তখন গভীর রাত।দরজায় ঠুক,ঠুক,ঠুক করে তিনবার আওয়াজ হল। কারো কান পর্যন্ত গেল না সে আওয়াজ। আবার তিনবার আওয়াজ ঠুক,ঠুক, ঠুক।না,এবারও কারো সাড়া নেই। মাঝারি ধরণের শব্দটা,যার জন্য কারো কানে যায় নি। সবাই নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন ছিল। তৃতীয় বার ঠুক, ঠুক, ঠুক শব্দেঅনিমেষের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। হ্যাঁ স্পষ্ট শুনেছেন তিনি,কেউ দরজায় আওয়াজ করছে ! অন্ধকারেই দেওয়াল ঘড়িটা দেখার চেষ্টা করলেন তিনি–বেশরাত,পৌনে একটা বাজে..উঠে ধীরে ধীরে দরজার কাছে গেলেন। শব্দটা আবার শোনার জন্য কান পেতে রইলেন। বাইরে হওয়া চলছে–শনশন একটা শব্দআসছে বটে কিন্তু দরজা ধাক্কার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছেন তিনি ! এমনি সময় বাইরে ঠাস,করে একটা কিছু পড়ার শব্দ হল। হ্যাঁ, কারো ভারী পায়ের আওয়াজ, দপ দপ করে চলে যাবার সঙ্কেত দিল!কিছুটা ভয় ভয় লাগছিল অনিমেষের। তাঁর গলা থেকে হালকা চাপা স্বর বেরিয়ে এলো—‘কে, কে বাইরে?’ বাইরের পায়ের শব্দটা দ্রুত দূরের দিকে মিলিয়েগেল। ততক্ষণে তাঁর স্ত্রী, কমলিকা বিছানা ছেড়ে উঠে টিপে টিপে পা ফেলে অনিমেষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
–‘কি হল গো ! এত রাতে তুমি এখানে !’ কমলিকা ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো। ওঁর কানে ঠুক ঠাক দরজার শব্দ হওয়া, বাইরে কিছু পতনের আওয়াজ বা কারো পায়ের ধুপ ধাপ শব্দ কোনটাই যায় নি।
চাপা স্বরে অনিমেষ বললেন,
‘কেউ এসে ছিল!’
–‘কে!কে!!’–এবার কমলিকার গলায় আচমকা ভয়ের আওয়াজ জাগল।
যে এসে ছিল সে চোর হোক, ডাকাত হোক–পালিয়ে গেছে। কারো সাহস হল না দরজা খুলে বাইরেটা একবার দেখে আসবার।
তারপর ভোর হল। সমস্ত ভয় কোথায় যেন দূরে চলে গেল। অনিমেষ বাইরে গিয়ে দেখলেন–একটা লাঠি রাখা ছিল দেওয়াল ঘেঁসে, ওটা মাটিতে পড়ে আছে। সামনে বাগানের গেট হাঁ করে খোলা। প্রমাণ পাওয়া গেল যে কেউ এসে ছিল রাতে, তবে দরজা ঠুক ছিল কেন? ওরা জেগে আছেকি না পরখ করতে?
কমলিকা ও অনিমেষের একমাত্র মেয়ে, চয়নিকা। রাতের ঘটনার বিন্দু বিসর্গ সে জানে না, জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বাগানের শিউলি গাছ থেকে টুপ টুপ করে মাটিতে ঝরে পড়ছে কত শত ফুল!গাছের নীচে সাদায় সাদা হয়ে ভরে পড়ে আছে অজস্র শেফালী ফুলেরা! সুন্দর গন্ধ বিলোচ্ছে। সমস্ত বাড়িটা ভরিয়ে দিয়েছে ম ম গন্ধে। ওদের বাড়ির সামনের বাগানটা বারো মাস কিছু না কিছু ফুলে ভরে থাকে। প্রজাপতি ভ্রমরা মেলা বসায় সেখানে..
পূজা এগিয়ে আসছে। এই তো শেফালির ফুটে ওঠার সময়। চন্দ্রমল্লিকা,ডালিয়ার সময় আসছে। একপারে গেঁদা গাছ, একটা দুটো ফুল নিয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে—ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ফোটাবে বলে ওরা যেন গর্ব ভরে অপেক্ষা করছে। চারিদিক থেকে কুয়াশার চাদর গুটিয়ে যাচ্ছে।সূর্য তার নরম হলুদ রং ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে সমস্ত চরাচরে। মিষ্টি এক সকাল–পাখী ডাকছে,আকাশ জেগে উঠছে তার নীল সবুজ ডানা মেলে। এক মহা সমুদ্রেরছবি জেগে উঠেছে সমস্ত শূন্যতা ব্যেপে। নিশ্চুপ সকালের আঙ্গিনায় গুন গুন ভ্রমরের তান, পাখীর কলরব, রংবেরঙের প্রজাপতির আনাগোনায় প্রকৃতি যেন হাটবসিয়েছে !
–‘চয়নিকা,হাত মুখ ধুয়ে নাও,পড়তে বস গিয়ে, বেলা হয়ে যাচ্ছে’–মার কথায় চয়নিকার ধ্যান ভঙ্গ হয়। সে যেন অন্য এক জগত থেকে ফিরে এলো, ‘হ্যাঁ মা,যাচ্ছি,’ মিষ্টি কথা বলে, একটু হেসে হাত মুখধুতে চলে গেল চয়নিকা।
ছুটির দিনে অনিমেষের ভাবনা চলছে সম্পূর্ণ অন্য দিকে। কাল রাতে দরজা ধাক্কা দিতে কে বা কারা এসে ছিল তাদের বাড়ী ? পাড়ার ছেলেরা নয় ত ? দু দিন আগে ওদের সঙ্গে একটু বচসা হয়ে গেছে তাঁর। ছোকরাগুলো একটা খালি বাড়ির বারান্দায় বসেথাকবে আর হই হট্টগোল করবে, রাত দিন ওদের হই হুল্লোড় লেগেই আছে। কেউ কিছু বলতে চায় না ওদেরকে। কে জানে কি বলতে কি বলে বসবে ছেলেছোকরারা ! নিজের সম্মান থাকবে না শেষে। তবু সব কিছুর একটা সীমা আছে—সারা দিন চিত্কার , চেঁচামেচি, উত্কট নাচ গান, এসব নিয়েই আছে ওরা।আশপাশের ঘরের লোকদের সুবিধা অসুবিধার দিকে ওদের বিন্দু মাত্র নজর নেই!
