শ্বাসরূদ্ধকর ভূতের গল্প

খুব দ্রুত জামাটা গায়ে দিয়ে আমি তৈরি হয়ে নিলাম। দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে। দেরি হয়ে গেছে। ইদানিং কোন কাজই সময় মতো করতে পারছিনা। সব কাজে কোন না কোন কারণে দেরি হয়ে যায়, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজে। সাড়ে দশটার মধ্যে এফডিসিতে পৌঁছতে হবে। অনেক ধরাধরির পর বিখ্যাত পরিচালক এহতে সামস সময় দিয়েছেন, তাও আবার পাঁচ মিনিট। মানুষের সময়ের মূল্য যে কত, তা এ সব বিখ্যাত মানুষগুলোকে না দেখলে বোঝা যায় না। এই পাঁচ মিনিট সময়ের মধ্যে তাকে পুরো চিত্রনাট্যটি বোঝাতে হবে। যদি তার পছন্দ হয়, তবে তিনি পরবর্তী ছবির জন্য আমার লেখা নেবেন।

এটাই কোন পরিচালকের সঙ্গে আমার চিত্রনাট্য নিয়ে প্রথম সাক্ষাৎ নয়। এর আগেও অসংখ্য বার অসংখ্য পরিচালক আমার চিত্রনাট্য দেখেছেন। এবং প্রতিবারই আমি প্রত্যাখ্যাত হয়ে যন্ত্রনার শেষ সীমায় পৌঁছে মাতাল হয়ে মেসে ফিরেছি। বাংলা সিনেমায় চাকবুম-চাকবুম বিষয় না থাকলে ঠিক জমে না। অথচ আমি সেই চাকবুম-চাকবুম জিনিসটা পুরোপুরি বাদ দিয়েছি। চিত্রনাট্য নেড়ে চেড়ে, সিগারেটের পেছনে দম দিতে দিতে এক এক জন বলছেন, “মিয়া, নাচ-গান নেই, এটা কোন সিনেমা হলো? নাচে গানে ভরপুর কিছু নিয়ে আস, পার্বলিক নায়িকার উত্তাল নাচ দেখতে চায়। নায়িকাকে বৃষ্টিতে ভিজাও, পানিতে চুবাও, প্রয়োজনে বন-জঙ্গলে নিয়ে হাটুর উপড়ে সাপের কামড় খাওয়াও, তবেই সিনেমা হিট হবে।”

আমি নায়িকাকে বৃষ্টিতেও ভিজাতে পারছিনা, পানিতেও চুবাতে পারছি না। না পারছি হাটুর ওপর সাপের কামড় খাওয়াইতে। তাই কোন পরিচালক আমার চিত্রনাট্য গ্রহণ করছেন না। কাজেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে মাতাল হয়ে পরিচালকদের গালিগালাজ করে মেসে ফেরা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।

মধুমিতা মেসের মালিক সদু ভাই আমাকে বিশেষ ভালোবাসেন, এজন্য ঐ অবস্থায় আমি মেসে ফিরতে পারি। তা না হলে কি হতো, কে জানে। তাছাড়া এ জগতের মানুষের এ অভ্যাসটাকে লোকে অনেকটা মেনে নিয়েছে।
আজও হয়তো ভাঙা মন নিয়ে মাতাল হয়ে আমাকে গভীর রাত্রিতে মেসে ফিরতে হবে। যতোটা উৎসাহ নিয়ে যাচ্ছি, হয়তো তার চাইতেও ঢের বেশি মনকষ্ট নিয়ে ফিরে আসব। তাই বলে হাল ছাড়ার পাত্র আমি নই। একবার না পারিলে, দেখ, শতবার নীতিতে বিশ্বাস রেখে এগিয়ে চলেছি।

টেবিলের উপরে রাখা ব্যাগটা আরেকবার পরীক্ষা করে নিলাম—লেখাটি ঠিক মতো আছে কিনা। গত রাতে পুরো চিত্রনাট্যটি বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটাছেঁড়া করেছি। পরে ফ্রেশ করে নেওয়া যাবে। এখন সময় নেই। আলমারি খুলে এই মাসের বেতনের শেষ পাঁচশ টাকার নোটটা বের করে মানিব্যাগে নিলাম। মাসের বাকি এখনও দশ দিন। বাকি দিনগুলো কিভাবে কাটবে, কে জানে।

দরজায় তালা দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতেই কাউন্টারের সামনে দেখি সদু ভাই কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছেন। সম্ভবত এরা মেসের বাবুচি। আমাকে সিঁড়ি দিয়ে তারাহুরো করে নামতে দেখে সদু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে, কাউন্টারের উপরে রাখা পানের পিক ফেলে বললেন,
“কি, রাইটার সাব, আবারও মনে হয় যাচ্ছ?”
আমি একটু থেমে মাথা নেড়ে বললাম,
“জি সদু ভাই, দোয়া করবেন?”
“তা এইবার কারে দেখাইবা?”
“এহতে সামস্।” আমি ছোট করে নামটা বললাম।
“কও কি মিঞা? ঐ ব্যাটা তো হুনছি হিটের পর হিট। ঠিক লোকরেই ধরছো মনে হয়। তোমার দিয়েই হবে, এইডা আমি কইয়া দিলাম।”

