অতিপ্রাকৃত [১ম অংশ]

সকালবেলায় জেসমিন-এর ফোন। চাপা স্বরে বলল, মামা, আমার সর্বনাশ হয়েগেছে । আমার কাজের মেয়েটা না পেত্নী!
সাত সকালে এমন ফোন পেয়ে থ হয়ে গেলাম। তবে জেসমিন- এর বিবেচনাবোধ সম্বন্ধে আমার ভালো ধারণা আছে।সুতরাং শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে বুঝলে যে তোমার কাজের মেয়েটা পেত্নী!
জেসমিন বলল, কাজের মেয়েটা নতুন এসেছে। আপনি এখনও দেখেননি। নাম হাজেরা । ভোরবেলা উঠেছি। তো কিছুক্ষণ আগে বাথরুম থেকে ফিরছি।এমন সময় কী মনে করে রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। দেখি হাজেরা রান্নাঘরের মেঝের ওপর বসে কচকচ করে কাঁচা মাছ খাচ্ছে। কই মাছ। দেখে আমা গা কেমন গুলিয়ে উঠল। হাজেরা পেত্নী না তে কী।
আমি খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বল কী। মাছ কি কাঁচাই খাচ্ছিল?
হ্যাঁ, মামা। কাঁচা।লবনও নেয়নি।
ওহ্ । তা, মেয়েটার বয়স কত?
এই তিরিশের কাছাকাছি হবে। বিধবা।৬/৭ বছরে একট মেয়ে আছে। গ্রামে মায়ের কাছে রেখে এসেছে।
জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটা নতুন বললে। কে ঠিক করে দিয়েছে, সোলেমান?
হ্যাঁ।
সোলেমান এ পাড়ায় কাজের মেয়ে সাপলাই দেয়। বললাম, আচ্ছা দেখছি কী করা যায়। তুমি এ নিয়ে ভেব না।
ফোন অফ করে ভাবতে বসলাম। জেসমিনকে সান্ত্বনা দেওয়া দরকার। তার কারণ আছে। আমি বৃদ্ধ এবং বিপত্নীক মানুষ। আমার একটিই মেয়ে। তামান্নার বিয়ে হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়া থাকে। ছ’তলার এই ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি। নিজেই রান্নাবান্না করি, বাজার করি। এই বহুতলের আট তলায় থাকে।জেসমিন আমার ভাগ্নে বুলবুল-এর বউ। বুলবুল একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে উঁচু পদে আছে। অফিস থেকে লোন নিয়েফ্ল্যাট কিনল। আমিও রায়ের বাজারেদু’কাঠা জমি বেচে ফ্ল্যাট কিনলাম। জেসমিন অবশ্য রাতে খাবারটা পাঠায়। গেস্ট এলে জেসমিনওর কাজের মেয়েকে পাঠায়। ঘর ঝাঁট দিতে আসে। বড় ভালো মেয়ে জেসমিন। আমি ওকে মেয়ের মতই দেখি। তাই জেসমিনকে সান্ত্বনা দেওয়া দরকার।
ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাজেরার ব্যাপরটা নিয়ে ভাবতে বসলাম। গত বছর আমি রিটায়ার করেছি। পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপনা করতাম। যৌক্তিক কারণ খোঁজার বাতিক আছে আমার। তাই ভাবলাম কাঁচামাছ খাওয়ার ব্যাপারটা কি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক। এটি কোনও মানসিক সমস্যা? না একটি অতিপ্রাকৃত ঘটনা? কাজের মেয়ে রান্নাঘরে বসে কচকচ করে কাঁচা মাছ খাচ্ছে এ রকম একটি দৃশ্য ডিসগাস্টিং সন্দেহ নেই। জেসমিন পেত্নী বলল। কাঁচা মাছ জাপানিরা খায়। জাপানিরা ওই জাতে পড়ে না। পৃথিবীতে আরও অনেক জাতি কাঁচা মাছ খায়। তারাও ভূত কিপেত্নীবর্গের নয়। তবে কাঁচা মাছ-মাংস খাওয়া সেইফ কিনা ইদানীং তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুনেছি কাঁচা মাছ খেলে গলব্লাডারের সমস্যা হয়।
টেবিলের ওপর তামান্নার পাঠানো ১৩ইঞ্চি ডেল আলট্রাবুক। ‘ইটিং র ফিস- দ্য জেঞ্জারস’ লিখে সার্চ দিলাম গুগলে । পেইজগুলি এলে পড়তে শুরু করলাম। একটা পেজে লিখেছে: দ্য রিপোটের্ড ডেঞ্জার’স অভ ইলনেস বট অন বাই ইটিং র ফিস অ্যান্ড মিট অফন কজ ফিয়ার অ্যান্ড কনফিউঝন ইন দ্য মাইন্ডস অভ দোজ হু ইনজয় সাচ ফুডস, আইদার ফরদেয়ার এসথেটিক অর নিউট্রিশন্যাল বেনিফিটস।
মনে পড়ে গেল আদিত্যর কথা। আদিত্য আমার ছোট বোন শবনম এর ছেলে। খুব ঘুরে বেড়ায় আদিত্য। ওই একবার বলেছিল খুলনার সুতারখালীর এক জেলেপাড়ার লোকজন নাকি কাঁচামাছ খায়।
জেসমিনকে ফোন করলাম।
জ্বী মামা, বলেন।
বললাম, কাঁচামাছ খাওয়ার ব্যাপারটা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয় জেসমিন।
মামা কী বলছেন আপনি? হাজেরা কাঁটাশুদ্ধ কই গিলে খেল।
খেল ঠিক আছে। কাঁচা মাছ পৃথিবীতে অনেকেই খায়। তাই তোমার নতুন কাজের মেয়েটা পেত্নী না!