সে দিন ওদের রকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন অনিমেষ। ছেলেগুলো এতো জোরে চিত্কার করে গান আর সেই সঙ্গে অদ্ভুত ধরণের নাচের অঙ্গ ভঙ্গি করছিল যে তিনি চুপ থাকতে পারেন নি, বলে ফেলে ছিলেন, ‘হচ্ছে কি এটা!পাড়ার লোক জনদেরথাকতে দেবে না নাকি তোমরা!’
–‘কি হল মেসোমশাই ? কোথায় যাচ্ছেন–যান না!’-ছোকরাগুলোর মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো।
–‘তোমাদের হই হল্লা,নাচ গান থামাও তো এবার,’ জবাব দেওয়া ছেলেটাকে বলে উঠলেন অনিমেষ।
ওদের মধ্যে থেকে আর একজন ছেলে বলে ওঠে, ‘না মেসো মশাই, আমরা থামবো না, আপনিও না থেমে নিজের কাজে যেখানে যাচ্ছেন চলে যান!’ ছোকরারা হাসতে হাসতে আবার নাচে গানে মত্ত হয়ে গিয়েছিল। ব্যাস,
এ পর্যন্ত। এর আগে অনিমেষ আর কাউকে কিছু বলতে যান নি। বকাটে ছেলেগুলি না জানি এর আগে আরও কত কিছু তাকে বলে দেবে! কিন্তু কাল রাতেরঘটনার সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল রয়েছে বলে মনে হচ্ছে অনিমেষের! এমন নয় ত–ওরাই ওই দিনের প্রতিবাদের বদলা নিচ্ছে! কে জানে! হতেওপারে,ভাবলেন তিনি।
না, চয়নিকার কারো প্রতি কোন অভিযোগ নেই। পাড়ার ছেলেরা কেউ তার পেছনে লাগে না। রকের ছেলেরা খুব একটা তাকে বিরক্ত করে না। একদিন ওদেরমধ্যে বাবলু বলে যে ছেলেটা ছিল–সে কিছু একটা তার নামে বলেছিল। চয়নিকার কানে ঠিক মত তা পৌঁছায় নি, জবাবে ও ধীর স্থির ভাবে বলেছিল, ‘বাবলুদা,মল্লিকা দি ঘরে আছে? আজ আমি একবার তোমাদের ঘরে যাবো।’
মল্লিকা বাবলুর আপন দিদি, চয়নিকাকে ভালো ভাবে চেনে। বাবলু একটু নরম পড়ে যায়, তার পর থেকে কেন জানিনা, বাবলুদের দল ওর পেছনে আর লাগে না।
চয়নিকার কত বা বয়স হবে—বার তের বছরের বেশী হবে না। ধপধপে পরিষ্কার, ফুটফুটে চেহারা, ঠিক যেন ডানাকাটা পরী। ক্লাস এইটে পড়ছে। ধীর স্থির সবদিক থেকে শান্ত মেয়ে। কারো সাতে পাঁচে থাকার কথা সে চিন্তা করে না। সব সময় দলাদলি এড়িয়েযায়। প্রকৃতিকে খুব ভালোবাসে, উপভোগ করার চেষ্টা করে। সব কিছুর ভালো মন্দর মাঝ থেকে ভালোর দিকটাই নিতে সে অভ্যস্ত। বন্ধু বান্ধবীর সংখ্যা খুবকম। মল্লিকাদির সঙ্গে জানা শোনা আছে–এ ছাড়া রমা, অঞ্জু, কান্তা ওদের সঙ্গেও পড়াশুনা নিয়ে কথাবার্তা হয়। কখনো সখনো ওদের বাড়িতে গেছে,
তেমনিওরাও এসেছে চয়নিকার বাড়ি।
মন বলে একটা ছেলে আছে চয়নিকাদের ক্লাসে। বয়সে ওর চেয়ে চার-পাঁচ বছর বড়ই হবে।শ্যাম বর্ণের মধ্যে চাকচিক্যময়, আকর্ষণীয় চেহারা। লম্বাটে, পাতলা, ছিমছাম চেহারা ওর। সাধারণ ভাবে দেখলে মনকেঅস্বাভাবিক বলে মনে হবে না। মানসিক দিক থেকে ও আংশিক বিকলাঙ্গ। ব্রেনের অপূর্ণতার কারণে প্রায় সময় ও অন্যমনস্ক থাকে। মনকে সক্রিয় করে দিলেআবার ও কাজে লেগে যায়। ওর মনটা নাকি বয়সের থেকে অনেক কম বিকশিত! ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, ও কোন সময় বাচ্চাদের মত কথা বলতেথাকে! কোন একটা কথাকে পুনরাবৃত্তি করে,
হাসে, খেলে, ওর নিজস্ব একটা আলাদা জগত আছে বলে মনে হয় চয়নিকার।
মনকে চয়নিকা ভালো করে লক্ষ্য করেছে । পড়াশোনা ধরিয়ে দিলে ও ভালো ভাবে করতে পারে। মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দিতে হয়–ও স্কুলে আছে, ওর হোম ওয়ার্ক দেওয়া আছে, তা ঘর থেকে করে নিয়ে আসতে হবে। ক্লাসে মাষ্টামশায় বা দিদিমণি যখন কোন প্রশ্ন করেন মন তৎক্ষণাৎ জবাব দিতেপারে না। প্রশ্নটা আবার রিপিট করে তার সামনে ধরলে, ওর প্রতি একটু মনোযোগ দিলে, মন প্রায়ই সঠিক উত্তর দেয়!