সদু ভাই এগিয়ে এসে আমার কাঁধে চাপর দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে জর্দ্দার কড়া গন্ধ নাকে এল। আমি চলে যাবার ভঙ্গি করে বললাম,
“বললাম, দোয়া করবেন, সদু ভাই।”
“দোয়া তো করমুই, এটাই এখন আমাদের বাংলাদেশে একমাত্র ফ্রি জিনিস।”
“তাহলে কোথায় যাব?”
“এফডিসিতে?”
“জি, ওনার একটা শুটিং আছে, ফাঁকে আমার সঙ্গে কথা বলবেন।”
“বা, বেশ ভাল। হাতে সময় থাকলে তোমার সঙ্গে যাইতাম। এফডিসির ভেতরটা দেখার আমার খুব সখ।”
“সদু ভাই, আমি তাহলে আসি, দেরি হয়ে যাচ্ছে, হাতে একদম সময় নেই। সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছাতে হবে।”
“আরে তাইলে তো আসলেই সময় নাইকা। এখন তো অফিস টাইম। গাড়ি পাওয়া কঠিন; চলো আমার সঙ্গে দেহি, নাসিরার গ্যারেজে গাড়ি আছে কিনা।”

আমি চমকে উঠলাম। সদু ভাইয়ের সঙ্গে যাওয়া মানে আরেক যন্ত্রনা। দেখা যাবে গাড়ি পেতে পেতেই সাড়ে দশটা বেজে যাবে। আমি দ্রুত বললাম,
“আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, সদু ভাই, আমি খুঁজে নেব।”
“মিঞ খুঁজে নিবা বললেই হলো নাকি? গাড়ি পাইতে হবে না? চলো আমার সঙ্গে।”

নাসিরের গ্যারেজে অতি সহজেই গাড়ি পাওয়া গেল। গ্যারেজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সদু ভাই বললেন,
“চলো, আজকে তুমি সফল হইবা কি হইবা না তার ছোট পরীক্ষা কইরা ফেলাই।”
“কিভাবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“যদি নাসিরার গ্যারেজে গাড়ি পাইয়া যাই, তাইলেই মনে করুম তুমি আজ সফল। ঐ পরিচালক তোমার বই লইবোই লইবো।”

গ্যারেজে ঢুকতেই দেখি দরজার সামনে একটি সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। সদু ভাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি জিতে গেছ। যাও, আজকে তোমাকে আর কেউ আটকাতে পারবে না।”

গ্যারেজের মালিক নাসির ময়লা বিছানার উপর বসে চা খাচ্ছিল। সদু ভাইকে দেখে দৌড়ে এসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু লাগবে ভাই? খবর পাঠাইলে তো আমিই যাইতাম।”
“তো, তো যাইতিই। এখন দেখ গাড়িটা আছে কিনা, আমরা রাইটার সাবকে এফডিসিতে পাঠাব।”

সিএনজিতে গেলে চলবে। আমি সদু ভাইয়ের দিকে তাকালাম।
“তোর ড্রাইভার কোথায়?”
“আছে, মনে হয় মুততে গেছে। দাঁড়ান, আমি ওকে নিয়ে আসি।”

ছেলেটা আমাকে সত্যিই ঝড়ের বেগে নিয়ে এলো। সবই ভালভাবে হচ্ছে। রাস্তায় জ্যাম ছিল না বললেই চলে। এফডিসির গেটে বিশাল ভীড়। নায়ক-নায়িকাকে দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের অভাব নেই। অনেক কষ্টে ভীড় ঠেলে গেটে পৌছে গেট পাস দেখাতেই আমাকে ঢুকতে দিল।

১১ নম্বর ফ্লোরে এহতে সামস্ সাহেবের শুটিং চলার কথা। ১১ নম্বর কোথায় তা কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে ১১ নম্বরে পৌঁছে দেখি বিশাল একটি তালা ঝুলছে। গেটের সামনে কয়েকজন গার্ড বসে গল্প করছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এহতে সামস্ সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে একজন বলল,
“স্যার, ইউনিট ১৩ নম্বরে গেছে। ওখানে যান, ১১ নম্বরের জেনারেটার খারাপ হয়েছে।”
১৩ নম্বর কোথায় তা জেনে নিয়ে আমি দ্রুত পা চালালাম।

তিন

মধুমিতা মেসের সামনে ভিড়টা চোখে পরার মতো। মূল রাস্তায় দু’টো পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ হাঁটার ফলে প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করছি। মনে হচ্ছে গোসল করতে পারলে ফ্রেশ লাগত। কিন্তু এতো রাতে মেসের সামনে এতো লোকজন কেন? কৌতূহল নিয়ে মেসের ভেতরে ঢোকার জন্য পা বাড়ালেই গেটের কাছে একজন এসআই আমার পথ রোধ করল। আপাত মস্তক এক নজর দেখে সে প্রশ্ন করল,

“কে আপনি?”

“জি, আমার নাম রন্জু। এখানেই থাকি।”

“এতো রাতে কোথা থেকে এলেন?”

“জি, কাজ ছিল একটা।”

“কি কাজ?”

“এফডিসিতে একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”

“করেন কি?”

“লেখালেখি করি—গল্প, উপন্যাস, চিত্রনাট্য লিখি।”

“ও, বই লিখেন?”

লোকটা কি বুঝে প্রশ্ন করল বুঝলাম না। মাথা নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ।”

“তা, কত দিন ধরে এখানে আছেন?”

“বছর তিনেক হলো।”

কাউন্টারের কাছে ম্যানেজার বদরুলকে দেখলাম, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এতো বড় একজন মানুষের কান্না দেখতে ভালো লাগেনা। তার উপরে বদরুলকে তো আরও না। আমাকে দেখে বদরুল ‘রন্জু ভাই’ বলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল।

বদরুলকে আমার বিশেষ পছন্দ নয়। আমি পারতপক্ষে ওর সঙ্গে কথা বলি না। বদরুলও আমাকে সব সময় এড়িয়ে চলে। কিন্তু আজ সে এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরায় আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। মানুষের আবেগকে কখনও উপেক্ষা করতে নেই। হোক না সে যেমনই মানুষ। কিন্তু বদরুলের ব্যাপারটা ভিন্ন। আমি বদরুলকে ছাড়িয়ে দিতে দিতে নরম অথচ শক্তভাবে প্রশ্ন করলাম,

“কি হয়েছে, বদরুল?”

