আমাদের গ্রামটা তখন বেশ ফাঁকা ছিল । পুরো গ্রামে বিশটা বাড়ি ছিল কিনা সন্দেহ। যেহেতুবাড়ি কম, অতএব মানুষও কম। কোন কোলাহল নেই, নিরব নিস্তব্ধ চারদিক। দিনে দুপুরে হাঁটাচলা করতেইকেমন যেন ভয় ভয় করত। বিশেষ করে আমাদের গ্রামে বড় বড় কয়েকটা গাছ ছিল- গাব গাছ আর বট গাছ। আমরা এসব গাছের ধারে-কাছে যেতাম না। কারণ মা বাবা সব সময় আমাদের সতর্ক করে দিতেন, এই সবগাছে নাকি ভুত থাকে। সুযোগ পেলেই ঘাড় মটকাবে।
মা বাবার কথা যে সত্য, সেটা বোঝা যেত গাছগুলোর ডাল পালার দিকে তাকালেই। কী বড় বড় ডাল! এক একটা ডালে রাজ্যের ঝোপ। প্রতি ডালে যদি দশটা করে ভূত বসে থাকে, গল্পগুজব করে তবু কেউ টের পাবে না।
আমাদের পাশের বাড়িতে একটা ছেলে বেড়াতে আসত প্রায়ই। ছেলেটার নাম ছিল করিম। বয়সে আমার চেয়ে দুতিন বছরের বড় ছিল। তবে সে আমার সাথে এমন ভাবে মিশত, আমার মনেই হতোনা আমি তার ছোট। আমরা নানা রকম পরিকল্পনা করতাম একসঙ্গে।কোথায় মাছ ধরতে যাবো, কখন পাখির বাসা খুঁজতে যাবো, কার গাছের ফল পেড়ে খাবো- সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যেত করিম আসার সঙ্গে সঙ্গেই। তবে এসব পরিকল্পনা আমরাযেখানে সেখানে বসে করতাম না। কারণ মা বাবা শুনে ফেললে পিঠে যে শুধু লাঠি ভাঙবেন তা-ইনা, দুএক বেলা খাবারও বন্ধ রাখতে পারেন। এজন্য আমরা চুপচাপ চলে যেতাম বাড়ির বাইরে। মন খুলে বুদ্ধি পরামর্শ করে দুজন দুদিক দিয়ে ঢুকতাম বাড়িতে। কেউ যদি কিছু টের পেয়ে যায়, সেই ভয়ে।
একবার এক ছুটিতে বেড়াতে এলো করিম। এসেই দৌড়ে চলে এলো আমাদের বাড়িতে।আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম। করিমের ধাক্কায়ঘুম ভেঙে গেলো। সে কিছু না বলে ইশারা দিলো বাইরে যাওয়ার জন্য। আমি কোন কথা বাড়ালাম না। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম গোয়াল ঘরের পেছনের চিকন পথটায়। তারপর দুজনে কুশল বিনিময় করতে করতে চলে গেলাম বিলপাড়। এরই মধ্যে করিম জানাল এবার সে পুরো এক সপ্তাহ থাকবে। পরীক্ষাশেষ, তাই স্কুল বন্ধ। শুনে আমি লাফিয়ে উঠলাম আনন্দে। এক সপ্তাহ দুজন এক সাথে থাকার সৌভাগ্য এর আগে কখনও হয়নি। করিম বলল, “সারা সপ্তাহের পরিকল্পনাটা এখনই করে ফেলতে চাই।”
কিন্তু বসবো কোথায়? বিলপাড়ে অনেক মানুষ। সবাই বিল পাহারা দিচ্ছে।প্রায় শুকিয়ে যাওয়া বিল থেকে পাশের পাড়ার ছেলেরা মাছ চুরি করতে আসে তো, তাই। কোন নির্জন জায়গা নেই। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম একমাত্র বটতলাটাই ফাঁকাআছে। কিন্তু বটতলায় গিয়ে বসার মতো সাহস আমার নেই কে জানে কখন ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে ভূত। করিম খুব করে বোঝাল। বলল, “এতো ভয় পেলে জীবন চলে না। এছাড়া কেউ তো আমাদের বেঁধে রাখবে না। ভুতের আনাগোনা পেলে ঝেড়ে দৌড় দেব। দৌড় আমরা কম জানি না। বরাবরই ফার্স্টহই। সবচেয়ে বড় কথা হল আর কোথাও নির্জন জায়গা নেই।” অতএব আমরাগিয়ে বসলাম বটতলায়। ভয়ে আমার বুক কাঁপতে শুরু করলেও করিমকে সেটা বুঝতে দিলাম না লজ্জায়।
করিম নানা রকম পরিকল্পনা করতেশুরু করল। আমি তেমন কোন কথা না বলে শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করে যেতে লাগলাম। আর বারবার তাকাতে লাগলাম বটগাছেরডালের ঝোঁপগুলোর দিকে। করিমের অনেকগুলো পরিকল্পনার মধ্যে একটা পরিকল্পনা ছিল- পরের দিন খুব ভোরে আমরা বিলে মাছ ধরতে নামব। চুরি করব না, আমাদের জমি থেকেই ধরব। নিজ হাতে বড় মাছ ধরার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। এছাড়া সকাল বেলা সবাইকে মাছ দিয়ে চমকে দেওয়ার ব্যাপারটা তো আছেই। আমি একমত প্রকাশ করলাম করিমের সাথে। সিদ্ধান্ত হলো- ফজরের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে এসে আমাকে ডাক দেবে। আমি তখন বেরিয়ে যাবো আস্তে করে। কথাবার্তা শেষ করে আমরা উঠে দাঁড়ালাম বসা থেকে। বাড়ির দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে আরো বেশ ক’বার তাকালাম ডালের দিকে। করিমকে জিজ্ঞাসা করলাম,“আচ্ছা, আমাদের সব পরামর্শ ভুত শুনে ফেলেনি তো?” করিম হেসে বলল, “তুই কীযে বলিস না! ভূতের খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই,আমাদের কথা শুনতে আসবে। শোন, মাথা থেকে এসব আজগুবি চিন্তা দূর কর।”
বাড়ি আসলাম। রাতে একটু পড়াশোনা করে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু কোনভাবেই ঘুম আসছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল- কখনআজান দেবে, আর কখন বিলে যাব। এপাশ ওপাশ করছিলাম। শোয়া থেকে উঠে-বসেও ছিলাম তিন চার বার। তারপর হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়ি, টের পাইনি। ঠকঠক করে আওয়াজ হলো দরজায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল আমার। ঘাড় উঁচু করে তাকালাম পাশের খাটে। যদিও অন্ধকারের জন্যদেখা যাচ্ছে না, তবু নাক ডাকানো শুনে বুঝতে পারলাম ভাইয়া গভীর ঘুমে। অতএব নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। বাইরে এসেই দেখি করিম দাঁড়িয়ে আছে মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এতো অন্ধকার কেন ঠিক বুঝলাম না। আযানের সময় তো প্রায়ই উঠি। অন্যদিন তো এতো অন্ধকার থাকে না। মনে হয় আজ আকাশে অনেক মেঘ। আমি কয়েকবার বাবার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলাম করিমের পিছুপিছু। দেড় মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বিলপাড়