চয়নিকার ওর প্রতি একটু মনোযোগ বেশী। বেচারা এমত অবস্থায় যদি একটু পড়াশোনা করতে পারে,
কে জানে পড়ালেখা করতে করতে মনের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হতেও পারে !পড়া শুনা করলে হয় তো দেখা যাবে ব্রেনটা ওর স্বাভাবিক কাজ করছে!
মনের মা প্রায়ই আসেন ওদের স্কুলে–ছেলেকে দেখে যান। পড়াশোনা কেমন করছে না করছে তার খোঁজ খবর নিয়ে যান। চয়নিকার সঙ্গে অনেক কথা হয়তাঁর। সভ্য, শান্ত চয়নিকাকে মনের মায়েরও খুব ভালো লাগে। টিচারদের থেকেও ছেলের সম্বন্ধে রিপোর্ট নিয়ে যান তিনি। মনের স্কুলের দেখা শোনার দায়িত্ব টিচারদেরউপর তো আছেই–অলিখিত একটা দায়িত্ব যেন চয়নিকাও অনুভব করে! এ দায়িত্ব কারো থেকে পাওয়া নয়, তার মন থেকেই যেন এটা পালনের নির্দেশপেয়েছে সে।
মনের সঙ্গে সব চেয়ে বড় সমস্যা যেটা সেটা হল স্কুলের ছেলেরা তাকে তামাশার পাত্র বোলে মনে করে–কখনো ওকে আলাদা পেলে, টিচাররা আশেপাশে না থাকলে, সবাইমিলে ওর পিছনে লেগে যায়। এমনি একদিন চয়নিকা কি জন্য যেন ক্লাসের বাইরে গিয়ে ছিল, দেখল এক জাগায় অনেক ছেলেদের জটলা। ও মনে মনে যাসন্দেহ করেছিল তাই। জটলা ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখল–মন কান ধরে উঠ-বস করছে! ছেলের দল আনন্দে তামাশা দেখছে। এমন ঘটনা প্রায়ই হয় আর তারথেকে মনকে উদ্ধার চয়নিকাই করে! ও তাড়াতাড়ি মনকে বলে ওঠে, ‘মন, তোর টিচার ডাকছেন, তুই এখানে কি করছিস?’
–‘আমি পড়া পারিনি ত তাই কান ধরে উঠ-বস করছি,’
অম্লান বদনে বলে ওঠে মন।ওকে ক্লাসে নিয়ে যায় চয়নিকা।
মন যখন রেগে যায় তখন তার অন্য রূপ। রাগে খুব কম, চরম সীমা পার হয়ে গেলে ফস করে হয়তো সে রেগে গেল। তখন মনের মনটাতেই যত গণ্ডগোল! ও নিজেই জানে না কখন মনের মাঝে একটা তোলপাড়শুরু হয়–সব গুলিয়ে যায়–নিজস্ব সত্ত্বা তার হারিয়ে যায়। আজব আজব হাজার স্মৃতি মনে আসে তার! আবার সে সব স্মৃতি চলেও যায়—সবই যেন ক্ষণস্থায়ী।স্মৃতির মাঝে আবার সে বর্তমানে ফিরে আসে–চলমান জীবনে, আশপাশ নিয়ে কিছু সময় থাকার পর আবার মন ডুব দেয় অতলে।
মনকে বোঝা ভার, ভগবান ওকে সৃষ্টি করেছেন বড় অসময়ে, হয়তো ঘুমোতে ঘুমোতে! না হলে এধরণের মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মাবে কেন ও! মস্তিষ্কের যন্ত্রগুলি কোথাও না কোথাওঅপূর্ণ রয়ে গেছে। তাই তো মনের মনে এ বিভ্রাট !
পড়ার সময় মন থাকে অন্যমনস্ক হয়ে। মনের ঠাকুমা ওকে খুব ভালোবাসেন। ঠাকুমারা নাতিকে ভাল বাসবে এ আর নতুন কিছু কি! মন অপূর্ণ মানসিকতা নিয়েজন্মেছে বলেই ঠাকুমার ওর প্রতি বিশেষ টান রয়েছে। ওর ভবিষ্যত নিয়ে সব চেয়ে বেশী চিন্তা। বড় হয়ে কি করে চলবে, ওর মত স্বল্প বুদ্ধি নাতিকে কে সামলাবে?-এ চিন্তা সর্বদা লেগে থাকে ঠাকুমার মনে। মন বাবামায়ের চেয়ে বেশি ঠাকুমা ঘেঁষা।
মনের মধ্যে ছিল একটা বিশেষ গুন। ও কোন বছরের কোন নির্দিষ্ট দিনে কি বার ছিল বা থাকবে বলে দিতে পারত–তাও মুহূর্তের মধ্যে! এ গুণ কি ভাবে তার মধ্যে এলো বলা দুষ্কর। ছোট বেলায় এমন এমন ঘটনা ও বলত যেন মনে হত গত জন্মের কাহিনী বলছে! মনে হত ও জাতিস্মর–এ লক্ষণটাপরে আর দেখা যায় নি। বার বলে দেবার রহস্যকে নির্ভর করে অনেকে নিজের নিজের ভবিষ্যৎ জানার জন্য নানা প্রশ্ন করত ওকে। সত্যি মিথ্যা যাই হোক,