“সদু ভাই…”—বদরুল আবারও কাঁদতে লাগল। আমার কাছে মনে হলো বদরুল অভিনয় করছে। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম,

“সদু ভাই কি?”

“সদু ভাই আর নেই।”

“নেই মানে কি? কোথায় গেছেন? ভনিতা না করে আসল কথা বলো।” আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম।

“সদু ভাই, সদু ভাই আত্মহত্যা করেছেন।” বদরুল ছেলে মানুষের মতো কাঁদতে লাগল। এবার আর তার কান্নাকে অভিনয় মনে হলো না।

আমি প্রায় চিৎকার করে বললাম,

“কোথায়? কেন?”

উপরের দিকে আঙুল দিয়ে বদরুল দোতালার শেষ মাথার দিকে দেখাল।

দোতালার শেষ মাথায় সদু ভাইয়ের একটি রুম আছে। সদু সেটাকে অফিস হিসাবেই ব্যবহার করতেন। পাশে একটি বিছানা পাতা আছে; মাঝে মাঝে রাতে সেখানে ঘুমান।

আমি এসআইয়ের দিকে তাকিয়ে উপড়ে যাবার অনুমতি পেলাম। এসআই আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

“যান। তবে কিছু স্পর্শ করবেন না। এটা মার্ডার কেসও হতে পারে।”

“ঠিক আছে।” দ্রুত উপড়ে উঠে এলাম। বারান্দায় চেনা অচেনা অনেক মানুষ, কিছু পুলিশও আছে। আমার রুমটা মাঝামাঝি। রুমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম তালা দেওয়া। যারা আমাকে চেনে তারা আমাকে দেখে সরে গিয়ে ভেতরে যাওয়া রাস্তা করে দিল।

সদু ভাইয়ের রুমে ঢুকতেই আমি ভীতিকর ভয় পেলাম। ফ্যানের সঙ্গে বিশ্রীভাবে সদু ভাইয়ের দেহ ঝুলছে। মুখ থেকে জীবটা বেরিয়ে আছে। চোখ দুটো খোলা। বিশাল দুটি হাত দুপাশে ছড়ানো। পুরো শরীরে কোন কাপড় নেই। আমি প্রচণ্ড ভয় পেলাম। হঠাৎ টের পেলাম মাথা ঘুরছে। কোন রকমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।

থানা থেকে ওসি সাহেব আসার পর সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। পুলিশ মেসের বোর্ডারদের থানায় না জানিয়ে কোথাও না যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে গেল। ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটা বাজে। আমি একটু ধাতস্ত হতে পেরেছি। সদু ভাই নেই—এই কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতটা কেমন জানি হয়ে উঠছে। বারবার সদু ভাইয়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

রুমে ঢুকে দেখি টেবিলের ওপর আমার খাবার ঢেকে রাখা। অর্থাৎ সদু ভাই আমার রুমে খাবারটা দিয়ে গেছেন। আহা! সদু ভাই… হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বুক চেপে ধরে খাটের ওপর বসে পড়লাম। হঠাৎ এফডিসির বাইরে দেখা লোকটার কথাটা মনে পড়ল: “তোর তো আপন কেউ নেই, তাই হারাবারও কিছু নেই। তুই তাহলে রাজি?” আমার মনে হলো, সদু ভাই আমার আত্মীয় না হয়েও অনেক বেশি আপন ছিল—অনেক, অনেক বেশি।

পরের দিন সাড়ে বারোটার সময় দরজার প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। হাড়ে হাড়ে উঠে দরজা খুলে দেখলাম বদরুল দাঁড়িয়ে আছে, ওর পাশে পরিচালক এহতে সামস। আমি বেশ অবাক হয়ে তাকালাম। আমার মেসে পরিচালক আসবে এতোটা আশা করিনি। আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,

“স্যার, আপনি?”

“দেখ, দেখি। তোমাকে না জানিয়েই চলে আসলাম। তুমি কি ফ্রি আছো? তাহলে তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে আসলাম।”

“জি স্যার, আসুন ভেতরে।” আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। রুমের অবস্থা দেখে নিজের কাছে লজ্জা লাগল। এহতে সামস চারিদিকে নজর বুলিয়ে টেবিল থেকে চেয়ার নিয়ে বসে পড়লেন। আমি বললাম,

“স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি।”

তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “সিওর।”

তারপর তাকিয়ে বললেন, “তোমার এখানে এসট্টে নেই? সিগারেট ছাড়া আমি একদম চলতে পারি না।” আমি খাটের নীচ থেকে একটি ভাঙা চায়ের কাপ টেবিলে রাখলাম। এহতে সামস হেসে সিগারেট ধরলেন। আমি বদরুলকে চা বলে বার্থরুমে ঢুকলাম।

এহতে সামস সাহেব আমাকে দু’লাখ টাকার ক্যাশ চেক দিয়ে একটি কাগজে সাইন করিয়ে নিলেন। আমার চিত্রনাট্য নিয়ে তিনি কাজ করবেন। দুই মাসের মধ্যে শুটিং শুরু হবে। তখন আরও তিন লাখ পেমেন্ট করবেন। জীবনের প্রথম সাফল্যে আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। উত্তেজনায় কাগজের লেখা পড়তে পারলাম না। সাইন করে চেক হাতে নিলাম। হঠাৎ সদু ভাইয়ের জন্য মন কেদে উঠল। মানুষটা বেঁচে থাকলে আজ সব চাইতে খুশি হতো।

