নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য চুপ করে থাকেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই নির্জনতায় দীর্ঘশ্বাস পরিস্কার শোনা যায়। প্রায় অনুচ্চস্বরে বললেন, অর্চনাকে তারা পুড়িয়ে মেরেছিল কার্তিক মাসে। বলে বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আজও কার্তিক মাসে পুরানবাড়িতে অর্চনা ফিরে আসে। সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালায়। আপনাদের দারোয়ান সোলাইমান সবই জানে। ছেলেটা বড় ভালো। চাঁদসাধুর শিষ্য। তার ওপরসাধুর আর্শীবাদ আছে। ঘরসংসার করেনি। ধর্মকর্ম নিয়ে আছে। বছরে একবার অর্চনাকে দেখার আশায় বেঁচে আছে।
অর্চনাকে দেখার আশায় বেঁচে আছে মানে? শওকতকে কেমন হতবাক বিমূঢ় দেখায়।
দুই জনের বেশ ভাব। ভাইবোনের সর্ম্পক। হাজার হলেও সোলাইমানের ধর্মপিতা সালামত আলীকে অর্চনা বাবা ডেকেছিল। কার্তিক মাসের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে সোলাইমান।
এসব … এসব কথা আমাদের আগে বলেননি যে? শওকত অস্ফুটস্বরে জিগ্যেস করে।
আমি জানতাম আপনারা এসে আমাকে পুরানবাড়ির রহস্য সম্বন্দে জিজ্ঞেস করবেন। আমি আগ বাড়িয়ে এসব কথা বলে আপনাদের মিছিমিছি আতঙ্কগ্রস্থ করতে চাইনি।
ওহ। শওকত ভাবল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচায স্বশিক্ষিত বলেই বিচক্ষণ। সে বলল, এখন … এখন কি করা যায় বলেন তো ? আমরা কি পুরান বাড়ি ছেড়ে দেব?
সে আপনাদের ইচ্ছে। বলে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য উঠে চলে গেলেন।
বাড়ি ফিরে আসার পথে চাঁদপিরের গলির মুখ থেকে দৈনিক পত্রিকা কিনল শওকত। ঝরঝরে রোদ উঠেছে। আজ শুক্রবার। অফিস যাবার বালাই নেই। কলিংবেল চাপার পর দরজা খুলল রাইসা। আজ এত সকালে উঠেছে বলে অবাক হল শওকত। রাইসা সাদা রঙের ফ্রক পরে আছে। মাথায় লম্বা সোনালি চুল। কী টলটলে মায়াবী চোখ। রাইসার হাতে একটা বাটি। বাটিতে কী মুড়কি।
মাথায় নেড়ে বলল, মা কই রে?
আম্মু, রান্নাঘরে ।
ড্রইংরুমে টিভিটা অন করা। কার্টুন ছবি চলছে। রাইসা দেখছিল। শওকত বারান্দায় চলে আসে। আজ রওশন আপাদের আসার কথা। বাজারে যেতে হবে। বাজারটা নবীগঞ্জে। নবীগঞ্জের বাজারে টাটকা রুইমাছ পাওয়া যায়। রওশন আপা রুইমাছ পছন্দ করেন।
তানজিনা চা নিয়ে এল। বলল, তোমাকেএখন খিচুড়ি গরম করে দেব?
না। বাজার থেকে ফিরে এসে খাব। আচ্ছা, সোলাইমান এসেছিল?
সোলাইমান । না তো। তানজিনা অবাক।
তাহলে রাইসাকে মুড়কি কে দিল?
মুড়কি?
হ্যাঁ। তখন রাইসার বাটিতে মুড়কিদেখলাম।
তানজিনা বলল, আশ্চর্য! ও মুড়কি পাবে কই?
বুঝেছি। শওকত বলল। মুখে হাসির আভা।
কী বুঝেছ? তানজিনাকে কেমন অস্থির দেখায়।
চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, রাইসাকে মুড়কি দিয়েছে অর্চনা।
অর্চনা মানে? কি যাতা বলছ!
চায়ে চুমুক দিয়ে শওকত বলল, আজ ভোরে শিব মন্দিরে গিয়েছিলাম। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর সঙ্গেকথা হল। তিনি আমাকে পুরানবাড়ি ইতিহাস বললেন।
কী বললেন তিনি? তানজিনার মুখে রঙিন আভা ছড়ালো।
অর্চনা ছিল …শওকত বলতে থাকে। অর্চনার মর্মস্পর্শী জীবনকাহিনী শুনতে শুনতে তানজিনার ফরসা মুখটি বিষাদে ভরেওঠে। চোখে জমে বেদনার জল।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে শওকত বলল, যাই, আমি এখন বাজারে যাই। দাও, আলমারী থেকে টাকা বের করে দাও।
তানজিনা গম্ভীরকন্ঠে বলল, শওকত।
বল।
মেজোভাই ফোন করেছিলেন। আমাকে আররওশন আপাকে রায়পুরা জমিজমার ভাগদেবেন বললেন। শোন, শওকত। আমি জমির যে টাকা পাব আর তোমাদের দেশের বাড়ির যে টাকা আছে সেসব মিলিয়ে চল আমরা এই বাড়িটা কিনে নেই। সস্তাই হওয়ার কথা। দরকার হলে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেবে। এ বছর চাকরি করলে এক টাকাও তো লোন নিলে না। তুমি আজই বাড়িওলার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বল।
শওকত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ওকে।