পেত্নী না!
না।
ও। আচ্ছা ঠিক আছে।
শোন জেসমিন। নেদারল্যান্ডের অধিবাসীরা বছরের একটা সময়ে কাঁচামাছ খায়। যখন হেরিং মাছ বিক্রি করার মৌসুম শুরু হয়, তখন খায়। তারা নিশ্চয়ই জিন-ভূত না।
অ।
ফোন রেখে দিলাম।
কলিংবেল বাজল।
কে এল আবার। উঠে দরজা খুলে দেখি- জামাল। এ বহুতলের গার্ড । কথায় অত্যধিক স্যার ব্যবহার করে। বললাম, কি ব্যাপার জামাল?
স্যার, আপনার ইন্টারকম কি নষ্ট, স্যার?
হ্যাঁ।
ফোন করছিলাম স্যার কেউ ধরল না স্যার । স্যার আপনার কাছে এক বেটাআইছে স্যার ।
বেটা? কি নাম? আমি অবাক।
স্যার নাম কইলন স্যার সাদেক মিঞা স্যার। চিনেন স্যার?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনি চিনি। যাও ওকে নিয়ে এসো। আর সাইফুল কে পাঠাও। ইন্টারকম ঠিক করে দিয়ে যাবে।
আইচছা স্যার । বলে জামাল চলে গেল।
আশ্চর্য! সাদেক মিঞা ঢাকায়? সাদেক মিঞার মোবাইল আছে। আমার নাম্বারও সে জানে। তাহলে সে আমাকে ফোন করল না কেন। আসলে সাদেকমিঞা ভারি অদ্ভূত এক মানুষ। নিজেকে তান্ত্রিক বলে পরিচয় দেয়।অশুভ যাদুটোনা বন করে। তবে আমার এসব ব্ল্যাকআর্টে বিশ্বাস হয় না। দাড়ি-টুপি পরা মুসল্লী চেহারা একজন লোক তান্ত্রিক হয় কী ভাবে। গতবছর জুন মাসে দিনাজপুরে সাদেক মিঞার সঙ্গে আমার পরিচয়। সদ্য স্ত্রী মারা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে উদভ্রান্তের মতন এখানে-ওখানে ঘুরছি। বিরল রেলস্টেশনে এক বেঞ্চির ওপর মাঝরাতে বসে আছি। বাইরে তুমুল বৃষ্টি । সাদেক মিঞাও বসেছিল। বয়স ঠিক বোঝা গেলনা। তবে পঞ্চাশ পেরিয়েছে। সেইযেচে আলাপ করল।বিষয়: সাপের মাথার মনি, লালমাই পাহাড়ের গোপন সুড়ঙ আরকামরূপ কামাখ্যা মন্দির।এসব রূপকথা শুনতে শুনতে স্টেশনেই কেঁপে জ্বর এল । বৃষ্টি থামলে সাদেক মিঞা ধরাধরি করে এক পুরনো পরিত্যক্ত মাজারের পিছনে একটা টিনসেডের ঘরে নিয়ে তুলল। তারপর মন্ত্রপূত কালিজিরার তেল খাইয়ে জ্বর সারিয়ে তুলল।তার ওখানে দিন সাতেক ছিলাম। সাদেক মিঞা ভারি যত্ন নিয়েছিল আমার । কত রহস্যময় সব গল্প শোনালো। একবার জিন নামাতে চেয়েছিল । আমার শরীর কাহিল ছিল তাই জিন দেখতে ইচ্ছা হয়নি। দিনাজপুর থেকে আসার সময় সাদেক মিঞাকে ঢাকার ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। সাদেক মিঞা এর আগে কখনও আমার ফ্ল্যাটে আসেনি । আজই প্রথম এল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!