বাদশাহ সোলায়মান বিন আব্দুল মালিকের যুগের কথা। রাক্কা নামক এক শহরে বনু আসাদ গোত্রের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিল। নাম তার খুজায়মা বিন বিশর। পাহাড়সম আত্মমর্যাদাবোধ আর আকাশসম উদারতা ছিল তার স্বভাব বৈশিষ্ট্য। কোনো ভিক্ষুককে খালি ফেরত দিতেন না। হাত উজাড় করে অকাতরে সম্পদ বিলিয়ে দিতেন গরিব-দুঃখীদের মাঝে। কোনো মুখাপেক্ষীকে বঞ্চিত করতেন না। বেহিসাব মাল ঢাললে নাকি সাত রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। তার জীবনেও এর ব্যতিক্রম ঘটল না। এভাবে অকাতরে দান করতে করতে একদিন তার সমুদয় অর্থ নিঃশেষ হয়ে গেল। ফলে তার উপরের হাত নিচে চলে এলো—দাতা থেকে গ্রহিতার তালিকায় উঠে এলো তার নাম।
বিগত দিনের শুভার্থীরা কিছু দিন তাকে সহায়তা করে ধীরে ধীরে হাত গুটিয়ে নিল। ফলে তার আত্মমর্যাদাবোধ চরমভাবে আহত হলো। তিনি স্ত্রীকে বললেন—
“তুমি তোমার বাপের বাড়ি চলে যাও, আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে মৃত্যু কিংবা মুক্তির অপেক্ষায় বসে থাকব।”
কিন্তু স্ত্রী তাকে অবাক করে দিয়ে বলল—
“আমি শুধু তোমার সুখের সঙ্গী নই, দুঃখেরও। আমৃত্যু আমি তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি বেঁচে থাকলে আমিও বেঁচে থাকব, তুমি মরে গেলে আমিও মরে যাব।”
স্বামী এবার তাকে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। অল্প কয়েক দিনেই তাদের কাছে থাকা খাবার নিঃশেষ হয়ে গেল। এবার তারা মৃত্যুর অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ইকরামাতুল ফাইয়াজ নামক এক মহৎ লোক ছিল ঐ অঞ্চলের তখনকার গভর্নর। তার উদারতা ও দানশীলতার কারণে লোকে তাকে “ফাইয়াজ” বলে ডাকত। একদিন তিনি তার দরবারের লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন—
“খুজায়মা বিন বিশর এখন কোথায়, কী করে?”
তারা বলল—
“বেশ কিছু দিন হলো আমাদের কারো সাথে তার সাক্ষাৎ হয় না। হয়তো সে কোথাও সফরে আছে।”
তখন উপস্থিত জনতার একজন বলল—
“সে মূলত এ অঞ্চলেই আছে, কিন্তু দান করতে করতে তার অর্থ-সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় এখন সে ঘরের দরজা বন্ধ করে মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে আছে।”
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—
“কেন? কেউ কি তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি? ধনাঢ্য লোকের সংখ্যা কি শূন্যে নেমে গেছে?”
লোকটি বলল—
“ধনীদের তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে, কিন্তু শূন্য হচ্ছে দাতাদের কোঠা।”
তিনি তার কথার সত্যায়ন করে প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য আলোচনা শুরু করলেন। গভর্নরের এমন আচরণে তারা বিস্মিত হলো, কারণ তারা ধারণা করেছিল—হয়তো এখনই তিনি তার জন্য হাদিয়া দিয়ে প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন।
এদিকে খুজায়মার পরিবারের অনাহার যাপনের তৃতীয় দিবস পার হয়ে গেল। ক্ষুধা-পিপাসায় স্ত্রীর অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে লাগল। স্বামী বেচারা নিজের ক্ষুধার যন্ত্রণার চেয়ে স্ত্রীর করুণ অবস্থা দেখে বেশি অস্থির হয়ে পড়লেন। স্ত্রীর ভালোবাসা তাকে অন্যের দ্বারস্থ হতে প্ররোচিত করতে লাগল। অপরদিকে তার আত্মমর্যাদাবোধ তার হাত দুটো কুঞ্চিত করে রাখল।
তৃতীয় রজনী ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে। বিছানায় শুয়ে তারা নির্ঘুম ছটফট করছে। হঠাৎ তারা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল। লোকটি স্ত্রীকে বললেন—
“দেখো তো, দরজায় এত রাতে কে এলো।”
সে উঁকি দিয়ে দেখে বলল—
“সমগ্র শরীর আবৃত এক অশ্বারোহী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।”
তখন তিনি নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন। কিন্তু আশ্চর্য, লোকটি ঘোড়া থেকে নামলও না, মুখ ফুটে একটা কথাও বলল না। শুধু একটা ভারী থলে তার হাতে গুঁজে দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো। তিনি তাকে ডেকে বললেন—
“কে আপনি? এগুলোই বা কী?”