প্রত্যেক প্রশ্নের জবাব দিতে ও দেরী করত না। মনে হত সমস্ত ভবিষ্যতের জবাব ওর কাছে তৈরি রাখা আছে। অনেক সময় মিলেও যেত ওর বলা ভবিতব্যেরঅনেক ঘটনা। সে জন্যে লোকেরা ভীড় করত ওদের ঘরে এসে।
এমন পরীক্ষা স্কুলেও দিতে হয়েছে মনকে। স্কুলের ছেলে মেয়েরা তারিখ ধরে বার বলেদেবার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। না জানি কি ভাবে কোন দৈবিক রহস্যর দ্বারা মন প্রায় সময়ই এ ব্যাপারে সঠিক জবাব দিয়েছে! ছাত্ররা এবংশিক্ষকরা আশ্চর্য হয়েছে বৈ কি! ভবিষ্যৎ নিয়ে হাজার প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে মনকে–এর তৎক্ষণাৎ তৈরি জবাব সবাইকে ও দিয়েছে। এহেন অপুষ্টঅথচ আশ্চর্যান্বিত মস্তিষ্কের ছেলেকে চয়নিকা আগলে আগলে রাখত। ওর পেছনে কেউ না লাগে, অযথা ওকে খেপিয়ে না তোলে, সে দিকে নজর রাখত। ওরপ্রতি একটা অজানিত টান অনুভব করত চয়নিকা।
একবারের ঘটনা মনে আছে, স্কুলে এক জাগায় বেশ গণ্ডগোল হচ্ছে দেখে এগিয়ে গেল চয়নিকা। দেখে মন একটা ছেলেকে প্রচণ্ড মারছে, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হম্বিতম্বি শব্দ করে সমস্ত গায়েরজোর নিয়ে কিল, ঘুসি, লাথি যে ভাবে পারছে মারছে। দুচার জন ছেলেরা আটকাবার অশেষ চেষ্টা করা সত্বেওতাকে ঠেকাতে পারছে না! চয়নিকার মনে হলছেলেটাকে ও মেরেই ফেলবে বুঝি! চয়নিকা কাছে গিয়ে জোরে মনকে ডেকে উঠলো, মন মুহূর্তের মধ্যে চয়নিকার উপস্থিতি অনুভব করল।
–‘আমায় সব সময় খেপায়, আমি ওকে ছাড়ব না,’চয়নিকাকে কথা কটি বলে আবার ঐ ছেলেটিকে মারার জন্য এগিয়ে যায় মন।
মনের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে চয়নিকা বলে, ‘কি হচ্ছে,ও মরে যাবে তো! টিচাররা এসে তোমাকে খুব মারবেন কিন্তু,
মন!’
এবার মন্ত্রের মত কাজ হল। মন তার বর্তমানের সম্বিত ফিরে পেল, চয়নিকার হাত ধরে ঝাঁকুনি দেবার ফল ছিল এটা! নতুবা মন হয়তো ঐ ছেলেকে মেরেই ফেলত। এমনি ভাবে চয়নিকা মনকে কয়েকবার বাঁচিয়েছে–ওঅনেকটা মনের স্কুলের গার্জিয়ানের মত কাজ করেছে। কথাটা জানত মনের মা,বাবা। তাঁরা চয়নিকার সঙ্গে দেখা হলে বলত, ‘চয়নিকা মনকে একটু দেখো মা!না হলে ওর আর পড়া শুনা হবে না, কোন স্কুলেই ওকে আর রাখবে না।
‘
ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত তাই ঘটতে চলেছিল। মন যে ছেলেটাকে মেরে ছিল তার মা,বাবা এসে অভিযোগ জানিয়ে ছিলেন হেডটিচারের কাছে। সে অনুযায়ী স্কুলের শান্তি রক্ষার্থে ডাকা হল মনের বাবা, মাকে। মনকে আর স্কুলে রাখা যাবে না বলে জানালেনস্কুল কর্তৃপক্ষ। শেষে মনের মা,বাবার অনেক অনুনয় বিনয়ের পর,আর এ ধরণের ঘটনা ভবিষ্যতে হবে না ইত্যাদি ইত্যাদির পর লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে এবারেরমত স্কুলে থাকার অনুমতি পেল মন।
২
এদিকে আবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। রাত প্রায় একটাই হবে। অঘোরে ঘুমচ্ছিলেন অনিমেষ,কমলিকা। দরজায় শব্দ হল–ঠুক,ঠুক,ঠুক। কেউ জাগল না।দ্বিতীয় বারের শব্দ অনিমেষের কানে যেতেই আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল তাঁর,
ভয় জড়িত কণ্ঠে কমলিকার গায়ে ঠেলা দিলেন তিনি।
–‘কি হল!’ কমলিকার গলা থেকে এর বেশী শব্দ বের হল না,
আগের রাতের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তাঁর।
চাপা স্বরে অনিমেষ বললেন, আবার দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে!
