লিফটের কাছে তাঁকে রিসীভ করে বললাম, এসো সাদেক মিঞা। কেমন আছ?
আল্লায় তার বান্দারে রাখছে। আপনার শরীর ভালো নি?
আমি ভালো।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতে করতে বললাম। বস। আরাম করে।
সাদেক মিঞা সোফায় বসল। এদিক-ওদিক দেখছে। ড্রইংরুমটা তেমন সাজাগো গোছানো না। বইপত্র ছড়ানো।
সাদেক মিঞার হাতে একটা পাটের ব্যাগ। অতি গ্রাম্য চেহারা । পরনে পুরনো হলেও পরিস্কার সাদা লুঙ্গি আর খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় কাপড়ের টুপি। গোলপানা হলদেমঙ্গোলয়েড চেহারা। ভুঁরু কম। তবেভরাট মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি।
জিজ্ঞেস করলাম, ঢাকা কবে এলে?
গতকাল নরসিংদী আইছিলাম । শিবপুর।হারুন চেয়ারম্যান ছারের ভিটায় একটা জিনিস ভর করছিল। সেইটারে ভোররাইতে পাটের বস্তায় বাইন্দা আইজ ভোর ভোর টাইমে যাত্রা করছি।
ও। সাদেক মিঞার জগৎ ভিন্ন।সেই জগতে ঘটনার কার্যকারণ অন্য রকম। যা আমাদের নিত্য দিনের জীবনযাত্রার সঙ্গে মেলে না। জিনিস বলতে সে জগতে জিনভূত বোঝায়।
সাদেক মিঞা কী বলতে যাবে -অমনি ঝনঝন করে টিএনটি ফোনটা বাজল । শবনম।
বললাম, হ্যালো। শবনম। বল।
ভাইজান আদিত্য কে ফোনে পাচ্ছি না।
ওনা কয়েক দিন আগে খুলনা গেল। সুতারখালী না কই-
হ্যাঁ। আদিত্যর ফোন বন্ধ। কাল রাত থেকে ফোনে পাচ্ছি না।আজ সকালেও পাচ্ছি না।
সে কী! আচ্ছা আমি খোঁজ নিচ্ছি। তুই অত ভাবিস না। বলে অফ করে দিই। পাত্তা দিলাম না। শবনম- এর টেনশন করার বাতিক আছে। আদিত্য আমার অতি আদরের ভাগ্নে। আমার মতোই স্বভাবচরিত্র ওর । কী এক নেশায় বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। এদিকে ওর মায়ের টেনশন আর টেনশন।
সামান্য তেজারতি স্যার। বলে পাটের ব্যাগটা দেখলো সাদেক মিঞা ।
কি দরকার ছিল বলে ব্যাগটা রান্না ঘরে নিয়ে গেলাম।টের পেলাম আমার মন কিছুটা বিষন্ন হয়ে রয়েছে । আসলে আমারও আদিত্যর জন্য টেনশন হচ্ছিল। বড় ছন্নছাড়া ছেলে-কখন কোন্ বিপদে জড়ায় কে জানে ।আদিত্য বুয়েটে পড়ছে। ওর মা-বাবা চাইছে ওকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে। আদিত্য বাইরে যাবে না। এমন ত্যাঁদোড় ছেলে।
পাটের ব্যাগের ভিতর কাঁচা কলা, কাকরোল, দুটো কাঁচা পেঁপে দেখলাম। আখের গুড় আর এক শিশি কালিজিরার তেলও আছে ।ওগুলো বের করে ব্যাগটা রান্নাঘরে রাখলাম।
ড্রইংরুমে ফিরে এসে সাদেক মিঞাকেজিজ্ঞেস করলাম, সে কিছু খাবে কিনা?
না। হারুন চেয়ারম্যান ছারে খাসীরগোশতের বিরানি পাকায়ছিল।খাইছি পেট ভইরা।
ও। তাহলে পরে খেও। আমি রান্নাবান্না করে রাখব। বলে একটাকাপে সাদেক মিঞাকে চা দিলাম। চা খেয়ে সাদেক মিঞা বলল, স্যার আমার একটুখানি ঘুমান দরকার। জিনিসটা ধরতে সারা রাইত হারুন চেয়ারম্যানছারের পুকুরের পাড়ে জাম্বুরা গাছে বইসা ছিলাম। মশায় কামড়াইছে।
আচ্ছা, তুমি তাহলে রেস্ট নাও। গোছল করবে?
হইলে ভালো হয়।
সাদেক মিঞা কে গেস্টরূমের লাগোয়াবাথরুমটা দেখিয়ে দিলাম। তারপর সর্ষের তেলের শিশি আর নতুন একটা লাক্স সাবান দিলাম। নতুন তোয়ালে বাথরুমেই আছে।
সাদেক মিঞা গোছল সেরে শুয়ে পড়ল।
ইলেকট্রিশিয়ান সাইফুল এল। বললাম,দেখ তো বাবা ইন্টারকমটা কি হয়েছে । সাইফুল দুমিনিটেই ঠিক করে ফেলল । ওকে ৫০টাকা দিয়ে বিদায় করলাম।তারপর জেসমিন কে ইন্টারকমে ফোন করলাম। বললাম, আমার একজন গেস্ট এসেছে। রান্নাবান্না করা দরকার। তুমি কিহাজেরাকে পাঠাতে পারবে? অসুবিধে হবে?
