষ্ট করা। সব প্রস্তুতি শেষে পরদিন রওয়ানা করলেন ইল্ম অন্বেষণের জন্য বিখ্যাত বাগদাদ শহরের কুফা নগরীর দিকে। ছেড়ে গেলেন নিজের জন্মভূমি সমরকন্দ আর ছোট কালের স্মৃতি বিজড়িত আবওয়ারদ এলাকা। কত শত স্মৃতি পেছনে ফেলে পৌঁছলেন জ্ঞানের শহর কুফায়। শুরু হলো হাদীস চর্চা। মানসুর রহ. আ’মাশ রহ. আতা বিন সাইব রহ. এবং ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল আনসারির রহ. মত আরো অনেক বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ থেকে হাদীস লিপিবদ্ধ করণ। এক সময় ইলম পি
পাসা নিবারণ করে শুরু হলো হাদীসের দরস। দীর্ঘ দিন হাদীসের খেদমত করলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন মোবারক রহ. ইয়াহইয়া আল কাততান রহ., ইবনে উয়াইনা রহ. এবং ইমাম শাফেয়ি রহ. সহ আরো অনেকে। এ ছাড়াও তাঁর সনদে হাদীস বর্ণনা করেছেন সিহাহ সিত্তার সকলেই (ইমাম ইবনে মাজা রহ. ছাড়া)। ইতিহাসের এ মহামনীষী ১৮৭ হিজরিতে খলীফা হারুনুর রশিদ রহ. এর শাসনামলে লাখো ছাত্র আর ভক্তবৃন্দ রেখে মক্কায় ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাযিয়ূন)।
সংক্ষেপে এ মহান মানবের পরিচয় :
নাম : ইমাম আল ফুযাইল
পিতার নাম : অয়্যায
পিতামহের নাম : মাসউদ
উপাধি : শায়খুল ইসলাম
উপনাম : আবু আলি।
খুরাসানের বিখ্যাত সমরকন্দ নগরীতে তাঁর জন্ম। শৈশব কেটেছে আবিওয়ারদ নামক এলাকায়। ইলম চর্চা ইরাকের রাজধানী বাগদাদ শহরের বিখ্যাত কুফা নগরীতে। তারপর মক্কায় গমন এবং সেখানেই স্থায়ী বসবাস।
শেষকথা : ক্ষণজন্মা এ মহা মনীষী অনেক আগেই ছেড়ে গিয়েছেন আমাদেরকে। তবে তিনি ইতিহাস গড়ে গেলেন আর রেখে গেলেন আমাদের জন্য মহাআদর্শ। কীভাবে প্রভুর ডাকে সাড়া দিতে হয়। কীভাবে জীবনকে বদলাতে হয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে এ মহান মনীষীর জীবন ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন এবং আল্লাহ তাঁর এই মুত্তাকি বান্দাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!