–‘যেও না,যেও না’–বলে উঠলেন কমলিকা। গা-ছমছম ভাব উভয়কেই গ্রাস করতে লাগলো।
–‘চোর ডাকাত হলে ওরা খালি হাতে আসে না,’করুণ ভাবে বললেন কমলিকা।
ভয় অনিমেষকেও জড়িয়ে ধরেছে। কি করবেন ভাবতে পারলেন না তিনি। এমন সময় আবার তৃতীয়বার শব্দ হোল–ঠক,ঠক,ঠক। বেশী জোরে আওয়াজ নয়। মনে হয় ডাকাত হবে না, চোরের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে,
গৃহস্থ জেগে আছে কিনা জানার প্রয়াস। অনিমেষ একবার ভাবলেন মোবাইল দিয়ে দু-চার জনকে খবর দেবেন কি না। আবার ভাবলেন, ওতে অনেক লোক জানাজানি হয়ে যাবে, ঘরের সামনে অনেক ভিড় জমে যাবে,হই হল্লা হয়ে যাবে। তার চেয়ে আর কিছু সময় দেখা যাক–চোরদের জানান দিয়েদেওয়া যাক যে–গৃহস্থ জেগে আছে–তোমাদের সুবিধা হবে না–মানে মানে কেটে পরো। এই ভেবে অনিমেষ বলে উঠলেন,‘কে?কে দরজায়??’ সঙ্গে সঙ্গেমনে হল কেউ দ্রুত পদে সরে গেল–পায়ের স্পষ্ট আওয়াজ পাওয়া গেল। যাক, বিপদ মুক্ত হওয়া গেল, ভেবে সাহস ভরে দরজা খুললেন অনিমেষ। কমলিকাভয়ে অনিমেষের হাত জড়িয়ে থাকলেন। ঐ দিনের মত বাইরে আর কোনও সাড়া শব্দ হল না। বাগানের বাইরে রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে রহস্য ভেদ করার ইচ্ছে বাসাহস অনিমেষ খুঁজে পেলেন না। বিছানায় গিয়ে ওঁরা নিদ্রা দেবীর কোলে ঢলে পড়লেন।
আবার এলো এক মিষ্টি ভোর। চয়নিকা দেখল,পাখীদের কলরবে জেগে উঠেছে লোকালয়। সেই শেফালী ফুলের
গন্ধে ম ম করছে চারি দিক। সাদা চাদরে চন্দনের বিন্দু বসিয়ে ফুলেরা গাছ তলা বিছিয়ে শুয়ে আছে! ধীরে ধীরে দিনের আলো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে।এমন সময় কার না ভালো লাগে! চয়নিকা তাকিয়ে আছে এ সব দৃশ্যের দিকে। ওর মনে হল যে সরল অবুঝ প্রকৃতিও যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে!
সামনের ঘর, বাড়ী, পথ, ঘাট, মাঠ আলোক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে! এখান থেকে কত দূরই বা হবে সেই আধ পাগল ছেলেটার ঘর? মনে মনে আঙ্গুলে গুনে নিলো ও, ঠিকআটটা ঘরের পর।
চয়নিকা একদিন মনকে জিজ্ঞেস করে ছিল,‘মন, কি এত ভাবিস তুই?’
প্রথমবার ‘উঁ’ করে ধ্যান ভাঙল মনের।
চয়নিকা ঐ একই প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি করল।
এবার মন বর্তমানে প্রবেশ করল। কি চিন্তা করে বলল, ‘জান, ঐ যে দূরের মাঠ, তার মাঝ খান দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে–সেটা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েও গেছে। সারা দেশ জুড়ে এই একই রাস্তা চলে যাচ্ছে, তাই না?’
–‘আর কি কি তোর মনে পড়ছে?’ চয়নিকা কৌতূহলী প্রশ্ন করে। ও ধীর স্থির মেয়ে—প্রকৃতিকে ভালোবাসা মেয়ে। মনের এ ধরণের কথা ওর খুব ভালো লাগে।
মন আপন মনে বলে চলে–‘পথের মত নদীও বয়ে যায়, মনে হয় আমাদের বাড়িও যদি কোনও নদীর ঘাটে হত! তা হলে কি ভালই না হত!’ এটুকু বলে চুপ করে গেল মন। অন্য কোনও ভাবনার পথ অন্যকোনও ক্ষণে ওকে নিয়ে চলে গেছে হবে!
–‘আর কি বল’–মনকে ঈষৎ ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে চয়নিকা,
চুপ করে গেলি কেন?’
–‘আর’–মনে করার জন্য থামল মন, কিছু চিন্তা করে বলল,
‘আমি ফুল খুব ভালোবাসি,
আমি জানি তোমাদের বাগানে অনেক ফুল ফুটেছে!’
–‘কোন ফুল,
কোন পাখী তোর ভালো লাগে?’ প্রশ্ন করে যায় চয়নিকা।
–‘আমার..আমার..অনেক ফুল ভাল লাগে, অনেক পাখী ভাল লাগে। ছোট-বড়–টিয়া, ময়না, বুলবুলি,
একদম ছোট্ট পাখী—দেখেছ তুমি? কেমন ছোট গোল গোল বাসা বানায়!’ মন এবার চয়নিকাকেউল্টো প্রশ্ন করে বসে।
–‘হ্যাঁ, ওটাকে টুনটুনি বলে–দেখতে খুব সুন্দর ‘টুঁই টুঁই’করে কথা বলে। সুন্দর বাসা বানায় ওরা। পাতা সেলাই করে করে বাসা বানায়,’ বলতে বলতে চয়নিকাথেমে দেখে মন আবার নতুন কিছু ভাবতে লেগেছে আর আপন মনে বিড়বিড় করে কিছু বলতে লেগেছে। ও আর ঘাঁটাল না ওকে, নিজের মনোরাজ্যে বিচরণকরতে ছেড়ে দিল।
মনের বাড়ী ওর মা, বাবা এক বোন আর ঠাকুমা আছেন। চয়নিকা গিয়েছে ওদের বাড়ি। ওদের পাড়ার শেষ দিকে বাড়ী। দেখেই মনের মা হেসে এগিয়ে এসেছিলেন। দেখে মনেহয়ে ছিল তিনি খুব খুশি হয়েছেন,
বললেন,‘এস চয়নিকা, একদম আস না তুমি—এক পাড়ায় আমরা থাকি, মাঝেমাঝে আসতে পারো!’ তারপর তাঁর শাশুড়িমাকে ডেকে বললেন, ‘এই যে মা! চয়নিকা এসেছে–ঐ যে আপনাকে বলেছিলাম না! মনের স্কুলে.. ওরা এক ক্লাসে পড়ে। মনকে স্কুলে ওই দেখে শুনে রাখে।’
মনের ঠাকুমা, বয়েস আশির কাছাকাছি হবে। একেবারে রোগা পাতলা চেহারা, হেসে বললেন, ‘এস, এস, ভেতরে এস।’
তারপর মনকে ডেকে বললেন, ‘মন, দেখ কেএসেছে!’ মনের সাড়া পাওয়া যায় না, ও বোধ হয় শুনতে পায়নি কথাটা, অন্য স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে ওর। আবার ঠাকুমা ডেকে বললেন, ‘কিরে, তোর
বন্ধু এসেছে–স্কুলের…’
–‘চয়নিকা এসেছে,’আপন মনে বলতে বলতে বেরিয়ে এলো মন। মাথা নিচু করে হাসি মুখে এদিক ওদিক চাইল। তারপর এক ধারে চুপ করে দাঁড়িয়েথাকলো। মনের মা ঘরের ভিতর বসতে দিলেন চয়নিকাকে। সোফায় বসে তার অস্বস্তি হতে লাগলো–কি বলবে, কি করবে, কি কারণে সে এসেছে এখানে–এসব ভাবতে লাগলো চয়নিকা।
–‘তুমি স্কুলে আছ তাই বাঁচোয়া, না হলে ওর আর পড়া শুনা হত না, টেনে টুনে টেন পাশ করতে পারলে বাঁচি’–মনের মা বলতে থাকলো, জানো চয়নিকা! সব সময় আমাদের ওকে নিয়ে ভয়লেগেই থাকে–এই বুঝি ছেলেরা ওকে কিছু করল বা ও নিজেই কিছু গণ্ডগোল বাঁধাল, আর দুটো বছর গেলে বাঁচি!’