এহতে সামস বিদায় নেবার পর আমি ব্যাংকে ছুটলাম। সদু ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য কিছু টাকা খরচ করবো।

সদু ভাইয়ের মৃত্যুর পর পুরো মেস অতিরিক্ত নীরব হয়ে গেছে। দোতালার বেশ কয়েকজন বোর্ডার পুলিশের অনুমতি নিয়ে মেস ছেড়ে গেছে। অনেকেই বলছে, রাতের বেলা সদু ভাইকে মেসের বারান্দা দিয়ে খুড়ে খুড়ে হাঁটতে দেখা গেছে। আমি এসব কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না।

 

চার

মেসে ঢুকতেই কাউন্টারে বদরুলকে পেয়ে দোতালায় ডেকে নিয়ে এলাম। দোতালায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। রুমগুলো সব তালা দেওয়া। বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই শরীর ছমছম করতে লাগল। ধীরে ধীরে তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। পেছন পেছন বদরুলও ঢুকল। আমি খাটে বসে বদরুলকে চেয়ারে বসতে বললাম। সে বলল,

“বসতে হবে না, রঞ্জু ভাই। যা বলবেন, বলুন।”

“তুমি কি সদু ভাইকে দেখেছো?” আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম।

বদরুল কিছু বলল না। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

“কালকে সকালে বলব, রঞ্জু ভাই?”

“এখন নয় কেন?”

“রাতের বেলায় তাদের নিয়ে কথা বলা যায় না।” বদরুল দেখে মনে হলো, সে গুটি চালাতে শুরু করেছে।

“তেনারা মানে কারা? আমি সদু ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করছি।” আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম।

“তেনারা মানে মৃত মানুষদের কথা বলছি।”

“আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তুমি কি সদু ভাইকে দেখেছো?”

“জি, দেখেছি।” বদরুল কিছুক্ষন নীরব থেকে আমতা-আমতা করে উত্তর দিল।

“কবে?”

“ফাঁসি দেওয়ার দু’দিন পরে। সন্ধ্যার সময় দোতালায় এসেছিলাম। হঠাৎ দেখি সদু ভাইয়ের রুমের লাইট জ্বলছে। দরজা বন্ধ। ভেতরে দেখার জন্য ফাঁক দিয়ে উকি দিলে দেখি সদু ভাই টেবিলে বসে কিছু লিখছেন। আমার তো অবস্থা বুঝতে পারিনি। আমি এক দৌড়ে নিচে গিয়ে বাবুচি তোতারে ডেকে দেখলাম, কেউ নেই। ভেতরের বাতিও নিভানো।”

“তুমি মিথ্যা বলছো না তো?”

“আল্লাহর কিরা, রঞ্জু ভাই, মিথ্যা বলব কেন?”

“তোমার কাছে সদু ভাইয়ের রুমের চাবি আছে তাই না?” আমি সরাসরি চোখে চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম। বদরুল সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে ফেলল। মানুষ সরাসরি চোখে চোখে মিথ্যা বলতে পারে না; তার বিবেক বাঁধা দেয়।

“না,” বদরুল মাটির দিকে তাকিয়ে বলল।

“এবার কিন্তু মিথ্যা বলছ। পুরো ঘটনাটা খুলে বলো। কি ঘটনা?”

“রঞ্জু ভাই, আমি কিছু করি নাই।”

“তুমি কিছু করেছো, তা বলিনি। শুধু এটুকু বলেছি—মিথ্যা বললে ফেসে যাবে। তোমার কাছে সদু ভাইয়ের চাবি আছে, তাই না?”

বদরুল মাথা নাড়ল, “আছে।”

“চাবিটা আমারে খুলে দাও।”

বদরুল চাবিটা খুলে আমাকে দিয়ে বলল,

“রঞ্জু ভাই, একটু সাবধানে থাকবেন। দোতালায় এখন আপনি ছাড়া আর কেউ নেই।”

“ঠিক আছে। তুমি এখন যাও।”

“খাবেন না? খাবার দেবো?”

“না, খাবো না। তুমি পারলে এক ফ্লাস্ক চা পাঠাও। রাতে লেখালেখি করতে হবে। কোন কিছুর দরকার হলে ডাক দিবো। আমি জেগে থাকবো।”

“ঠিক আছে, দরকার হলে ডাক দেবো। তুমি এখন যাও।”

বদরুল দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাক দিল,

“রঞ্জু ভাই?”

“কি?”

“আজ আপনার খোঁজে একটি মেয়ে এসেছিল।”

“মেয়ে?” আমি অবাক। কেননা ঢাকা শহরে আমার পরিচিত কোন মেয়ে নেই।

“কখন?”

“দুপুরের দিকে।”

“কিছু বলেছে?”

