রণকের স্কুলব্যাগ

এক দুষ্টু ছেলে। তার নাম রণক। ও কালো রঙের ব্যাগ নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যায়। সেদিন সোমবার। ও একা স্কুলে যাচ্ছে। এক বৃদ্ধা লাঠি ভর দিয়ে ওই পথে দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি রণককে দেখে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললেন, ‘এই ছেলে, এদিকে একটু আসবে?’
রণক কাছে এলো। বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথায় যাও ?’
রণক শরীরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পরনে স্কুলড্রেস। কাঁধে স্কুলব্যাগ। দেখে বুঝতে পারেন না, আমি কোথায় যাই?’
বৃদ্ধা রণকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, ‘ও, তুমি স্কুলে যাও’
রণক মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘এতক্ষণে বুঝতে পারলেন।’
বৃদ্ধা লাঠিতে ভর দিয়ে মাথাটা নিচু করে বললেন, ‘বয়স হয়েছে, চোখে খুব কম দেখি। তাই সব কিছু সহজে বুঝতে পারি না। তবে তোমার স্কুলব্যাগটা আমার চোখে খুব সুন্দর লেগেছে।’
প্রশংশা শুনে মামার কথা মনে পড়লো রণকের। মামার বাড়ির জিনিস পাওয়ার আনন্দ মনে নিয়ে বলল, ‘সুন্দর তো হবেই। মামা জন্মদিনে ব্যাগটা উপহার দিয়েছেন আমাকে।’
বৃদ্ধা আবার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার ব্যাগে কী কী আছে ?’
রণক ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সামনে নিয়ে এসে বলল, ‘আপনি জানেন না। স্কুলব্যাগে কী কী থাকে ?’
‘জানি। স্কুলব্যাগে বই, খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স। আরো কত কিছু থাকে।’
রণক ভাবল, বৃদ্ধা মানুষটা কী কোনো গোয়েন্দা! না, এই বয়সে…!
ভাবার পর তাকে বলল, ‘ব্যাগে জিনিস আছে। আপনাকে বলা যাবে না।’
‘কেন ?’
‘বললাম তো, বলা যাবে না।’
রণকের এমন একরোখা কথা শুনে বৃদ্ধার জানার আগ্রহ প্রচণ্ড বেড়ে গেল। ব্যাগের ভেতর কী আছে ? মনে মনে ভাবতে লাগল। এই ছেলের ব্যাগে টিফিনের খাবার আছে। চাইলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। বৃদ্ধা ব্যাগের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘জানো, আমি গতকাল কিছু খাইনি। আজও এখন পর্যন্ত খেতে পাইনি। ক্ষুধার জ্বালায় পেটের ভেতর আগুন জ্বলছে। খাবার পেলে নিভে যাবে।’
রণক বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চলেন, আম গাছের নিচে বসি।’
গাছের নিচে গেল ওরা। গাছের ছায়ায় বসল দুজন।
রণক ব্যাগের ভেতর থেকে খাবারের বক্স আর পানির বোতল বের করল। খাবার দেখে অবাক হলো। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। তবু খেতে চাচ্ছে না বৃদ্ধাটি ।
রণক বলল, ‘খাবে না কেন?’
বৃদ্ধার যেন পেট ভরে গেছে, রণকের খাবার দেখেই। মৃদু হেসে বললেন, ‘তুমি খেতে দিতে চেয়েছ তাতেই আমি খুশি হয়েছি। আমি দুই চার দিন না খেয়ে থাকতে পারব। কিন্তু তুমি ছোট মানুষ একবেলা না খেলে তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। পড়াশোনার ক্ষতি হবে। বন্ধুদের সঙ্গে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বে। তুমি স্কুলে নিয়ে যাও। টিফিনের সময় খেয়ে নিও। তুমি হলো ভবিষ্যৎ জাতির কর্ণধার।’
রণক বৃদ্ধার কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনে বলল, ‘আপনাকে খেতেই হবে। আপনি খুব ক্ষুধার্ত। আমার পকেটে টাকা আছে। আজকের মতো স্কুলের পাশের দোকান থেকে কেক, কলা কিনে খাব।’
অবশেষে বৃদ্ধাটি খেতে রাজি হলেন। ভাত খাওয়া শেষে বৃদ্ধাটি রণকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি অনেক বড় মনের মানুষ হও। লেখা-পড়ার প্রতি মনোযোগ দাও। একজন ভালো মানুষের মতো ভালো মানুষ হয়ে দেশ ও জাতি গঠনে নিজেকে গড়ে তোলো।’
‘আমার জন্য দোয়া করবেন। ক্লাসের সময় হয়ে এল। এখন যাই।’
বৃদ্ধাটি বসে রইলেন। রণক স্কুলের উদ্দেশে রওনা হলো।
রণক স্কুলে পৌঁছেই ক্লাসরুমে ঢুকেই দেখতে পেলো, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। ও ব্যাগটা প্রথম সারির বেঞ্চে রেখেই সহপাঠী বন্ধুদের বলল, ‘কী রে, কী হয়েছে তোদের?’