ঠাকুমা বললেন, ‘স্কুলে তুমি ওকে একটু দেখো, দিদুন! ওর অবস্থা তুমি তো জানই, ভয় লাগে কখন কোন ঘটনা ঘটিয়ে বসবে! জানো তো রেগে গেলে ওকে সামলানোমুস্কিল?’
জল আর প্লেটে করে মিষ্টি নিয়ে এলেন মনের মা, চয়নিকার সামনে টেবিলে রেখে বললেন, ‘এই তো দেখো,
ছেলেটা সাইকেলে যায়, মাথাটা তো ওই রকম, কখন কোথা থেকে কি ঘটে যাবে, সব সময় আতঙ্কেথাকি!’
মন এতক্ষণে কথা বলে, ‘আমার মাথা খারাপ কে বলল!’
-‘না, না, না, মাথা খারাপ না, ছোট ছেলেরা ভীড়রাস্তায় সাইকেল নিয়ে গেলে ভয় হয় কখন এক্সিডেন্ট-টেক্সিডেন্ট হয়ে বসবে!’ মনের মা ছেলেকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন।
–‘ছোট ছেলে,’
কথাটা রিপিট করল মন–এমনি করে নিজের মনেই প্রশ্ন করে, আসলে পাগলরা নিজের মধ্যে পাগলামোর লক্ষণ দেখতে পায় না–আর মন তো পুরোপুরি পাগলনয়—ও তো সব বোঝে, সব শোনে, সব করে। শুধু বেশী ধীর –বয়সের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে আছে!
মন বলে উঠলো, ‘আমি গোবিন্দাকে ভালোবাসি, ও ভালো হিরো! ভালো পার্ট করে। মনের কাছে গোবিন্দা হল বেস্ট হিরো–ঘরে টিভিতে গোবিন্দার সিনেমা দেখতে ও ভালোবাসে।
ঠাকুমা চয়নিকাকে দেখিয়ে বলেন, ‘মন,তুই ওকে চিনিস?’
চয়নিকার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে মন বলে ওঠে, ‘ও আমাদের স্কুলে পড়ে, আমি জানি, ও চয়নিকা,
আমার ভালো দোস্ত।’
মনের বাবার সঙ্গে দেখা হল চয়নিকার। কথা বলতে বলতে মনের রোগটার সম্বন্ধে চয়নিকাকে বোঝাচ্ছিলেন তিনি। মনের সহানুভূতি কাড়তেই হয়তো তারবাবা চয়নিকার সামনে মনের অসুখের বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছিলেন। তাঁরা মনের জন্য অনেক চিকিত্সা করেছেন। মোটের উপর, ফল কিছুই পাওয়া যায় নি। মনের বাবা ডাক্তারি বিজ্ঞানে রোগটার নাম দাঁত ভাঙ্গা উচ্চারণে এই ধরনের বলে ছিলেন” ইনহেরিটেড নিউরো ডিজেনেরেটিভ কন্ডিশন”–সঠিক ভাবে
নির্ণয় করা যায় নি, রোগের সঠিক চিকিৎসাও নাকি এখনও বের হয়নি!ঘরে ফেরার সময়, ‘আবার আসব,’
আশ্বাস দিয়ে চয়নিকা ঘরে ফেরে। আসার সময় মনের মুখ থেকে নামতা পাঠের মত বলতে শোনে–‘বাই,
আবার আসবে, স্কুলে দেখা হবে।’
দেখতে দেখতে দু বছর কেটে গেল। মন আর চয়নিকা ক্লাস টেনে পড়ছে। এমনি সময় স্কুলে মনকে নিয়ে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটে গেল। ও ক্লাসের বাইরেকোনও কাজে গিয়ে ছিল। সব দিনকার মত ছেলেরা ওর পিছে লেগে ছিল,
খেপাচ্ছিল,তামাশা করছিল ওর সঙ্গে। ছেলেদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠে, ‘মন বিয়ে করবি? তোর তো অনেক বয়স হয়ে গেছে রে!’