“না, বলেছে আবার আসবে।”

“ঠিক আছে, তুমি যাও।”

বদরুল চলে গেলে জামাকাপড় পাল্টে চা খেয়ে লিখতে বসলাম। একটানা অনেকক্ষণ লেখার পর হঠাৎ লেখার খেই হারালাম। কিছুতেই যেন মাথা থেকে কিছু বের হচ্ছিল না। একজন লেখকের জন্য এটি সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয়। খুব গরম লাগছে। টেবিলের পাশের জানলাটা খুলে আবার লিখতে চেষ্ট করলাম, কিন্তু ব্যর্থ হলাম।

আজ আর হবে না ভেবে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘড়িতে তখন রাত ৩টা ২ মিনিট। হঠাৎ বাইরে কোন শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। শব্দটি আবার হলো। এবার স্পষ্ট শোনা গেল। ডান পাশ থেকে আসছে—সদু ভাইয়ের রুমের দিক থেকে। টের পাচ্ছি, চুলগুলো এক এক করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমি শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালাম। মনে হলো কেউ দরজা খুলে বেরিয়েছে। বারান্দায় হাঁটার শব্দ শোনা যাচ্ছে।

আমি আস্তে আস্তে আমার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পায়ের শব্দ দরজার কাছে এসে আবার সদু ভাইয়ের রুমের দিকে ফিরে গেল। আমি দরজাটা খুলে দেখলাম—পুরো বারান্দা অন্ধকার, কাউকে দেখতে পেলাম না। অন্ধকার চোখে সয়ে আসতে লাগল। ভয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম। কাউকে না দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বুকের কম্পন বেড়ে গেছে।

টেবিলের ওপর রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেলাম। বিছানায় বসতেই দরজায় পরপর তিনটি টোকা হলো। চমকে উঠলাম। দাঁড়িয়ে রইলাম। ভয়ে ঘামতে শুরু করলাম। চুলগুলো আবারও এক এক করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“কে? কে?”

কেউ উত্তর দিল না। দরজার কাছে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলাম।
না, আর কোনো শব্দ নেই। হয়তো মনের ভুল, অতিরিক্ত উত্তেজনায় এলোমেলো শুনছি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার বিছানায় বসে পড়লাম। নিজেকে শান্তনা দিচ্ছি—ভয় পাবার কিছু নেই। মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসে না।

বিছানায় শুয়ে আবারও লেখার দিকে মন দিলাম। হঠাৎ দরজায় শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলাম। ছুটে দরজার কাছে গিয়ে খুলে দেখলাম—সদু ভাই দাঁড়িয়ে আছে। মুখ শুকিয়ে গেছে, চোখ দুটো গর্তের মধ্যে। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। সদু ভাই বললেন,

“রাইটার সাব, একটা কম্বল দিবা? আমার খুব শীত লাগছে। এখানে খুব শীত। দাওনা একটা কম্বল।”

আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। প্রচণ্ড ভয়ে বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। মনে হলো, আমি মরে যাচ্ছি। কানের ভেতরে ‘ভো ভো’ শব্দ শুনছি। চোখে কিছু দেখছি বলে মনে হলো না। হঠাৎ ওমর ফারুক সাহেবের কথা মনে হলো। বুঝতে পারলাম কি দেখে ভদ্রলোক ভয় পেয়েছিলেন।

আমি বড় করে হা করে শ্বাস ছাড়তে লাগলাম। বাকি রাতটুকু দরজায় হেলান দিয়ে কাটালাম।

পাঁচ

ফজরের আযানের পর বিছানায় শুতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে এলো । কতোক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা হঠাৎ প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাংলো । প্রথমে চোখ খুলে বুঝলাম না শব্দটা কোথা থেকে আসছে । দ্বিতীয় বার শব্দ হতেই বুঝলাম প্রচন্ড জোড়ে কেউ দরজায় আঘাত করছে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি পৌনে ছয়’টা বাজে । এক ঘন্টাও ঘুমাতে পারিনি । এলোমেলো পা ফেলে দরজা খুলতেই দেখি পুলিশের সেই এসআই দাঁড়িয়ে আছে । পুলিশ দেখে আমি চমকে উঠলাম ।  কি ব্যাপার ? কোন রকম নিজেকে সামলে প্রশ্ন করলাম । কেননা আমি ভাল করে তাকাতে পারছিনা । মনে হচ্ছে চোখের ভেতর অসংখ্যা সূঁচ ফুটছে । দু হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে এসআইয়ের দিকে তাকালাম ।
আপনিই তো রঞ্জু সাহেব ?
জ্বি বলেন ।
দূঃখিত আপনাকে বিরক্ত করতে হলো । একটু নীচে চলুন ।
কেন কি হয়েছে ?
আসুন না, গেলেই তো দেখতে পাবেন । কোথায় যেন পড়েছিলাম রিকশা চালক আর পুলিশের সঙ্গে তর্ক করতে নেই ,তাতে সন্মানহানির আশংন্কা থাকে । সেই বাক্যটা মনে করে একটা সার্ট টেনে গায়ে দিয়ে এসআইয়ের পিছু পিছু হাটতে শুরু করলাম ।  সিঁড়ির কাছে অনেক লোকের ভীড় চোখে পরল। কয়েকজন পুলিশও দাঁড়িয়ে আছে । ভীড়ের মধ্যে এফডিসির সামনে দেখা লোকটাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম । সেই হলুদ চোখ, বিশাল মাথাওয়ালা লোকটাকে খুব সহজেই চিনতে পারলাম । কেমন হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠল । আমি সিড়ির রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম । এসআই বললেন, কি হলো ?  আমি কয়েক মুহুর্ত কোন কথা বলতে পারলাম না ।  নিজেকে কোন রকম সামলে নিয়ে আবারও নিচে তাকাতে কাউকে দেখতে পেলাম না । মনে মনে বললাম, আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ।
সিঁড়ির নীচে মেঝেতে কেউ একজন উপুর হয়ে পরে আছে । ঘারটা বিশ্রী ভাবে ডানপাশে মোচড়ানো । রক্তের দু’টো ধারা গড়িয়ে মেঝেতে নেমে গেছে । উপড় থেকে এক নজর দেখেই বুঝলাম বেঁচে নেই।  ওটা কে ? কে ওখানে পরে আছে ? কথাটা বলে আমি দ্রুত পা ফেলে নীচের নেমে গেলাম । কাছে গিয়ে বদরুলকে চিনতে মোটেই বেগ পেতে হলো না ।  বদরুলকে এভাবে অপঘাতে মরতে দেখে আমি খুব ঘাবরে গেলাম। পরপর দু’টো মৃত্যু আমাকে হতবিহম্বল করে দিলো । আমার মুখ দিয়ে উহু একটা শব্দ বের হয়ে এলো । এসআই আমাকে ধরে কাউন্টারের সামনে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন । আমি এসআইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিভাবে ?
সেটাইতো আমরা জানতে চেস্টা করছি । তবে প্রার্থমিক ভাবে মনে হচ্ছে  পেছন থেকে কেউ খুব জোড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে । তারপর কি একটা চিন্তা করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিও তো দোতালাতেই থাকেন , তাই না ?”
আমি মাথা নাড়ালাম , হা ।
বদরুল সাহেবের সঙ্গে আপনার কখন শেষ দেখা হয়েছে ?
গতকাল রাতে ।
কখন ?
রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে । আমি এসআইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম ।
কি নিয়ে কথা হয়েছে ?
আমার কিছু বিষয় জানার ছিল তাই বদরুলের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম ।
কি জানতে চেয়েছিলেন, তা কি আমি জানতে পারি ?
আমার গতরাতে দেখা সদুভাই এর মুখটা মনে পরে গেল । আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম, পারেন  ।
তা হলে বলে ফেলুন ।  দয়া করে মিথ্যা কিছু বলবেন না ।
অনেকেই নাকি সদু ভাইকে মেসের এখানে সেখানে ঘুরে বড়োতে দেখেছে । আমার কাছে মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা বানোয়াট । তাই বদরুলকে ডেকে নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম আসলে ব্যাপারটা কি ?
তা, কি জানতে পারলেন ?
বদরুলও  বলল ও নিজেও নাকি সদু ভাইকে দেখেছে ।
কবে , কোথায় দেখেছে ? এসআই অত্যান্ত শান্তু সুরে জিজ্ঞাসা করলেন ।
সদু ভাইয়ের মৃর্ত্যুর দু’দিন পরে । তার রুমে ।
এসব মিথ্যে কথা । যতোসব গাল গপ্প । একজন মৃর্ত মানুষ কি করে দেখা দেয় ?
আমিও প্রথমে তাই ই মনে করেছিলাম কিন্তু ব্যাপারটা আসলেই সত্য ……আমি গতরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম ।
কি সত্যি ? সদু সাহেবকে দেখার ব্যাপারটা ?
জ্বি ।
আপনার মতো একজন শিক্ষিত মানুষ বলছেন এ কথা ?
জ্বি, কেননা কেননা আমিও গতরাতে সদু ভাইকে দেখেছি । আমি এসআইকে সদু ভাইকে দেখার পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম ।
সব শুনে এসআই সাহেব বললেন, এ্যস্ট্রেন্জ ।  এতো দেখছি সত্যিই ভৌতিক ব্যাপার । আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম ।

