ওলাবিবির রাতে
ঘটনাটা ২০০৪ সালের। সবে মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। মন থেকে ভয় আর কুসংস্কার দূর হবার উপযুক্ত সময়। এমন সময় মনকে গ্রাস করে এক নতুন ধরনের ভয়।
আমাদের গ্রামটি ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় গ্রাম — পূর্ব থেকে পশ্চিমে বেশ লম্বা। হঠাৎ করেই গ্রামের পূর্ব দিকে কলেরার প্রকোপ শুরু হলো। বিগত পঁচিশ বছরে গ্রামে কলেরা দেখা যায়নি। সাত দিনের মধ্যেই পূর্বপাড়ার পাঁচজন মারা গেল। নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও পূর্ব দিকের প্রতিটি বাড়িতে কেউ না কেউ আক্রান্ত হতে লাগল। রোগটি ধীরে ধীরে পশ্চিম পাড়ার দিকেও এগিয়ে এলো — আমাদের বাড়িও পশ্চিম পাড়াতেই।
তখন পশ্চিম পাড়ার মাতব্বরেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, কবিরাজ এনে “রাশ দেওয়ার” ব্যবস্থা করতে হবে।
যথারীতি কবিরাজ আনা হলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেষে গ্রামের এক পুরোনো কবিরাজ, যিনি অনেক বছর আগে ফরিদপুর চলে গিয়েছিলেন, তাঁকে খবর পাঠানো হলো। তিনি এসে প্রথমেই ঘোষণা করলেন — “আজ থেকে রাত এগারোটার পর কেউ ঘরের বাইরে বের হবে না।”
রাত দশটার দিকেই পাড়ার প্রতিটি মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হতো যে সবাই যেন ঘরে চলে যায়। আসলে ঘোষণার প্রয়োজনই ছিল না; সবাই এতটাই ভীত ছিল যে সন্ধ্যা নামলেই বাড়ির কাজ সেরে ঘরে ঢুকে পড়ত। চারদিকে নেমে আসত এক অদ্ভুত নীরবতা। গ্রামের দোকানপাট বন্ধ, এশার নামাজেও লোকজমা অল্প। বাবা-মা আমাদেরও বাইরে যেতে দিতেন না।
তবুও আমরা মাঝে মাঝে লুকিয়ে বের হতাম। দেখতাম, কবিরাজ তাঁর সাঙ্গপাঙ্গসহ মশাল জ্বালিয়ে ধূপের ধোঁয়া উড়িয়ে পাড়ার এ মাথা–ও মাথা ছুটে বেড়াচ্ছেন, এক অপার্থিব সুরে অদ্ভুত সব মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। পরিবেশটা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এখনো ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।
কবিরাজ এক এক দিন এক এক মহল্লা “বন্ধ” করতেন, যেন ঐ পাড়ায় কলেরা বা ওলাবিবি না ঢুকতে পারে। এভাবে প্রায় সব মহল্লাই বন্ধ করা হলো।
এরই মাঝে এক রাতে আমার মা শুনতে পেলেন, কে যেন আমাদের বাড়ির গেটের ওপাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে “উঃউঃউঃউঃ…” করে কাঁদছে। মা ভেবেছিলেন, কোনো মহিলা হয়তো সমস্যায় পড়ে কাঁদছে। আসলে মা তখন পরোপকারের নেশায় “রাশের” কথা ভুলেই গিয়েছিলেন।
মা ঘর থেকে বেরিয়ে যত গেটের দিকে যাচ্ছিলেন, ততই একটা পচা গন্ধ পাচ্ছিলেন — অনেকটা মলের মতো, কিছুটা মাংস পচা গন্ধের মতো। গেটের পাশে এসে মা ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, রাস্তার ওপাশে ইলেকট্রিক খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশালাকৃতি মহিলা, প্রায় সাত ফুট লম্বা! মহিলার শরীর থেকেই গন্ধটা আসছে।
ভয়ংকর চেহারার মহিলাকে দেখে মা কিছুটা পিছিয়ে যান। সেই মহিলা ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন —
“তোরা আমাকে থাকতে দিলি না… এই গ্রামটা আমার ভালো লাগছিল… আমার আরও লাশ দরকার ছিল… উঃউঃউঃ… আমি আজই এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবো… উঃউঃউঃ…”
এই কথাগুলো শুনে মায়ের রাশের কথা মনে পড়ে যায়। প্রচণ্ড ভয়ে তিনি দ্রুত ঘরে ফিরে আসেন।
ঘটনাটা এখানেই শেষ নয়।
মা একটি গ্রামীণ সমিতির প্রধান ছিলেন। পরদিন সকালে কিস্তি দিতে এসে এক প্রতিবেশী — যিনি নৌকায় কাজ করেন — বললেন, “কাল রাতে একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে।”
মা জানতে চাইলেন, “কি ঘটনা?”
তখন তিনি বলেন, “কাল রাতে খেপ থেকে ফেরার সময় দুই গ্রাম আগেই নৌকার তেল ফুরিয়ে যায়। তাই ১৩ জন লেভারের মধ্যে ৯ জন পাশের গ্রামে নেমে যায়। আমি যেহেতু নৌকার মালিক, তাই আমি আর তিনজন লগি মেরে মেরে নৌকাটা বাড়ির দিকে আনছিলাম। এমন সময় দেখি, গ্রামের শেষ মাথায় নদীর পাড়ে একটা মহিলা বসে আমাদের ডাকছে। ভাবলাম, কোনো মহিলা হয়তো বিপদে পড়েছে, সাহায্য দরকার। তাই নৌকা পাড়ে ভিড়ালাম।”
“তারপরই নাকে এলো এক তীব্র পচা গন্ধ — ঠিক মরা জীবজন্তুর মতো। ভাবলাম, নদীতে কিছু ভেসে এসেছে বোধহয়। তাই গন্ধটা পাত্তা দিলাম না। মহিলা বলল, ‘আমাকে নদীর ওপারে দিয়ে দে।’ আমরা রাজি হয়ে তাকে নৌকায় তুললাম। কিন্তু নৌকা মাঝনদীতে যেতেই গন্ধটা অসহ্য হয়ে উঠল। বুঝলাম, গন্ধটা মহিলার শরীর থেকেই আসছে। আমরা যখন ওর দিকে তাকাতে যাব, তখন সে বলে উঠল, ‘আমার দিকে তাকাবি না, তাকালে ক্ষতি করে দেব!’ ভয়ে আমরা মাথা নিচু করে রইলাম।”
“ওপারে নামিয়ে দেওয়ার পর মহিলা বলল, ‘তোরা আমার উপকার করেছিস, তাই তোদের ক্ষতি করলাম না।’ এই বলেই সে হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।”
এরপর থেকে গ্রামের কেউ আর কলেরায় আক্রান্ত হয়নি।
মূল ঘটনা এখানেই শেষ। তবে এ ঘটনার চার দিন পর, শনিবার, সেই কবিরাজ মারা যান।
আশা করি ঘটনাটি আপনাদের ভালো লেগেছে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।