আরোহী বলল—
“থলেতে যা আছে তা আল্লাহই আপনার কাছে আনার ব্যবস্থা করেছেন। আর এত গভীর রাতে আমার আসার উদ্দেশ্যই হলো আপনি যাতে আমাকে চিনতে না পারেন।”
কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা। তিনি বললেন—
“আপনি যদি আপনার পরিচয় প্রকাশ না করেন, তাহলে আমি এটা গ্রহণই করব না।”
লোকটি তখন বলল—
“আমি জাবের আসারাতিল কিরাম।”
এই বলে সে ঘোড়া হাঁকাল।
খুজায়মা বিন বিশরকে হাদিয়া পৌঁছে দিয়ে ইকরামাতুল ফাইয়াজ সন্তর্পণে বাড়িতে প্রবেশ করলেন, যাতে তার স্ত্রীও এ দান সম্পর্কে জানতে না পারে। কিন্তু বিধি বাম—স্ত্রীর চোখকে তিনি ফাঁকি দিতে পারলেন না।
সে ছিল খুব সন্দেহপ্রবণ মহিলা। এত রাতে স্বামীকে একাকী বাইরে থেকে আসতে দেখে তার মনে সন্দেহ জাগল। সে বলল—
“তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”
তিনি বললেন—
“আমি এক বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে গিয়েছিলাম।”
সে বলল—
“রাষ্ট্রের গভর্নর এত রাতে একাকী বাইরে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয় কোনো মন্দ উদ্দেশ্য আছে। আমার মনে হয়, আমি ছাড়া তোমার আরও স্ত্রী আছে, তুমি সেখানেই গিয়েছিলে।”
একথা বলেই সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—
“বিশ্বাস করো, আমার অন্য কোনো স্ত্রী নেই। খুব জরুরি একটি কাজে বের হয়েছিলাম, যা আমি প্রকাশ করতে চাই না।”
এবার সে গলার রগ ধনুকের মতো বাঁকা করে বলল—
“আমাকে বিষয়টা খুলে না বললে আমি কিছুতেই শান্ত হব না।”
স্বামী বেচারা বাধ্য হয়ে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে শোনালেন। সাথে সাথে ঘটনাটি অন্য কাউকে না বলার শপথও করালেন।
এর কিছু দিন পর খুজায়মা তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর খলিফা সোলায়মান বিন আব্দুল মালিকের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন। তিনি মূলত বাদশাহর এক সময়ের বন্ধু ছিলেন। খলিফার সাথে সাক্ষাতের পর তিনি বিগত দিনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করে শোনালেন। একপর্যায়ে যখন জাবের আসারাতিল কিরামের ঘটনায় পৌঁছলেন, তখন খলিফা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—
“কে সেই জাবের?”
তিনি অজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন—
“আমি এখনও তার কোনো সন্ধান পাইনি।”
আলাপচারিতা শেষে তিনি যখন ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, তখন খলিফা ইকরামাতুল ফাইয়াজের পরিবর্তে তাকে সেই অঞ্চলের গভর্নর বানিয়ে পাঠালেন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।