এই ভোরেও চাঁদপিরের গলির মুখে মধু ঘোষের মিষ্টির দোকান খোলা। পাশেই বাসষ্ট্যান্ড। ভিতরে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিল শওকত। মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কাল সন্ধ্যায় রাইসার আচরণ অস্বাভাবিক ঠেকছে। ও তো ঘুমিয়ে ছিল। ও জানল কি করে সোলাইমান মিঞা খুচড়ি এনেছে? ও গতকাল দুপুরে কাকে দেখল ছাদে? অর্চনা মেয়েটি কে? সন্ধ্যায় কে ধূপ জ্বালায়? এসবের ব্যাখ্যা কী? শওকত কেবলি ভাবছিল । তানজিনা আর পুরান বাড়িতে থাকতে চাইছে না। সোলাইমান মিঞাকে ও এ মাসের মধ্যেই রাইসার স্কুলের আশেপাশে বাড়ি দেখে রাখতে বলেছে।রাতে সোলাইমান মিঞা কে রাতে ড্রইংরুমে শুতে বলেছে।
চা শেষ করে বিল মিটিয়ে দোকানের বাইরে বেড়িয়ে এল শওকত । তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে পিচ রাস্তারপাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। বাতাসে ডিজেলের গন্ধ। হাতের ডাইনে একটাসরু গলি। গলির শেষ মাথায় একটা পানাপুকুর। বাঁশঝাড়, তারপর মেঠোপথ …
শওকত প্রাচীন শিব মন্দিরের পাশেসতীর দিঘীর ঘাটে এসে বসল। দিঘীর ঘাটের ঠিক পাশেই একটা হরীতকী গাছ। ঘাটের ওপর শিশির ভেজা পাতা পড়ে আছে। পরপর দুটো সিগারেট শেষ করল সে। খালি পেটে সে অবশ্য সিগারেট খায় না। তানজিনার বারণ আছে। আজ ভীষণ অস্থির লাগছিল। কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেল শওকত। চাদরমুড়ি দিয়ে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল-নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। শিব মন্দিরের পুরোহিত। বৃদ্ধের বয়েস সত্তরের কম হবে না। শ্যামলা মতন গায়ের রং। শক্তসমর্থ শরীর। পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, আজ আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে যে? জলজ গম্ভীর কন্ঠস্বর।
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শওকত বলল, আপনি কি সুলতানগঞ্জে অনেক দিন ধরে আছেন?
হ্যাঁ। আমার দেশের বাড়ি ছিল যশোর। সুলতানগঞ্জে এসেছি স্বাধীনতার এক বছর আগে।
পুরানবাড়ি সর্ম্পকে আপনি কিছু জানেন? লোকজন কেন ওই বাড়িতে থাকতে চায় না।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য চুপ করে রইলেন। পাতার ওপর শিশির পতনের শব্দ । কুয়াশায় একটা কাক উড়ে যায়। দিঘীতে কী একটা মাছ যেনঘাই দেয়। নিস্তরঙ্গ জলে তরঙ্গ ছড়ায়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বললেন, জানি প্রশ্নটা আপনি করবেন।
জানেন মানে? শত্তকত বৃদ্ধের মুখখুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।
এর আগে যারা ওই পুরানবাড়িতে ছিল তারা সবাই আমাকে ওই একই প্রশ্ন করেছে।
ওহ্ ।
শোনেন, বলি তা হলে । বিশ্বাস করবেন কিনা সেটি আপনার ব্যাপার।পুরান বাড়ি এক অশরীরী আছে। কার্তিক মাসে তাকে দেখা যায়।
শওকত চমকে ওঠে। অস্ফুটস্বরে বলল, অশরীরী? মানে?
উত্তর না দিয়ে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য চুপ করে থাকেন। বৃদ্ধ পুরোহিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভোরের এই নির্জনতায় দীর্ঘশ্বাস পতনের শব্দ পরিস্কার শোনা যায়। প্রায় অনুচ্চস্বরে বৃদ্ধ পুরোহিত বললেন, তখন যুদ্ধের বছর। এক বছর আগে আমি যশোহর থেকে সুলতানগঞ্জেএসেছি। শিব মন্দিরে পূর্জঅচ্চনা করি। রাইচরণ নামে আমার এক সেবায়েত ছিল । ভারি গরিবসে। রাইচরণের ছিল পরমা সুন্দরী এক যুবতী কন্যা। কন্যার নাম অর্চনা।
শওকত চমকে ওঠে। কি নাম বললেন?
অর্চনা।
ওহ্ ।
অর্থের অভাবে অর্চনার বিবাহ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমিও যে সাহায্য করব আমার সে উপায় ছিল না। কন্যাদায়গ্রস্থ ম্যালেরিয়ায় রাইচরণ মারা যায়। অসহায় অর্চনা পুরাণবাড়িতে কাজ নেয়। পুরান বাড়িতে বাস করত এক পাকিস্তানি পরিবার । বাড়ির কর্তা ছিল ব্যবসায়ী। নাম জামশেদখান। বেগম ছাড়াও এক কন্যা আর তিনপুত্র ছিল তার । অর্চনা হিন্দুঘরের মেয়ে, সন্ধ্যায় মেয়েটি ধূপ জ্বালাত। পাকিস্তানি পরিবারের ধূপের গন্ধটা না-পছন্দ ছিল। তারা অর্চনাকে ধূপ জ্বালাতে নিষেধ করে। আসলে বাঙালি বলে, কালো বলে, হিন্দু বলে তারা নানান ছুতায় অর্চনার ওপর অত্যাচার-নির্যাতনকরত। পূর্ব-পাকিস্তানে শেখমুজিব পাকিস্তানবিরোধী গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাবে-এই আশঙ্কায় পাকিস্তানিরা আক্রশবশতঅর্চনার উপড় রাগ ঝাড়ত। আসলে জামশেদ খান আর তার বড় ছেলে জুনায়েদ খানের নজর পড়ছিল টলটলে শরীরের উপর।
কিন্তু, … কিন্তু, এসব কথা আপনি জানলেন কী করে?
পুরানবাড়ির বাগানে মালি ছিল সালামত আলী । বিহারী হলেও সে ছিলউদার হৃদয়ের। অর্চনা তাকে সব বলেছিল। অর্চনা পালিয়ে যেতে পারছিল না, বাবা নেই, তারাও তাকে এক রকম বন্দি করে রেখেছিল। যুদ্ধ শুরু হলে জামশেদ খান পরিবারকে লাহোর পাঠিয়ে দেন। পুরানবাড়িতে থাকল সে আর তার বড় ছেলে । পুরানবাড়ি পরে পাকিস্তানি আর্মি অফিসারদের আস্তানা হয়ে উঠেছিল। দিনদিন অর্চনার ওপর অত্যচারের মাত্রা বাড়ছিল। একদিন অর্চনাকে ছাদে নিয়ে তারা ধর্ষন করে। পাকিস্তানি আর্মি অফিসাররাও ছিল। তারপর মেয়েটার গায়ে কেরোসিন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে।
শওকত চমকে ওঠে।