না না, অসুবিধে হবে না মামা। নাসরীন এসেছে। আমি ওকে এখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বললাম, আচ্ছা মেয়েটির কোথায় বাড়ি কোথায় বলেছে?
খুলনা।
খুলনা কোথায়?
দাকোপ। সুতারখালি।
সুতারখালি শব্দটা শুনে আদিত্যর কথা মনে পড়ল। কী হল ছেলেটার?
রিসিভার রাখতেই কলিংবেল বাজল। হাজেরা? এত তাড়াতাড়ি। দরজা খুললাম। বছর তিরিশের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো শীর্ণ শরীর। পরনে সবজে শাড়ি ।
বললাম, তুমি হাজেরা?
হ।
চুলা ধরাতে পার?
পারি।
যাও তাহলে ভাত আর ডাল বসিয়ে দাও। আমি এখন বাজারে যাচ্ছি।
হাজেরা নিঃশব্দে রান্নঘরে চলে গেল।
বাজার কাজেই । আলুপটল ছাড়াও পঁচিশটা কই মাছ কিনলাম। মাছওয়ালার নাম মুসলিম। আমার পরিচিত। তরতাজা মাছই দিল। সেবার সাদেক মিঞা বলেছিল তার নাকি কইভাজা আর কইমাছের তরকারি খেতে ভালো লাগে । গতবছর আমার বিপদের সময় সে অনেক সেবাযত্ন করেছে। তাকে সামান্য আপ্যায়ন না করলে কেমন দেখায়। আমার আবার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আছে। দু ডজন কলা আর ইসুফগুলের ভূষি কিনে বাড়ি ফিরলাম।
ফিরতে ফিরতে প্রায় ১১টা বাজল।
লিফটের কাছে আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে দেখলাম । ভাঙাচোরা চেহারা। চুল উশখোখুশকো। চোখ লাল। পরনের টি-শার্টটা মলিন।শ্যামলা মুখে ক্লান্তির ছাপ।
কি হয়েছে রে তোর? এ কি চেহারা করেছিস?
আদিত্য ফিসফিস করে বলল, ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম মামা।
আহা। সে তো বুঝলাম । তাই বলে মাকে ফোন করে জানাবি না কই আছিস।
ফোন তো ফেলে এসেছি। পরে আর সময় পাইনি। একটু আগে বাস থেকে নামলাম।
লিফট এসে গেছে। বললাম, আচ্ছা সব শুনছি। আগে ওপরে চল।
ওকে নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। পকেটে চাবি ছিল। কলিংবেল বাজাতে হল না। নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে আদিত্যকে আমার ঘরে বসতে বললাম। তারপর বাজার নিয়ে রান্না ঘরে গেলাম। দেখলাম ডাল চুলায়। হাজেরা কিচেনের বারান্দায় ভাতের মাড় গালছিল। আমাকে দেখে উঠে এল।
ইচ্ছেই করেই কইগুলো মেঝেতে ফেললাম। ওগুলি তড়পাড়ে লাগল। বললাম, দশটা কই ভাজ আর দশটা আলুপটল পটল দিয়ে রান্না কর।
আইচ্ছা।
আর আমার ঘরে দুকাপ চা দিয়ে যাও।
আইচ্ছা।
ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি বের করে বেডরূমে এলাম। আদিত্য বাথরুম গিয়েছিল একটু পর বেরিয়ে এল। ওকে পানির বোতল দিয়ে চোয়ারে বসলাম। আদিত্য আমার মুখোমুখি বিছানার ওপর বসল। ঢকঢক করে পানি খেল।
আমি বললাম, দাঁড়া আদিত্য তোর মাকেআগে একটা ফোন দিই। তোর মা একেবারেঅস্থির হয়ে উঠেছে।
শবনম ফোন ধরল।
বললাম, আদিত্য আমার কাছে আছে। ও একটু পরে বাড়ি যাবে।
শবনম চেঁচিয়ে উঠল, সে কী ভাইজান! ওর ভিসার কাগজপত্র সব রেডি। কাল অ্যামবাসিতে দাঁড়াতে হবে।
আমি ঝাঁঝ দেখিয়ে বললাম, আদিত্য লন্ডন যেতে চাচ্ছে না। তোরাই ওকে জোর করে পাঠাচ্ছিস।
শবনম শান্তস্বরে বলল, ওকে ফোনটা দাও তো।
আদিত্য গোছল করছে।
শবনম ভীষণ মেজাজি । ফোন রেখে দিল।আদরের ছোটবোন। ফোন অফ করে বললাম, এবার বল তো শুনি কী হয়েছে তোর।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।