পবিত্র রণককে বলল, ‘রুবীর খাতা, কলম, কামালের ব্যাগে কে যেন ঢুকিয়ে রেখেছে। কে এই কাজ করল এই নিয়েই ঝগড়া হচ্ছে।’
রণক কথাগুলো শোনার পর জোরে একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘তোরা চুপ কর। আমার ব্যাগে একটা জিনিস নিয়ে এসেছি, তোদের দেখানোর জন্য। দেখবি কী ?’
সবাই রণকের দিকে তাকাল । রণক বলল, ‘তোদের সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি। আমি জানি কে এই কাজ করেছে। ’
কেউ কেউ রণককে বলল, ‘তুই, জানিস কী করে ? এ কাজ করেছে তার কি তুই বুদ্ধিদাতা ?’
রণক জোরে দিয়ে বলল, ‘আমিতো মাত্র এলাম।’
মিলন বলল, ‘তোর ব্যাগে কী আছে, আগে দেখা।’
‘আগে সমস্যার সমাধান করি, তারপর ব্যাগে কী আছে দেখাব। আচ্ছা, তোরা বলতো আমাদের ক্লাসে স্কুলব্যাগ নেই কার কার ? যাদের নেই তারা হাত উপরে তোল।’
রণকের কথামতো হাত ওঠালো রাজীব, সুমন, আর মামুন।
রণক বেঞ্চের উপরে উঠে ব্যাগ যাদের আছে তাদের উদ্দেশে বলল, ‘তোদের কি মনে আছে বৃষ্টির দিনে কামালের বই, খাতা, রাজীবের স্কুলব্যাগে নেয়নি। ও সেই দিন বলেছিল ব্যাগওয়ালাদের দেখে নেব। নিশ্চিয় ও এই কাজ করেছে।’
সবাই মাথা নাড়াল।
রণকের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজীব বলল, ‘যা রুবীর ব্যাগ থেকে খাতা কলম নিয়ে ঢুকালাম কখন?’
রুবী বলল, ‘ব্যাগ রেখে কমন রুমে গিয়েছিলাম, তখন হয়তো সরিয়েছে।’
কামাল বলল, ‘আমিও তো স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এই সুযোগে কাজটা করেছে।’
রণক বলল, ’ও, সেই জন্যই তো এখন তিনজন দল বেঁধে সবার আগে আগে ক্লাসে আসা হয়।’
ওরা তিনজন ভয়ে আর কোনো কথা বলে না। ওদের চোখ মুখের অবস্থা দেখে বোঝা গেল কাজটা ওরা তিনজনই করেছে।
রণক বলল, ‘ওদের এখন কি শাস্তি দেওয়া যায়?’
ক্লাসরুমে সবাই বলল, ‘বেঞ্চের ওপর কান ধরে উঠ-বস করতে হবে।’
রুবী বলল, ‘না কান ধরে উঠ-বস করতে হবে না। এমন কাজ আর যেন কখনো না করে তাহলেই হবে।’
রণক বলল, ওরা তো আমাদের বন্ধু। শাস্তি দিয়ে কি লাভ ? তার চেয়ে এক কাজ করি, শাস্তি না দিয়ে উপহার দিই।’
রণকের কথা শুনে ক্লাসের সবাই অবাক হলো শাস্তি বদলে উপহার!
পবিত্র বলল, ‘শাস্তি না দিয়ে কী উপহার দিবি ?’
রণক হাত দিয়ে ব্যাগগুলো দেখিয়ে বলল, ‘দেখ আমাদের সবার স্কুলব্যাগ আছে। কিন্তু রাজীব, সুমন, মামুনের স্কুলব্যাগ নেই। আমাদের সবার কাছ থেকে দশ টাকা, বিশ টাকা করে চাঁদা ওঠাতে হবে। আর এই টাকা দিয়ে ওদের স্কুলব্যাগ কিনে দেব। আগামীকাল সবাই দশ-বিশটা করে টাকা নিয়ে আসবি।’
কেউ কেউ মুখে রাজি হলো। কেউ বা মাথা নাড়াতে নাড়াতে স্বীকার করল। ক্লাসের ঘণ্টা বেজে উঠল। ওরা যার যার বেঞ্চে বসে পড়ল। একটু পর বাংলা পড়াতে আশরাফুল স্যার ক্লাসরুমে ঢুকলেন…।
পরের দিন। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে রণক সবার কাছে থেকে টাকা ওঠালো। টিফিনের ঘণ্টা পড়ল। সবাই মিলে স্কুলের পাশের মার্কেটে গিয়ে তিনটা স্কুলব্যাগ কিনে রাজীব সুমন মামুনকে উপহার দিল। ওরা তিনজন ব্যাগ পেয়ে মহাখুশি। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ঝলমল করছে। আজকের মতো ক্লাস শেষ। ছুটির ঘণ্টা বাজলো। ক্লাসের সবাই কাঁধে স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে বের হলো মনের আনন্দে …!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!