সাদ্দাদের বেহেস্ত-৩য় পর্ব
সাদ্দাদের বেহেস্ত-পূর্বের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাজা, আমির ও বনিকগন ‘মারহাবা’ বলে একবাক্যে সাদ্দাদের কথা সমার্থন করল। এতপর তারা পাঁচশ সদস্যের এক শক্তিশালী কমিঠি গঠন করে নিল। তারপর তাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে এক বিশদ ফিরিস্তি তৈরি করে নিজ নিজ কাজ সকলে বুঝে নিল। একদিন পরে রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দর মনোরম ও নাতিশীতোষ্ণ এলাকা নির্বাচন করে সেখানে বেহেস্ত তৈরির কাজ আরম্ভ করে দিল।
ওদিকে দেশ ব্যাপী স্বর্ণ, রৌপ, মণিমুক্তা সংগ্রহের কাজে জোর চেষ্টা আরম্ভ হল। বিদেশি কারিগর ও প্রকৌশলীদের আমদানি হল। নিজস্ব পদ্ধতিতে পাথর কাটা, মাটি খনন ও ভাল কাঠ, লোহা সংগ্রহ জনিত আনুসঙ্গিক যত কাজ তা অতি দ্রুত অগ্রসর হতে আরম্ভ হল। রাজা আমির-ওমারা ও বনিক ব্যবসায়ীরা সকলে ব্যক্তিগত সমস্ত কাজ ছেড়ে দিয়ে বেহেস্ত তৈরির কাজে আত্ননিয়োগ করল। সারা দেশ ব্যাপী ভীষণ তোলপাড় আরম্ভ হয়ে গেল। দেশবাসী সকলে মহা উল্লাসের সাথে এ কাজের প্রতি সমার্থন জানাল, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এসে কর্মস্থল পরিদর্শন করতে শুরু করে।
দেশবাসীর পক্ষ থেকে সাদ্দাদের নিকট বেহেস্ত তৈরির এ পুণ্য কাজে আর্থিক ও কায়িক অংশগ্রহণের আবেদন জানান হল। সাদ্দাদ জনগনের আবেদন মঞ্জুর করে তাদের দান গ্রহণের মঞ্জুরী দিলেন। ফলে একদিনেই দান তহবিলে কয়েক কোটি টাকা জমা হয়ে গেল এবং অসংখ্যা মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমের ক্ষেত্রে নাম তালিকা ভুক্ত করল। এককথায় বেহেস্ত তৈরির ক্ষেত্রে দেশবাসীর আন্তরিকতার অভাব ছিল না।
মহা ধুমধামের সাথে বেহেস্ত তৈরির কাজ আরম্ভ হল। চল্লিশ গজ মাটি খনন করে মূল্যবান পাথর দ্বারা ভিত্তি স্থাপন করা হল। নিচের ভিত খুব মজবুত করে গাঁথা হল। কয়েক হাজার মানুষ সকাল সন্ধ্যা কাজ আরম্ভ করে দিল। সেখানে পঁচিশ মাইল দীর্ঘ ও দশ মাইল প্রস্থ ছিল বেহেস্তের প্রধান ইমারতের এরিয়া। এর বাহিরে ছিল নদ-নদী, পুস্পকানন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য চতুর্গুণ বরাদ্ধকৃত এলাকা। যাতে একজন অশ্বারোহীর পক্ষে একদিনে বেহেস্তের চার পাশ ঘুরে আসা সম্ভব ছিল না।
বেহেস্তের নির্মাণ কাজ একাধারে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিরাম হীনভাবে চলতে লাগল। শেষ দিকে দিবা-রাত্র কাজ চলত। রাতে দশ হাজার লোক কাজ করত এবং দিনের বেলায় বিশ হাজার লোক কাজ করত। নদ-নদী, লেক, পার্ক, পাহাড়, ঝর্ণা থেকে আরম্ভ করে সুশোভিত বাগ-বাগিচা, নহর, ফোয়ারা কিছুই আর বাকি ছিল না। ইমারত ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইট দ্বারা তৈরি।
বহুতলা ইমারত ভিতর দিকে ছিল মণিমুক্তা দ্বারা মোজাইক করা। বিভিন্ন ইমারত বিভিন্ন কায়দায় নির্মিত ছিল। বিভিন্ন কক্ষের সৌন্দর্য ছিল বিভিন্ন রকমের। আতর, গোলাব রক্ষিত ছিল বিরাট পুকুর। শরবত, মধু, দুধ ও শরাব ছিল নদী ভর্তি। ফল-ফলাদী ছিল বাগান ভর্তি। বিভিন্ন রঙ্গের পুস্প বিভিন্ন রকম সোভা বর্ধনকারী পদ্ধতিতে রোপণ করা হয়েছিল। এক কথায় আল্লাহ্ তা’য়ালার বেহেস্তের বর্ণনায় যা কিছু তাদের জানা ছিল তাঁর সবই সেখানে সমাবেশ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এমনকি হুর ও গেলমানের নামে বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্যা সুন্দরী রমণী ও সুন্দর বালকদিগকে সেবক হিসেবে সেখানে নিয়োগ করা হয়।
