বিনয়ের মূর্তপ্রতীক

৮৪৯হিজরির গ্রীষ্মের এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। অন্যান্য দিনের মত আজও দামেশকের কেন্দ্রীয় মসজিদে সমবেত হয়েছে আপামর জন-সাধারণ। এদের কেউ জিকিরে নিমগ্ন, কেউবা নামাযে নিবিষ্ট-চিত্ত, কেউ হাদীসের দরসে চৌকান্না, কেউবা ফিকহের মজলিসে উৎকর্ণ। ওদিকে মসজিদের পূর্ব পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক; গায়ে তার জীর্ণবস্ত্র, ক্ষুধায় শীর্ণ তার দেহ। উস্ক চুল, উদাস দৃষ্টি। কখনো হতবাক হয়ে দেখছে মসজিদের সৌন্দর্য ও সৌকর্য। কখনো অপলক তাকিয়ে আছে আগত মুসল্লিদের পানে। তার এই অনন্ত প্রসারী দৃষ্টি তাকে নিয়ে যাচ্ছে সময়ের বালুচরে আবৃত-প্রায় অতীত থেকে সুদূর অতীতের দিকে। সে ডুবে যাচ্ছে ইসলামের উত্থান ও বিশ্ব-জয়ের স্নিগ্ধ ইতিহাসের অথৈ সাগরে।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে মসজিদে প্রবেশ করল এক গ্রাম্য লোক। জটিল এক মাসআলার সঠিক সমাধান প্রয়োজন তার। সে মসজিদের সকল আসরে উঁকি দিয়ে তার মাসআলাটি উপস্থাপন করল। কিন্তু কেউ তার সমাধান দিতে পারল না। নিরাশ হয়ে লোকটি মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন পূর্বপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তাকে ইশারায় কাছে ডেকে বলল, বলো তো তোমার মাসআলাটি, দেখি এর কোন সমাধান দিতে পারি কিনা। তার কথায় গ্রাম্য লোকটি  হেসে ফেলল এবং চিৎকার করে বলল, দেখো, এই পাগল কী বলে! বিশিষ্ট মুফতিরা যার সমাধান দিতে পারেনি সে নাকি তার সমাধান দিবে। তার চিৎকারে মুহূর্তেই চারপাশে কৌতূহলী লোকের ভিড় জমে গেল। তাদের একেকজন একেক মন্তব্য ছুড়ে দিতে লাগল। কেউ বলল, তাকে ছেড়ে দাও! সে তো পাগল। কেউ বলল, তুমি তাকে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করে দেখো, হয়ত তার কাছে এর কোন সমাধান থাকতে পারে। আবার কেউ বলল, সে যা বলে তা শোনে মুফতিগণের কাছে বিষয়টি জিজ্ঞাসা করে দেখো।
গ্রাম্য লোকটি তাকে আবার জিজ্ঞাসা করল, তুমি কী পারবে এর সমাধান দিতে? সে বলল, আল্লাহর সাহায্য কামনা করছি। তখন লোকটি তার মাসআলা তার সামনে উপস্থাপন করল। সে অতি সাধারণভাবে তার অসাধারণ সমাধান বলে দিল। এবার সে ছুটে চলল মুফতিগণের  বৈঠকের দিকে। কৌতূহলী লোকজনও ছুটে চলল তার পিছু পিছু। মুফতিগণ তার সমাধান শোনে যারপরনাই বিষ্মিত হলেন। এবং লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা জলদি তাকে এখানে নিয়ে আসো। নিঃসন্দেহে সে গভীর ইলমের অধিকারী। হয়ত আল্লাহ তা’আলা ইলমের নিগূঢ় রহস্য উম্মোচনের জন্যই তাকে আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন। লোকেরা বলল, সে তো চলে গেছে। মুফতিগণ বললেন, তোমাদের কেউকি তাকে চেনো? এক লোক দাঁড়িয়ে বলল, আমি তাকে কয়দিন যাবত সিমসাতিয়ার খানকায় দেখছি। প্রথমে সে খানকার আশপাশ ঝাড়– দিত আর দরজার সামনে পড়ে থাকত। ইদানিং তাকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তারা বললেন, জলদি তুমি আমাদেরকে তার কাছে নিয়ে চলো।
খানকায় পৌঁছে তারা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? তিনি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন, আমি একজন সাধারণ মানুষ। তারা বললেন, আমরা আপনার বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান শোনেছি এবং আপনার ইলমের গভীরতা ও শ্রেষ্ঠত্ব আন্দাজ করে ফেলেছি। আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, আপনার প্রকৃত পরিচয়টা জানিয়ে আমাদের কৌতূহল নিবারণ করুণ। তিনি বললেন, ইন্নালিল্লাহী ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিয়ূন! আপনারা এভাবে আল্লাহর দোহাই দিয়ে ফেললেন! তাহলে শুনুন বলছি, আমি হলাম, আবু হাশেম গাজালী। সমবেত জনতা সমস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালী আপনি! এই বলে তারা তাঁর হাতে চুমু খেতে উপচে পড়ল। এবং জোরালো আবদার জানিয়ে বলল, আপনি আগামীকাল থেকে আমাদেরকে দরস দেবেন। কিন্তু পরের দিন খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি দামেশ্ক ছেড়ে চলে গেছেন।
