কমলদিঘির পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে শাওন বলেছিল, একটা মেয়ে ওকে কমলদিঘিতে টেনে নিয়ে যাবে। কমলদিঘিতে ভোরবেলা ওর লাশ ভাসবে… কতকাল পর শাওনের কথা মনে করে শিউরে ওঠে তানিম । শাওনের কথা সত্যি হয়েছিল। ভোরবেলা কমলদিঘিতে ওর লাশ ভেসেছিল ।
বৈশাখের দুপুরে হঠাৎই প্রচন্ড শীত বোধ করে তানিম। অথচ চারপাশে ছড়িয়ে আছে আগুন-ছড়ানো খর রোদ্দুর। নির্জন দুপুরে এক ঝাঁক টিয়ে টি টি শব্দ করতে করতে উড়ে যায় কমলদিঘির ওপর দিয়ে উত্তরের শালজঙ্গলের দিকে। এ দিককার দিঘিরঘাটটি বেশ প্রশস্ত। পুরনো ইটের তৈরি, সিঁড়ির ধাপে-ধাপে শ্যাওলা জমে আছে। কমলদিঘিটি বেশ প্রাচীন । টলটলে কালচে রঙের পানি। এ দেশে যেমনটা হয়, কমলদিঘি ঘিরেও কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে। চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে স্থানীয় সনাতনধর্মাবলম্বীরা দিঘিপাড়ে পূজা- অর্চ্চনা করে। কাল মোবাশ্বের চাচা এসব কথাই তানিমকে বলছিলেন।
অনেক বছর পর কমলনগর এল তানিম। তা ৭/৮ বছর তো হবেই। তানিম তখন স্কুলে পড়ত। ক্লাস সেভেনে। দু’চোখে রাজ্যের কৌতূহল। সব ঘুরেফিরে দেখে অবাক। পুরনো জমিদার আমলের দোতলা দালান। তবে সবটাই এখন আর অবশ্য বসবাসের উপযোগি নয়। দিনের বেলায় কেমন অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকে। দালানের পিছনে ফলের বিশাল বাগান। আম-জাম-লিচুই বেশি, তবে আমলকি, জলপাই আর কামরাঙার গাছও আছে। কমলদিঘিটা মূল দালানের সামনে । এই অঞ্চলের একটি প্রাচীন বংশের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে। তানিমের দাদুবাড়িটি এ অঞ্চলের লোকে বলে: ‘দৌজাবাড়ি’। দৌজাবংশের প্রথম পুরুষ শাফাতউজ দৌজা নাকি দোদর্ন্ড প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন; সাড়ে ছ’ ফুট উচ্চতার বলিষ্ট শরীরে নাকি বাঘের মতন শক্তি ছিল। একরোখা রাগী শাফাতউজ দৌজার ভয়ে নাকি বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত। তবে এ অঞ্চলের লোকে বলে, জমিদার শাফাতউজ দৌজা যেমন অত্যাচারী ছিলেন, তেমনি ছিলেন দয়ালু; কর আদায়ে যেমন নির্মম ছিলেন, আবার প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য নিজস্ব উদ্যেগে দিঘি খনন করিয়েছিলেন। তবে অমন বিশাদেহী পালোয়ানের মতন মানুষটির লাশ কেনই-বা এক ভোরে কমলদিঘির জলে ভাসতে দেখা গিয়েছিল-সেও এক অমীমাংশিত রহস্য বটে …
তানিম ওর দাদুবাড়ি শেষবার যখন এসেছিল তখনও ওর বাবা বেঁচে ছিলেন। মোবাশ্বের চাচার স্ত্রী মনোয়ারা চাচী বেঁচে ছিলেন, মোবাশ্বের চাচার ছেলে শাওনও বেঁচে ছিল … শাওন অবশ্য তানিমরা কমলনগর থাকতে থাকতেই দিঘিতে ডুবেমারা গিয়েছিল …
দোতলার অলিন্দে দাঁড়িয়েছিল তানিম। বৈশাখের দুপুর ঝাঁঝাঁ করছিল। লোহার রেলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে একটা কাক ডাকছিল। নির্জনদুপুর বলে কাকের ডাক আরও গভীর শোনায়। তানিম একটা সিগারেট ধরায়।মোবাশ্বের চাচারা নীচতলায় থাকে। দোতলায় সার সার ঘর। তারই একটা ঘরেমা ঘুমিয়ে। গত রাতে মার ভালো ঘুম হয়নি। অথচ মা ক্লান্ত ছিল। ওরা ঢাকা থেকে রওনা হয়ে কমলনগর পৌঁছেছে বিকেলে। ড্রাইভার মকবুল ছুটিতে। তানিমই ড্রাইভ করছিল।
কমলনগর আসার বিশেষ একটা কারণ ছিল। কমলনগরে তানিমদের পৈত্রিক সম্পত্তির পরিমান কম না। মোবাশ্বের চাচা একাই ভোগদখল করছেন। মার এখানেই আপত্তি। দিন কয়েক আগে মা বলল, কমলনগরে তোদের অনেক জায়গাজমি পড়ে আছে। তুইও যখন সম্পত্তির অংশীদার- তখন মিছিমিছিদেশের জমি ফেলে রাখবি কেন? তোর বাবা বেঁচে থাকলে না-হয় একটা কথা ছিল।
সে জন্যই আসা। কিন্তু, সিফাতজান ফুপু ভয় ধরিয়ে দিলেন। সিফাতজান ফুপুর অনেক বয়স। সত্তর তো হবেই। ধবধবে ফরসা, শনের মত চুল, চোখ দুটি ঘোলা। সিফাতজান ফুপু এ বাড়ির বড় মেয়ে। অল্পবয়েসেই বিধবা হয়েছিলেন, তারপর থেকে বাবার বাড়িতেই আছেন। সিফাতজান ফুপু খনখনে গলায় বললেন, ও রেহনুমা। তোমরা এইখান থেকে কালই চইলা যাও।
কেন? চলে যাব কেন? মায়ের মুখ কেমন থমথমে হয়ে উঠল।
সিফাতজান ফুপু একটুখানি চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, কমলদিঘিতে মোবাশ্বেরের পোলা শাওন রে টাইনা নিয়া গেছে। এইবার তোমার পোলা রেও নিব দেইখো।
যাঃ। আপনি এসব কী যা তা বলছেন!