মেসে পরপর দু’টো মৃর্ত্য ঘটায় পুরো শহরে হৈ চৈ পরে গেছে । প্রতিদিন অনেক লোক আসছে মেসটাকে দেখতে । পরের দিন সবকটি জাতীয় পত্রিকায় লাল কালিতে বড় বড় করে ছবি সহ হেডলাইন ছাপা হলো, “মেস মালিকের আত্মহত্যার পর এবার কর্মচারীর রহস্যজনক মৃর্ত্যু । এলাকা বাসি বলছে, ভৌতিক ঘটনা ”।
অন্য একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছ, “পুলিশের নাকের ডোগায় ঘটে চলেছ একের পর এক ভৌতিক হত্যাকান্ড, তবুও পুলিশ রহস্যের কোন  কূল কিনারা করতে পারছে না । মেসের লোকজন বলছে, ভূতুরে কান্ড।”

মেসের উঠানের মাঝখানে বিশাল একটা আম আছে । যার গোরাটা গোল করে বাঁধানো । দু’জন পুলিশ পালা করে সেখানে বসতে শুরু করেছে । আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি মেস ছেড়ে দেবো । এহতে সামস্ সাহেবের সঙ্গে এর মধ্যে দু’দিন ফোনে কথা হয়েছে । তিনি স্বাভাবিক খোজ খবর নিয়ে আরেক জন পরিচালকের খোঁজ দিয়ে বলেছেন, তিনি নাকি একটা ভাল চিত্রনাট্য খুঁজছেন । তিনি ঐ পরিচালকে আমার কথা বলে ঠিকানা দিয়ে দিয়েছেন , ভদ্রলোক যে কোন দিন আসবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে । নিজের ভাগ্যের এ পরিবর্তনে আমি আনন্দিত হবার পরিবর্তে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছি । বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে, সেই হলুদ দুটো চোখ, আর বিশ্রী মুখের হাসি ।