–‘না,না,আমি বিয়ে করব না,’ বিয়ের নামে ও কেন যেন খেপে যায়, সম্ভবত শব্দটার সঙ্গে কোনও লজ্জার সম্বন্ধ জড়িয়ে আছে বলে হতে পারে। কারণ যাই হোক না কেন, বিয়ে করব, কথাটাকেউ নিজের মুখে বলতে চায় না। যে কারণে বিয়ের নামটা মনের কাছেও মনপুত: ছিল না।
ছেলেগুলো মনকে খেপিয়ে চলেছিল, ‘তোর তো বিয়ের বয়স হয়েছে, দাড়ি গোঁফ উঠতে শুরু করেছে,
তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নে!’
টিফিনের সময় ছিল, আস্তে আস্তে অনেক ছেলে তাকে ঘিরে ধরেছে। চয়নিকার এত জনের মাঝখান থেকে ওকে নিয়ে আসতে যেতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। এমন সময় ঘটনাটা ঘটল। মনরেগে গিয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে হাতে তুলে নিলো পাথর,
তাক করে মুহূর্তের মধ্যে মহিমের দিকে ছুঁড়ে মারল। লক্ষ্য ছিল মোক্ষম। মহিমের মাথা ফেটেদর দর করে রক্ত পড়তে লাগলো। চারি দিকে হই হল্লা ছোটাছুটি, একদল ছুটে গেল হেড মাস্টামশায়ের কাছে। টিচাররা ছুটে আসলেন। প্রাথমিক চিকিৎসায়কাজ হল না, অগত্যা টিচাররা মহিমকে নিয়ে গেলেন ডাক্তারের কাছে।
এ ঘটনা মনের জীবনকে পাল্টে দিল। ওর স্কুল জীবনের এখানেই ইতি হল। তার মা, বাবা অনেক চেষ্টা করেও মনকে কোনও স্কুলে ভর্তি করতে পারেন নি।প্রতিবন্ধী ছেলে মেয়েরা সাধারণ স্কুলে পড়তে পায় না। চয়নিকার মনে ঘটনাটা দাগ কেটে ছিল। ওর মনে হয়ে ছিল একটা সাধারণমনোরোগীকে পাগল বানাবার মূলে থাকে অনেক ফেক্টারস! ওই দিন স্কুলের ছাত্ররা যদি মনকে পাগল না বানাত, তবে হয়তোমাধ্যমিক পাস করে এ স্কুল থেকে বেরোতে পারত মন!
জীবনের এত বড় ক্ষতির গুরুত্ব মনের কাছে কোথায়! স্কুলে না যেতে পারার প্রশ্ন বাবাকে দু একবার সে করেছে। তার বদলে বকাই খেয়েছে। এখন স্বপ্ন মাখাচোখে তাকিয়ে থাকে মন–কোন্ সুদূর রাজ্যে কে জানে! এঁকে বেঁকে যাওয়া কত শত পথ চলেছে অজানার দেশে! নদী গিয়ে পড়েছে নীল সাগরে। কখনো ওদেখে ছোট্ট ছেলে সেজে ও চলেছে কোন আচিন দেশে। অন্য জন্মের গল্প গাঁথার মত মস্তিষ্কের অনুরণন চলতে থাকে তার মধ্যে–রাতের আকাশে নিজেকেহারিয়ে যেতে দেখে। মন ফালি চাঁদের নৌকোয় কোনও রাজকুমারীর দেশে ঘুরে বেড়াতে থাকে।
মনকে কেউ বিরক্ত করলে, ওর খুব রাগ হয়ে যায়। তাকে খুব মারতে ইচ্ছে করে ওর। এমনি ইচ্ছাতেই সে মাথা ফাটিয়ে দিয়ে ছিল মহিমের।
ঠাকুমার প্রশ্নে ওর সম্বিত ফিরে আসে, ‘মন,কি ভাবছিস তুই? তোকে খেতে দিয়েছে, খাবি না?’ ঠাকুমা জবাব পান,
‘হ্যাঁ,খিদে পেয়েছে, খাবো।’ কখনো টি.ভি.দেখতে থাকলে মন বলে ওঠে,গোবিন্দাকে আমি দেখছি,
আমি গোবিন্দকে ভালোবাসি। আবার পরক্ষণই বলে, ‘আমি আর স্কুলে যেতে পারব না ঠাকুমা!’
ঠাকুমা বলেন,‘স্কুলের কথা মনে পড়ে তোর?’
মাথা নাড়ায় মন, ‘পড়ে, স্কুলের দোস্তদের কথা মনে পড়ে খুব!’
–‘কারা ছিল দোস্ত–নাম বলত?’
ঠাকুমা প্রশ্ন করেন।
–অনেক দোস্ত ছিল, চয়নিকা, বাকী নাম মনে করতে করতে থেমে গেল মন। আবার অন্য মনস্ক হয়ে যায়—হয়ত চয়নিকার কথাই ভবতে থাকে!
ঠাকুমা ঠাট্টা করে বললেন, ‘কাকে ভালবাসিস তুই–গোবিন্দকে না চয়নিকাকে ?’
–জবাব আসে,
‘দু জনকে, আমি চয়নিকাকে ভালোবাসি’–এমনি করে আধ পাগলা ছেলেটার চিন্তা ধারা নেমে যায় প্রকৃতি রাজ্যে,
ডুব মারে কোনও রাজ হাঁসের সঙ্গেনীল জলের সরোবরে।
৩
এ দিকে অনিমেষ মন থেকে দু রাতের দরজা ধাক্কার ব্যাপারটা মুছে ফেলতে পারছেন না। ওঁর বদ্ধ ধারণা ওই রকবাজ ছোঁড়ারাই রাতে এসে এ কাণ্ড করছে–ভয়দেখাবার জন্য কিম্বা ওদের বিরুদ্ধে কথা বলার মজা চাখাবার জন্য। পথে হাঁটতে হাঁটতে রকবাজ দলের একটা ছেলে তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বলে তাঁরমনে হল। তিনি ছোঁড়াটাকে ডাকলেন,
‘এই শুনছ!’