তানিম জানে মা চিন্তাভাবনায় আধুনিক। ঢাকার একটি মহিলা কলেজে ইতিহাস পড়ান। উন্নয়নকর্মী। মা এসব গ্রামীণ কুসংস্কারে বিশ্বাস করবে কেন?
তবে সিফাতজান ফুপুর কথা শোনার পর থেকে মা কেমন গম্ভীর হয়ে উঠল। মা গজগজ করতে করতে বলছিল, বুড়ির মাথাখারাপ। আসলে এ বাড়ির সম্পত্তি একাই জমি গ্রাস করবে বলে বুড়ি ভাইয়ের সঙ্গে জোট পাকিয়েছে।
রাতে মার আর ঘুম হয়নি। মা এখন ঘুমিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু, সিফাতজান ফুপু যে বললেন, ‘ কমলদিঘিতে মোবাশ্বেরের পোলা শাওন রে টাইনা নিয়া গেছে। এইবার তোমার পোলা রেও নিব দেইখো।’ … এই কথার কি মানে? শাওনের মৃত্যু কি নিছক অ্যাকসিডেন্ট নয়? যদি তাই হয় তাহলে শাওন কেন বলবে-একটা মেয়েওকে কমলদিঘিতে টেনে নিয়ে যাবে। শাওনের কথা তো সত্যি হয়েছিল। ভোরবেলা ওর লাশ ভেসেছিল কমলদিঘিতে।
তানিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে কমলদিঘির দিকে তাকায়। দিঘির জলে রোদ পড়ে ঝিকঝিক করছিল। তানিমের গা ছমছম করে। কী এক রহস্য আছে কমলদিঘি ঘিরে? কি সেই রহস্য?
শেষবার যখন কমলনগর এসেছিল তানিম, শাওনের সঙ্গেই ঘুরত তানিম। মোবাশ্বের কাকার ছেলে শাওন তানিমেরই সমবয়েসি। ক্লাস সেভেনে পড়ত। এক দুপুরে খাওয়ার পর দিঘির পাড় ধরে হাঁটছিল। গায়ের রং শ্যামলা। সরল নিষ্পাপ চোখ। পরনে নীল রঙের হাফপ্যান্ট, সাদা গেঞ্জি। হঠাৎ শাওন বলল, আমি মারা যাব তানিম।
মারা যাব মানে! হাতের ঝিনুক কমলদিঘিতে ছুড়ে তানিম বলে। দিঘি রোদে ভাসছিল । নির্জন ঝিম-ধরানো ফড়িং-ওরা দুপুর। মাথার ওপরে একটা নির্জন নীল আকাশ। শাওনের কথা কেমন অলীক মনে হয়।
শাওন বলে, তুমি জান না, আমাদের বংশের একজন করে কমলদিঘিতে ডুবে মারা যায়।
কমলদিঘিতে ডুবে মারা যায়? তোকে কে বলল?
সিফাতজান ফুপু বলছে। কেন তুমি জান না? মোজাম্মেল চাচা কমলদিঘিতে ডুবে মারা মারা গেছে।
মোজাম্মেল চাচা পানিতে ডুবে মারাগেছেন? তানিমের বুকটা ধপ করে ওঠে। ওর হাত-পা শিরশির করে।
হ্যাঁ। কেন তুমি জান না? একটা মেয়ে পূর্ণিমার রাতে কমলদিঘি থেকে ঘাটে উইঠা আসে। সেই তো মোজাম্মেল চাচা রে টাইনা নিয়া গেছে।