[কাসাসুম-মিনাত্-তারিখ- পৃ.২৮৫-২৯২ (সংক্ষিপ্ত)]
আকাশ কাঁদে যার শোকে
বিশিষ্ট তাবেয়ী হারেস ইবনে হাইয়্যান। দুনিয়া বিমুখতা ও আখেরাতমুখিতার এক বিরল দৃষ্টান্ত। জাহান্নামের ভয়ে তার অন্তর পুরে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। বিনিদ্র রজনীর অবিশ্রাম আহাজারি তার স্বভাব-কর্মে পরিণত হয়েছিল। তার সাধারণ জীবনের অসাধারণ কিছু ঘটনা নিয়ে উদ্ধৃত হলো।
একবার হুমামাতুত দাউসী নামক এক সাহাবি তাকে দেখতে গেলেন। রাতের আাঁধার যখন ঘনিয়ে এলো হারেম বিন হাইয়্যানের আহাজারিও শুরু হলে গেলো। দু’গাল বেয়ে ঝর্ণার মত প্রবাহিত হতে লাগল তপ্ত অশ্র“। অবশেষে ভোরের আলো তার অবিরাম কান্নায় রেখা টানল। সাহাবি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সারারাত তুমি এভাবে কাঁদলে কেন? তিনি বললেন, আজকে আমার সেই রাতের কথা মনে পড়েছিল; যার প্রভাত আকাশের এই  তারকাগুলোকে টুকরো টুকরো করে জমীনে ফেলে দেবে। পাহাড় পর্বত গুড়ো করে তুলারমত উড়াবে। সেই বিভীষিকাময় দিবসের কথা স্মরণ করেই আমি কাঁদলাম।
আরেকবারের ঘটনা : তার সততা ও সত্যবাদিতা, জ্ঞান ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু আখেরাতের স্থায়ী নেতৃত্ব যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তিনি কিভাবে নিকৃষ্ট দৃনিয়ার অস্থায়ী নেতৃত্বে সম্মত হবেন! তাই এই দায়িত্ব থেকে মুক্তি লাভের জন্য তিনি এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। লোকেরা যে পথে তার কাছে আগমন করবে তিনি সেই পথে বিশাল অগ্নিকুণ্ড তৈরি করলেন। এরপর সম্প্রদায়ের লোকেরা যখন তার কাছে আসল তখন তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, স্বাগতম, হে আমার সম্প্রদায়! আসো তোমরা আমার কাছে। লোকেরা বলল, আমরা তো আপনার কাছে পৌঁছতে পারছিনা, অগ্নিকুণ্ড আমাদের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। তখন তিনি বললেন, তোমরা তো আমাকে এর চেয়েও কঠিন অগ্নিতে নিক্ষেপ করতে চাচ্ছ। সম্প্রদায়ের লোকেরা তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ফিরে গেলো।
দুনিয়া বিরাগী সেই মহা-মানব গ্রীষ্মকালে মৃত্যু বরণ করেন। দাফন কার্য শেষ হলে একখণ্ড মেঘ এসে তার কবরের ওপর স্থির হয়ে যায় এবং অঝোর ধারায় শোকাশ্র“ বর্ষণ করে। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হলো এক ফোটা পানিও তার কবরে প্রবেশ করেনি। [আজ্জুহ্হাদু মিয়াহ- পৃ.৮৯]
নগদপুরুস্কার
প্রিয়নবীর এক প্রিয় সাহাবি, নাম তার হামেদ আল-লাফাফ। এক শুক্রবারের ঘটনা; জুমআর নামাজের আর বেশি সময় বাকী নেই। এই মুহূর্তে বাড়ির পোষ্য গাধাটি অজানা-গন্তব্যে উধাও হয়ে গেল। ওদিকে আটার কলে পড়ে আছে তার একমাত্র খাদ্য আটা। সেটা না আনলে আজ চুলায় আগুনই জ্বলবে না। আবার ফসলের জমিটা পানি শূন্যতায় ফেটে চৌচির হয়ে আছে। তাতে পানি সিঞ্চন করাও আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ত্রিমুখী কাজের চাপ আর অত্যাসন্ন জুমআর নামায তার মস্তিস্কে মিছিল শুরু করল।
তিনি নীরবে কিছুক্ষণ ভাবলেন, এরপর জাগতিক কর্মগুলোকে পদাঘাত করে ছুটে গেলেন মসজিদ পানে; প্রভুর সন্তুষ্টি ও আত্মিক প্রশান্তি লাভের উদ্দেশ্যে।