একাধারে সাড়ে তিন বছর যাবত চেষ্টা প্রচেষ্টার পরে সাদ্দাদের বেহেস্ত নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হল। এ সময় হযরত হুদ (আঃ) সাদ্দাদের নিকট এসে হেদায়েতের বাণী তাঁকে শুনিয়েছেন। সাদ্দাদ বেহেস্ত তৈরির অহংকারে নবীকে তুচ্ছ ভেবে কয়েক বার বলেছে তোমার খোদার কাল্পনিক বেহেস্তে আমি যেতে চাই না। আমি বাস্তব বেহেস্তে বসবাস করব। তখনকার দৃশ্য তোমাকে ডেকে দেখিয়ে দেব। নবী তাঁর উত্তরে বলেছিলেন এত অর্থ ব্যয়, সময় ব্যয় ও শ্রম ব্যয় করে যে বালাখানা তুমি তৈরি করেছ তাতে প্রবেশ করার ভাগ্য তোমার নাও হতে পারে। আল্লাহ্ তা’য়ালা যদি তোমার উপর বিরূপ হন তাহলে তোমার বেহেস্ত গমনের পূর্বে মৃত্যুও আসতে পারে। তখন তোমার এ দাম্ভিকতার কি স্বার্থকতা থাকবে। সাদ্দাদ এ সব কথার প্রতি কোন গুরুত্ব না দিয়ে বার বার বলত আমাকে তোমার খোদা কিছুই করতে পারবে না। বরং আমার কার্য দেখে তোমার খোদা লজ্জিত হয়ে পালিয়ে যাবে। তখন তাঁর সাথে তোমার কোন যোগাযোগ আর সম্ভব হবে না। তখন তুমি আমার নিকট ধর্না দিতে বাধ্য হবে। নবী সাদ্দদের কথায় খুবই বিষণ্ণ হলেন এবং ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিদায় নিলেন।
সাদ্দাদের বেহেস্তের যাবতীয় কার্য সস্পন্ন হবার পরে একদিন সে তার বেহেস্তে গমনের তারিখ দেশবাসীকে জানিয়ে দিল। নিদিষ্ট তারিখে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেহেস্তের কাছে এসে জমায়েত হল। সাদ্দাদ কয়েক হাজার সৈন্য নিয়ে অশ্বারোহণ করে বেহেস্তের প্রথম গেটে এসে চতুর্দিক তাকিয়ে দেখল। এতপর সেখানে কয়েক হাজার সৈন্য রেখে সম্মুখে অগ্রসর হল। দ্বিতীয় গেটে পৌঁছে চতুর্দিক তাকিয়ে দেখল এবং আনন্দ উপভোগ। সেখানে কয়েক হাজার সৈন্য রেখে তৃতীয় গেটের দিকে অগ্রসর হল। তৃতীয় গেটে গেটে পৌঁছে চতুর্দিক তাকিয়ে দেখল এবং আনন্দ উপভোগ। সেখানে কয়েক হাজার সৈন্য রেখে ৪র্থ গেটের দিকে অগ্রসর হল। সেখানেও কয়েক হাজার সৈন্য ৫ম গেটের দিকে রওয়ানা করল।
এভাবে সাতটি গেট পার হয়ে মাত্র দুই জন সেবক নিয়ে যখন বেহেস্তের প্রধান প্রাসাদের ফটকে এসে দাঁড়াল, তখন দেখল একজন বিশাল আকৃতির মানুষ বেহেস্তের গেটে দণ্ডায়মান। সাদ্দাদ লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে ? এখানে কেন দাঁড়িয়েছ ? লোকটি উত্তর দিল। আমি মালেকুল মউত । আমি আল্লাহ্র হুকুমে তোমার জীবন সংহারের উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। সাদ্দাদ লোকটির কথা শুনে একটু চিন্তিত হল। হযরত হুদ(আঃ) তাঁকে এ ধরনের মৃত্যুর একটি ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন।তাই তার হাত পা কাঁপতে শুরু হল। তবুও সে চিৎকার দিয়ে বলল, ভাই মালেকুল মওত! তুমি যদি বাস্তবিকই আমার জীবন সংহারের উদ্দেশ্যে এসে থাক তাহলে একটু সময় অপেক্ষা কর। আমি আমার দীর্ঘ দিনের সাধনার বেহেস্তখানা এক বার ঘুরে দেখে আসি। তার পরে তুমি আমার জান কবজ কর। মালেকুল মওত বলল, সে সুযোগ দানের অধিকার আমার নাই।