দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় আসতে কোন অবস্থাতেই দেড়–দুই ঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। তবুও, বয়স্ক মানুষের মতো ধীরে ধীরে বাস চলতে চলতে ঢাকায় এসে পৌছল ঘড়িতে রাত আড়াইটা বাজে।
জগলু কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিল দাউদকান্দিতে, তার এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে। যাবে না, যাবে না করেও শেষ পর্যন্ত না যেতে পারল না। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, “অনুরোধে ঢেকি গেলা”, কিন্তু জগলুর কাছে এখন মনে হচ্ছিল, সে অনুরোধে ঢেকি নয়, বরং কামান গিলে ফেলেছে। আর তা হজম না হয়ে হয়েছে বদহজম।
বন্ধুরা সবাই বিয়েবাড়িতে থাকলেও জগলু তারাহুরো করে চলে এসেছে, কারণ পরের দিন তার অফিস আছে। জগলু একটা তৈল কোম্পানীতে মোটা বেতনে চাকরি করে। সেখানে শুক্রবার ছাড়া অন্য কোন দিনে ছুটি নেই। বছর শেষে আছে টানা ত্রিশ দিনের দীর্ঘ ছুটি।
শাশান্তি পরিবহনের বাস যাত্রাবাড়িতে এসে বেশিরভাগ যাত্রী নেমে গেল। সায়দাবাদে নামলো আরও কয়েকজন। জগলু নামলো টিকাটুলিতে। তার বাসা নারিন্দার মুনির হোসেন লেনে।
বাসটা তাকে রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে পুলিশ বক্সের কাছে নামিয়ে দিয়ে একটানে চলে গেল গুলিস্তানের দিকে। বাসে তখনও কিছু যাত্রী বসেছিল। জগলু বিরক্তি নিয়ে ছুটে যাওয়া বাসটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। মনে মনে বলল—“হারামজাদা”।
ইদানিং জগলুর এই একটি বদ অভ্যাস হয়েছে। যখন তখন ও যাকে তাকে গালি দেয়। অনেক সময় নিজের দেওয়া গালিতে নিজেই চমকে ওঠে। তবে এতে একধরনের তৃপ্তি বা আরাম পাওয়া যায়। ব্যথার উপরে আলতো করে হাত বুলালে যে ধরনের আরাম পাওয়া যায়, তার মতো। জগলু এর নাম দিয়েছে—“পরিবেশ বান্ধব তৃপ্তি”।
পথে বারবার বাস খারাপ হওয়াতে জগলুর মেজাজ তেতে আছে। তার উপর এখন পথ ঘাট এতটাই শুনশান, মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে গজগজ করতে লাগল—এর কি মানে হয়? বিয়ে খেতে যাওয়ার কি দরকার ছিল? বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে জগলু মনে মনে ‘তিন অক্ষরের’ একটি গালি দিল। তবে আরাম পেল কিনা বোঝা গেল না।
জগলুর সঙ্গে দুটো ব্যাগ। একটা লেদারের জার্নি ব্যাগ, তাতে ওর কাপড়। অন্যটা সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বানানো বাজারের ব্যাগ। জগলু দাউদকান্দি বাজার থেকে বাসার জন্য কিছু মাছ কিনেছে। মাছওয়ালা পলিথিনের ব্যাগে বরফ দিয়ে মাছ বেঁধে দিয়েছিল। তবুও জগলুর ধারণা, মাছগুলো এখন নষ্ট হচ্ছে। বরফ গলে ব্যাগ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ছে। সঙ্গে মাছের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।
দুই
টিকাটুলি থেকে হেঁটেই বাসায় যেতে হবে। এত রাতে রিকশা পাওয়া যায় না। পথ ঘাট একেবারে শুনশান। কোথাও লোকজন নেই। আকাশে বিশাল চাঁদ মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে।
জগলু হেঁটে পুলিশ বক্স থেকে খ্রিস্টান কবরস্থানের রোডে এসে দাঁড়াল। হাতের বাম পাশে খ্রিস্টান কবরস্থান, ডান পাশে বলধা গার্ডেন। দুটোই উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। রাতের অন্ধকারে বলধা গার্ডেনের ইউক্যালিপটাস গাছগুলো অজগর সাপের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখলে গা ছমছম করে ওঠে। জগলু তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল।
কবরস্থানের দিকে তাকাতে ওর মনে হলো, ভেতরের গাছপালা রাস্তার দিকে ঝুঁকে আছে। জগলু হঠাৎ অনুভব করল, তার গায়ে ভয় লাগছে। মাথার চুলগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বাস্তববাদী মনও ভয় পাওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। চারিদিকে কবরের নিস্তব্ধতা। ঘড়ি দেখল—রাত পৌনে তিনটা।
জগলু এদিক সেদিক তাকিয়ে লোক বা রিকশা খুঁজছে। একা হেঁটে যেতে তার মন সায় দিচ্ছে না। অজানা ভয় আস্তে আস্তে ওর মধ্যে ঢুকছে। মাছের ব্যাগ পায়ের কাছে রেখে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। সুইচে টিপ দিলে মোবাইল দুবার ‘পিপ পিপ’ করে বন্ধ হয়ে গেল।
মনে মনে বলল—না, হেঁটেই যেতে হবে। কবরস্থান তো আল্লাহর হাতে। ব্যাগ দুটো তুলে হাঁটতে শুরু করল। ঠিক সেই সময় রাস্তার ওপার থেকে কেউ এগিয়ে আসছে। মনে মনে সাহস পেল।
তিন
খাঁটো কালো কোট পরা লোকটি জগলুর সামনে এসে দাঁড়াল। একবার জগলুর দিকে, তারপর ব্যাগ দুটো দেখল—“জনাব, কোন সমস্যা?”
জগলু মাথা না নেড়ে বলল—“না, কোন সমস্যা নেই।” লোকটার পা খালি। মুখ চ্যাপটা, লম্বাটে, গলাটা কোটের কলার থেকে বের হয়ে আছে। জগলু অদ্ভুতভাবে সব খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ভীতির অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।
লোকটা আবার বলল—“ভয় পাচ্ছেন? তবে থাকুন, আমি একলা একলাই যাই।” মুখ থেকে বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে। জগলু মনে মনে বলল—না, আপনাকে আবার ভয় কেন? লোকটি থুতু ফেলল, খেক খেক করে হাসল—“ঠিক বলেছেন, আমাকে আবার ভয় কিসের?”
জগলু হাঁটতে শুরু করতেই লোকটিও পাশে হাঁটতে লাগল। লোকটা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলল—“বাঘা পাপদা আর টেংরা মাছ তাই না, জনাব?” জগলু বিস্ময়ে চমকে উঠল। মাছের ব্যাগ থেকে পানি পড়ছে, গন্ধ বের হচ্ছে।
জগলুর বাবা অসুস্থ। বড় বোন টুম্বার কাছে আমেরিকায় চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। জগলু লোকটির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাঁটছে। মুখে কিছু না বললেও ভয় কাজ করছে।
লোকটি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল—“তোমার সব আমি ভুলিয়ে দিয়েছি। পারবে না কোন দোয়া বা আয়াত পড়তে।”
জগলু এখন বুঝল, সে ভয় পাচ্ছে। মনকে শান্ত করতে দোয়া করতে চাইলেও কিছু মনে আসছে না।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।