নামায শেষ হল। অফুরন্ত প্রশান্তি নিয়ে তিনি মসজিদ থেকে বের হলেন। এরপর প্রথমেই তিনি ক্ষেতের কাছে গেলেন, এবং শুষ্ক জমি পানিতে টইটুম্বুর দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হলেন। অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন; পাশের জমির মালিক আপন ক্ষেতে পানির লাইন ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ছিলেন, ফলে পানি উপচে পড়ে তার জমিটাও সিঞ্চিত হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে দেখেন গাধাটি আস্তাবলে সুন্দর করে বাধা। আশ্চর্য বটে! ভেতরে প্রবেশ করে দেখন স্ত্রী রুটি তৈরিতে ব্যস্ত। আবার অবাক হওয়ার পালা। শশব্যস্ত হয়ে তিনি স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন কীভাবে কী হল। উত্তরে সে বলল, হঠাৎ আমি গেটে কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। গেট খুলে দিতেই গাধাটি বাড়িতে ঢুকে পড়ল। ওদিকে এক প্রতিবেশীর আটা কলে পড়ে ছিল সে তার আটা আনতে গিয়ে ভুলে আমাদের আটা নিয়ে আসে। পরে বুঝতে পেরে আমাদের আটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়। স্ত্রীর বক্তব্য শোনে হামেদ রা. আকাশের দিকে মাথা উত্তোলন করে হৃদয়ের গভীর থেকে মহান প্রভুর কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন, আর বিড়বিড় করে বললেন, হে আল্লাহ! আমি আপনার মাত্র একটি কর্ম সমাধা করেছি আর আপনি আমার তিন-তিনটি প্রয়োজন সমাধা করে দিয়েছেন। সত্যি আপনি মহা ক্ষমতাবান দয়ালু। [আল- কাসাসুল আদাবিয়াহ : পৃ. ২৮০, ২৮১]
অগ্নি পরীক্ষা
ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা. এর ইন্তেকালের পর সারা আরবে এক ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। অনেকে ইসলামের বিধান অস্বীকার করে বসে, অনেকে আবার মিথ্যা-নবুওয়াতের দাবী করে অনর্থক কোলাহল সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে ইয়ামানের আসওয়াদ আনাসী অন্যতম। সে তার দাবীর স্বপক্ষে জন-সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। স্বার্থান্বেষী, ভোগপূজারী কিছু লোক তাকে সমর্থণও করে। এতে তার ‘নবুওয়াতের’ পাওয়ার বহুগুণ বেড়ে যায়। একদিন সে বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু মুসলিম খাওলীনী রহ. কে ডেকে স্বীয় দাবীর স্বপক্ষে সমর্থণ আদায়ের লক্ষে বলল, ‘তুমি কি সাক্ষ্য দাওযে, আমি আল্লাহর রাসূল’? তিনি বললেন, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিনা। সে আবার একই প্রশ্ন করল। তিনি ও একই উত্তর দিলেন, আবু মুসলিম খাওলানীর এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে কথিত ‘নবী’ অসন্তুষ্ট হলো এবং তার জন্য অগ্নিকুন্ড তৈরির নির্দেশ দিল। এরপর জীবন্ত আবু মুসলিম খাওলানীকে তাতে নিক্ষেপ করল। কিন্তু অবাধ্য আগুন ‘নবীর’ নির্দেশ লঙ্ঘন করে আপন স্রষ্টার নির্দেশে আরামদায়ক ঠান্ডা হয়ে গেল। আর, তিনি ইবরাহীম আ. এর মত নিরাপদে অগ্নিকুন্ড থেকে সদর্পে বেরিয়ে এলেন।
তার জীবনের আরেকটি বিষ্ময়কর ঘটনা : একদিন তার স্ত্রী তাকে বলল, হে আবু মুসলিম! বাড়িতে তো খাবারের কিছুই নাই। তিনি বললেন, তোমার কাছে কি টাকা পয়সা কিছু আছে? স্ত্রী বললেন, আমার কাছে সুতা বিক্রির একটি দিরহাম আছে। তিনি বলনে তাই দাও। এরপর তিনি সেই দিরহাম নিয়ে বাজারে প্রবেশ করলেন। তখন এক ভিক্ষুক সামনে দাঁড়িয়ে বলল, হে আবু মুসলিম দয়া করে আমাকে কিছু দাও। তিনি সাথে সাথে দিরহামটি বের করে তাকে দিয়ে দিলেন। এরপর কাঠের গুড়া ও বালু দিয়ে থলের ভার বাড়িয়ে পথে পা বাড়ালেন। দুরু দুরু বুকে তিনি দরজার কড়া নাড়লেন। অপেক্ষমাণ স্ত্রী সাথে সাথে দরজা খুলে দিল। তিনি থলেটি দরজার সামনে রেখে কোন কথা না বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। রাতে যখন তিনি বাড়ি ফিরলেন তখন স্ত্রী গরম রুটি এনে তার সামনে পেশ করল। তিনি ব্যস্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কোত্থেকে এলো? স্ত্রী অবাক হয়ে বলল, কেন, আপনিই তো তখন আটাভর্তি থলে রেখে গেলেন। আবু মুসলিম খাওলানী আর অশ্র“ সংবরণ করতে পারলেন না। রবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আখিদ্বয় তার ছলছল করে উঠল। [আজজুহহাদু মিয়াহ্ : পৃ. ৯৮, ১০০]

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!