সদু ভাইকে দেখার পর থেকে আমার চারপাশে  অদ্ভূত সব ব্যাপার ঘটছে  । প্রায় রাতেই বারান্দায় কারো পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে ঘরের মধ্যেও কার যেন উপস্থিতি টের পাচ্ছি । লেখালেখি নিয়েও চলছে তুগলগি কারবার । কোন একটি কাহিনী চিন্তা করে লেখা শুরু করলেই প্রচন্ড ঘুম পেয়ে যায়, আর তখন লিখতে লিখতেই ঘুমিয়ে পরি । সকালে উঠে নিজেকে হয় বিছানায় নয়তো মেঝেতে আবিস্কার করি । সব চেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, যে লেখাটা লিখতে শুরু করে ছিলাম সেটা পুরোপুরি শেষ করা অবস্থায় পাই । একরাতে একটা কাহিনী শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । কিন্তু হাতের লেখা হুবুহু আমার। আমার লেখাতে এমনিতে অনেক কাটাছেড়া হয় । কিন্তু এ লেখাগুলো একেবারে নিক্ষুত । এ রকম অদ্ভুত ঘটনায় আমি বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছি ।
গভীর রাতের দিকে মাঝে মাঝে মনে হয় সদু ভাইয়ের রুম থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসে। খুবই করুন সে কান্নার শব্দ। আমি ভয়ে আর দরজা খুলি না । তার উপড় আবার ক্ষুধা মন্দা দেখা দিয়েছে । স্বাস্থ্য দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে । আয়নার সামনে দাঁড়ালে বেশ বুঝতে পারি চোখ মুখ ভেতরে বসে যাচ্ছে । কোন কিছু খেতে ভাল লাগে না । ক্যামন জানি সব সময় একটা অস্থির ভাব কাজ করে। কোন কাজই মন দিয়ে করতে পারছি না। একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলি । কোন কোন রাতে  দেখা যায় জ্বলন্ত সিগারেট হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পরছি ।

ছয়

ইতি নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এ হেনিতে সামস্ সাহেব আমার যে কাহিনীটি নিয়ে ছবি বানাবেন, তার নায়িকা ও। সে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, যেন আমি ওর চরিত্রটি ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে পারি। আনার্স পড়ছে। মেয়েটি একবার এলে আর সহজে উঠতে চায় না; ঘরদোর নিজের মতো করে গুজগাছ করে ফেলে।

ছোটবেলা থেকেই আমি নারী সংস্পর্শ বঞ্চিত। এখনও বুঝতে পারি না মেয়েদের সঙ্গে ঠিক কিভাবে কথা বলতে হয়, মিশতে হয়। মেয়েটিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি; সে একেবারে নাছোড়বান্দা। প্রথমে ভেবেছিলাম, ওর চরিত্রটি বুঝিয়ে দিলেই কেটে যাবে। কিন্তু সেটা নিয়ে ওর সঙ্গে একদিনও বসতে পারিনি। আমি যখন বলেছি, “চলো, তোমার চরিত্রটি বুঝিয়ে দেই,” তখনই ও বলেছে, “রাখেন তো, আপনি তো আর উড়ে যাচ্ছেন না, পরেও এ নিয়ে বসা যাবে।” চরিত্রটি বুঝে নেওয়ার কোনো আগ্রহ মেয়েটার মধ্যে নেই বলে মনে হয়। ওর ভাষায়, কাহিনিকারকে বুঝলে নাকি অতি সহজেই তার রচিত যে কোনো চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করা যায়। তাই এখন ও আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে।

আমার বর্তমান অসস্থা দেখে ইতি একদিন এসআই ফরহাদকে ডেকে নিয়ে এল। আমি তাকে এক এক করে সব খুলে বললাম। এফডিসির সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও বাদ গেল না। এসআই ফরহাদ আমার সদ্য সমাপ্ত চিত্রনাট্যটি, যেটার শুরুটা আমি করেছি আর বাকিটা করেছে অন্য কেউ, নেড়েচেড়ে দেখে সঙ্গে নিয়ে গেলেন।

একদিন বিকেল বেলা তিনি বললেন, “রঞ্জু সাহেব, এটা আমি পরপর তিনজন হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্টকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। তারা সবাই মোটামুটি একই কথা বলেছে—যে এটি একই হাতের লেখা। সুতরাং আপনার কথা ঠিক নয় যে, এ পুরোটা আপনি লিখেননি।” আমি কিছুতেই আর তাকে বিশ্বাস করাতে পারিনি যে লেখাটি আমি শেষ করিনি। উল্টো এসআই আমাকে উপদেশ দিলেন, “কোথাও থেকে সপ্তাহ খানেক ঘুরে আসুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আপনার উপর বেশ চাপ ফেলেছে। সপ্তাহ খানেক ঘুরে আসলে মাথাটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে, তখন দেখবেন আর এমন মনে হবে না।”

ইতির অনুরোধে আমি কক্সবাজার থেকে ঘুরে এলাম। কিন্তু তাতে সমস্যার কোনো হেরফের হলো না। বরং নতুন একটি উপদ্রূপের উপস্থিতি টের পেলাম। সারাক্ষণ মাথার ভেতরে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাই। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয়, আমি সমুদ্রের মধ্যে পড়ে গেছি আর চারিদিক থেকে রাশি রাশি জল এসে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

দিনের পর দিন সমস্যা বাড়তে থাকায় ইতি একদিন আমাকে ঢাকায় ওর এক স্যারের বাসায় নিয়ে গেল। ভদ্রলোক একজন সাইকিয়াট্রিস্ট; নাম মোস্তফা মল্লিক। শরীরের গঠন হালকা ও পাতলা। ঠোটের উপর এক জোড়া গোফ। দু’গালে কয়েক দিনের না কাটা দাঁড়িতে ভদ্রলোককে দেখলে মনে হয় না তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। মধ্যবয়স্ক শরীরটা ধনুকের মতো সোজা, মাথার চুল এলোমেলো। যাযাবর মনে হয়।

আমরা রিকশায় থাকতেই প্রচণ্ড ঝড় হলো। হঠাৎ আকাশ কালো করে ঝড় শুরু। পৌছালে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। অনেকক্ষণ দরজায় কড়া নাড়ার পর কালো লুঙ্গি পরা মোস্তফা মল্লিক সাহেব দরজা খুলে দিয়ে ইতিকে দেখে বললেন, “ও তুমি! রান্না ঘরে ছিলাম, তাই দেরি হয়েছে।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে যেন থমকে গেলেন। আমার প্রচণ্ড অসুস্থতা বেড়ে গেল। একসময় মনে হলো, ভদ্রলোকের দৃষ্টি আমার অস্থিমজ্জা ভেদ করে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যাচ্ছে।