থমকাল ছেলেটা। ইতস্তত করে দাঁড়ালো সে।
অনিমেষ ছেলেটার মুখোমুখি হয়ে বললেন,
‘তুমি ওই দলের –না! এক সঙ্গে রকে বসে হই হল্লা করো?’–‘না,না, হই হল্লা করি না,ওদের সঙ্গে থাকি আমি…’বলল ছেলেটা।
–‘আমাদের ঘরে তোমাদের কেউ এসে দরজা ধাক্কা দেয় না তো?’ ছেলেটার কথা শেষ হবার আগেই অনিমেষ বলে ওঠেন।
–‘না না, আমরা ওরকম কাজ করি না,’ছেলেটা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে।
–‘না,
তোমরা খুব সাধু! সাবধান করে দিচ্ছি তোমাদের, পুলিশে খবর দিচ্ছি,’ রেগে মেগে কথাগুলো
বলে আর দাঁড়ান নি অনিমেষ। ছেলেটা কিছু বলার আগেই হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিয়েছেন।
আবার আর এক রাত এলো, ঠিক তেমনি, জাগতিক নিয়মে রাত প্রায় বারটা বাজলো। একই নিয়মে দরজা ধাক্কার শব্দ শোনা গেল–আস্তে দরজায় ধাক্কার শব্দ হল, তারপর দু-তিন বার খটখট শব্দ! এমনিভাবেই
আগের দু দিনের শব্দ গুলি হয়ে ছিল অর্থাৎ চোর, ডাকাত, –যেই হোক—দরজায় খট খট করে শব্দ করার কাজটা একই লোকের মনেহল অনিমেষের। হতে পারে দলের বাকী লোকেরা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের লোক জাগ্রত না নিদ্রিত আঁচ করার জন্য একজন হয়ত দরজা অবধি এসেছে!যতটা অনুমান হচ্ছে দল ভারী নয়, এক বা দু জনের বেশী লোক হবে না। গত দু দিনের পায়ের আওয়াজ যে ধরণের শোনা গেছে তাতে কোনও এক জন হবারসম্ভাবনা বেশী। জেগেই ভাবছিলেন অনিমেষ, এসপার কি ওসপার দেখে নেবেন তিনি কে বা কারা এমনি উৎপাত করে চলেছে। একজন হলে তিনি কোনওমতেই ছাড়বেন না তাকে।
দরজার পাশে লাঠি রাখা ছিল। কমলিকাও আজ জেগে গেছে। কদিন ধরে রাতে ভালো ঘুমাতে পারছেন না। দু তিন মিনিটের ব্যবধানে আবার ঠুক, ঠুক, ঠুক তিন বার টোকা পড়ল দরজায়। ভয় ও উত্তেজনায় অনিমেষ এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। লাইট জ্বাললেন না, চার দিক ঘুটঘুট অন্ধকার। নিঝুমরাতের মাঝে সামান্য টুকটাক শব্দও কানে আঘাত করার মত বেজে উঠে। উত্তেজনায় ভয়ে কমলিকা অনিমেষের এক হাত চেপে ধরে আছেন। ভয়ে ফ্যাসফ্যাসকাঁপা গলায় বলে উঠলেন, ভূত-তুত নয় তো!’ অনিমেষ ওসব মানেন না, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস,
ওই রকের ছেলেদেরই কাজ হবে এটা। আজ সহজে ছাড়বেন নাতিনি! তাড়াতাড়ি পাশের ঘরটায়, যেখানে চয়নিকা শোয় সেখানে চলে গেলেন। কমলিকা তখনও অনিমেষের হাত ধরে আছেন। আস্তে করে বাগানের দিকেরজালনাটা খুললেন অনিমেষ, বাইরে আলো আঁধারে দেখতে পেলেন একটা ছেলে ওদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে! একটু লম্বাটে কালো চেহারার, অল্প বয়সের ছেলে মনে হল–রকবাজ ছেলেদের মধ্যে কেউ হবে নিশ্চয়! চেহারার,
আদলে সকালের দেখা হওয়া রকের ছেলেটার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে—মনে হলঅনিমেষের। সঙ্গে আর কেউ নেই–আর একটি প্রাণীকেও দেখা যাচ্ছে না।
অনিমেষ কমলিকার হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন, সাহসে ভর করে এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে, চট করে লাঠিটা হাতে নিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেললেন। দরজার একটা পাল্লা ঝটকা মেরে খুলেইদেখলেন, ছেলেটা পালাবার জন্য পা বাড়িয়েছে। আর যাবে কোথায়, দু পা দৌড়ে গিয়ে অনিমেষ মোক্ষম এক বাড়ি মারলেন ছেলেটির ঘাড়ে। জোর চীৎকারেরসঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়ল ছেলেটা, বাগে পেয়ে অনিমেষ একের পর এক লাঠির বাড়ি মারতে লাগলেন। হই হল্লা চীৎকারে চারি দিকের লোক জড় হয়ে গেল।কমলিকা ছুটে এলেন। চোর নামক ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে যন্ত্রণায় চীৎকার করে চলেছে। চীৎকার চেঁচামেচিতে ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসেচয়নিকা। মা-বাবার দিকে এগিয়ে যায়–দেখে একটা ছেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে।
ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। হঠাৎ চয়নিকার চোর ছেলেটার দিকে চোখ পড়ল–এ কি দেখছে সে! ও আকুলিবিকুলি করে উঠলো, এক ঝটকায় বাবা, মা সবাইকে সরিয়ে চোর ছেলেটার কাছে পৌঁছল। আর পর মুহূর্তে সে চীৎকার করে ছেলেটার কাছে বসে পড়ল,‘এ যে মন, মন, মন,’বলেচয়নিকা বুকের কাছে তুলে নিলো মনের মাথাটা।
সকালের সূর্যের হীরক আলোয় ঝলমল করে উঠলো সমস্ত বাগানটা।