হঠাৎ আমার পালানোর ইচ্ছে হলো। ইতিকে দেখে বললাম, “চলো।” ঠিক তখনি ভদ্রলোক দ্রুত ছোবল মারার মতো খপ করে আমার ডান হাত ধরলেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, “ভেতরে আসো, এখানে তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছো।”

মল্লিক সাহেব আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করা ঘরের সামনে এসে অন্য হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেললেন। দ্রুত ভেতরে ঢুকে হাত ছাড়িয়ে বিছানাটা দেখিয়ে বললেন, “ওখানে বসো।”

ঘরটা বলতে গেলে একেবারে খালি। এক কর্নারে মাটিতে জাজিম ও তোশক দিয়ে বিছানা পাতা। তাতে কালো রংয়ের চাদর ও দু’টো বালিশ। পাশে বড় কাঠের আলমারি। ঘরের মাঝখানে সাদা রঙে বড় বৃত্ত আঁকা, ভেতরে হিজিবিজি ছবি। জানালাগুলো বন্ধ। ভেতরে পা দিতেই মনে হলো, ফ্রিজের মধ্যে প্রবেশ করেছি। হঠাৎ তীব্র শীতে শরীর কেঁপে উঠল।

ভদ্রলোক ইতিকে দিয়ে চাদর আনাতে বললেন। আমাকে বিছানায় বসিয়ে বললেন, “তোমার কোনো ভয় নেই। এখানে নিশ্চিন্তে থাকো। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ইতির পেছনে তাকাতেই সেই এফডিসির সামনে দাঁড়ানো লোকটা। চোখ দুটো আগুনের মতো ঝলক। মনে হলো, সুযোগ পেলে আমাকে টুকরো করে ফেলবে। ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। ইতিও ভয় পেয়ে আমার দু’কাধ ধরে বলল, “রঞ্জু ভাই, কি হয়েছে?” আমি আঙুল দিয়ে লোকটাকে দেখালাম। মল্লিক সাহেব দ্রুত আলমারির কাছে গিয়ে শিশি থেকে তরল ছুড়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে লোকটির শরীর মুচড়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল। আতরের সুগন্ধিতে ঘর পূর্ণ। হঠাৎ শীত চলে গেল। আমি বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পরলাম।

মল্লিক সাহেব ইতিকে বললেন, “ও এখন ঘুমাবে। আমার কিছু জরুরি কাজ করতে হবে। তুমি রান্না ঘরে গরম পানি বসাও।”

সাত

স্বপ্নে একটি কুচকুচে কালো বিষাক্ত সাপ দেখে প্রচণ্ড ভয় পেলাম। সাপটি ঘরের মেঝেতে কুন্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে। আমি হাতপা গুটিয়ে বিছানায় চিৎকার করছি। সাপটি বারবার জিভ বের করছে। আমি নড়াচড়া করলে সে অস্থির হয়ে যায়। ধীরে ধীরে বিছানায় উঠতে উঠতে আমার মুখে বিষ ছুড়ে মারল। প্রচণ্ড আতঙ্কে ঘুম ভেঙ্গে গেল।

চোখ খুলে ঘরটা অল্প আলোর। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মনে পড়ল সব। বৃত্তের মধ্যে তিনজন লোক আসন নিয়ে বসে আছে, ধ্যানের ভঙ্গিতে। একজন মন্ত্র পড়ছে, পাশে রাখা বোতল থেকে পানি জাতীয় কিছু ছিটিয়ে দিচ্ছে।

মল্লিক সাহেব আমাকে হাতে ধরে বৃত্তের মধ্যে বসিয়ে বললেন, “তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার ভালর জন্যই আমরা এসব করছি।”

তিনি বললেন, “রন্জু, আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত অনেক আত্মা ঘুরে বেড়ায়। তাদের মধ্যে কেউ ভালো, কেউ খারাপ। মাঝে মাঝে তোমার উপরও খারাপ আত্মার দৃষ্টি পড়ে। তুমি তাকে দেখতে পাও, কিন্তু ভয় পাবে না। আমরা তার মোকাবেলা করব। তোমার সাহস ও সহযোগিতা চাই।”

আমি রাজি হলাম। মল্লিক সাহেব নির্দেশ দিলেন, “বৃত্ত থেকে বের হওয়া মানেই মৃত্যু। আত্মা প্রলুব্ধি দেখাবে, ভয় দেখাবে, কিন্তু তুমি ভয় পাবে না।”

হঠাৎ মনে হলো, ইতির কথা। জানতে চাইলাম, সে কোথায়। মল্লিক সাহেব বললেন, “ও বাসায়। চিন্তা করতে হবে না। ও ভালো আছে।”

হঠাৎ সেই ভয়াল লোকটির রূপ পরিবর্তিত হয়ে সদু ভাইয়ের রূপ নিল। “রাইটার সাব, আমার সঙ্গে আসবা না?” বলে মুখ বাড়াল। মল্লিক সাহেব পানি ছুঁড়ে তাকে সামলালেন।

ইতি দরজায় এসে ডাক দিল, আমি দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করালাম। কিন্তু তখনই ইটির রূপ পরিবর্তিত হয়ে সেই ভয়াল রূপ ধারণ করল। মল্লিক সাহেব ছুটে এসে পানি ছুঁড়ে তাকে সরালেন। বৃত্তের মধ্যে বসানো অবস্থায় আমি আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারালাম।

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!