এলোপাথাড়ি

দুপুরে শুয়ে শুয়ে কত্তার গান শুনছিলাম। কত্তা বলছেন “বনে ফাগুণ মনে আগুন”… শুনতে শুনতে একটু উদাস হবার সাধ জাগল। জানলার বাইরে তাকালুম। দেখি আমার বন্ধু শিমূল গাছটা একমুখ হাসি নিয়ে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। তার মাথার ওপরকার একফালি আকাশে আউট অফ ফোকাসে একটা চিল না শকুন কি যেন উড়ছে, সেদিকে খেয়াল নেই! ডালপালা সব ন্যাড়া, ভেতরে ভেতরে ফুল ফোটানোর তোড়জোড় চলছে নির্ঘাত। আমি ছাড়া কেউ জানতেও পারেনা এসব! সবাই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে পথ চলছে। এখানে যে একটা গাছ আছে তাই আদ্দেক লোক জানেনা। গাছের ছায়া বিক্রি হয় এখন ইকো পার্কে।

আগেরবার এলোপাথাড়ি তে রাজনীতি নিয়ে লিখেছিলাম বলে অনেকে গাল পেড়েছিলো। “যে জিনিষ বুঝিসনা সেই নিয়ে আগরুম বাগরুম লেখবার কি দরকার বাপু?” আরে বুঝিনা বলেই তো লেখা, বুঝলে কি আর লিখতে যেতাম? রাজনীতিতেই নামতাম! রাজনীতিতে “নামা” টা ইন্টারেস্টিং। যেমন কারুর প্রেমে “পড়া”। কিম্বা কাউকে ভালো “লাগা”। গোলমেলে ব্যাপার স্যাপার সব। এসবের কোনটাই আমি বুঝিনা। ফ্রী তে লিখতে দিচ্ছে, যা মনে হয় লেখ! কার বাবার কি! পড়বি পড়বি না পড়বি না পড়বি। বয়ে গেল।

এইসব ভাবলেই মনে বড় দুঃখ হয়। বেসিক্যালি যে কোনও কিছু নিয়েই বেশী তলিয়ে ভাবতে গেলে দেখি মনে শেষমেশ বড়ই দুঃখ হয়! বুঝতে পারিনা তো কিছুই, সেই জন্যে হয়ত! অনেকের নাকি শুনেছি ভালো গান টান শুনলে কান্না পায়, সুন্দর সিনেমা দেখলে বা ভালো বই পড়লে কারুর কারুর নাকি চোখের কোণাটা ভিজে ভিজে লাগে। আমার কোনোদিন এসব হয়-টয়-নি! এই ভেবে আরও দুঃখ হয়! জীবনে একটা মাত্র মেয়ে কে হালকা ভালো লেগেছিল, প্রোপজ করেছিলাম, আজ দশ বছর ধরে তার সঙ্গেই আছি। আমার জীবনে একটা ব্যর্থ প্রেম নেই- এটা ভাবলে তো মনটা হু হু করে ওঠে। শিল্পী হতে গেলে যে যে ক্রাইটেরিয়া গুলো নেসেসারি তার প্রধান হচ্ছে ব্যর্থ প্রেম। সে আর আমার হল না! অথচ আমি চেয়েছিলাম শিল্পী হতে। পৃথিবীর তাবড় ব্যর্থ প্রেমের সাহিত্য পড়তে গেলে আমার হাসি পায়! আবার হাসি পাচ্ছে কেন সেই নিয়ে তলিয়ে ভাবতে গেলে আরও দুঃখ হয়। এই পারপেচুয়াল দুঃখানুভূতি কেউ বুঝবে না, কেউ না!

তাই আমি সবার সঙ্গে আড়ি করে দিয়ে একা একা ঘরে বসে থাকি। শিমূল গাছটার সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু এখন সেও ব্যস্ত তার নিজস্ব সৃষ্টি নিয়ে। সবাই কিছু না কিছু সৃষ্টি করছে। আমিই কেবল হংস মধ্যে বক যথা! বন্ধুরা দেখি কবিতা গল্প উপন্যাস কতকিছু লিখছে। কেউ কেউ আবার গান বাঁধছে, তাতে সুর দিয়ে গাইছে। অনেকে সিনেমা করছে, ফটো তুলছে। সবাই সৃষ্টির সরোবরে এক একটি পদ্ম হয়ে ফুটে উঠতে চাইছে। কেন চাইছে কে জানে! কেউ কেউ বলে, শুনেছি, “আমার কবিতা পায়”, হাগা পাওয়ার মত। আবার অনেক কে বলতে শুনেছি “না লিখে থাকতে পারিনা”। আরেকজন বলেছিল “সিনেমা না করলে বাঁচবো না।” যেন সে না বাঁচলে দুনিয়ার বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে! এইসব ন্যাকাপনা দেখলে আমার পিত্তি জ্বলে যায়।

 

***

 

বাঙলায় এতো কবি কেন সেই নিয়ে একটা গবেষণা হয়েছিলো, করেছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সমাজতত্ত্ব ও দর্শন বিভাগের বাঙালী অধ্যাপক শ্রী অর্ঘ্যকান্তি জোয়ারদার। তাঁর স্যাম্পেল সার্ভেতে উঠে এসেছিলো একটা বিচিত্র পরিসংখ্যান। দেখা গেসলো ৮২ শতাংশ বাঙালী কবিরা কেউ ভালো করে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু বা বিনয় মজুমদারের কবিতা পড়েননি। এঁদের মধ্যে মাত্র ৫৪ শতাংশ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও জয় গোস্বামীর কথঞ্চিৎ কবিতা পড়ে কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ। ৭৯ শতাংশ কবি মনে করেন যে ভালো কবিতা লেখবার জন্য অন্যদের কবিতা ও কবিতা সংক্রান্ত জটিল ও তাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী পড়াটা জরুরী নয়, যদিও তাঁদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ কবির কবিতা কোনও আন্তর্জাতিক মানের ম্যাগাজিনে ছাপাবার যোগ্য। এই সার্ভেতে বাঙালী কবিদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে তাঁরা কবিতা কেন লেখেন, উত্তরে যে যে চিত্তাকর্ষক ও কমন উত্তর গুলি পাওয়া গেছিলো সেগুলোর মধ্যে থেকে আমার পছন্দের পাঁচ টা উত্তর হল, যথা –

১) খিদে পেলে মানুষ খায় কেন? আমার কাছে কবিতা লেখাও সেরকম একটা জৈবিক চাহিদার মত

২) আমার যখন খুব প্রেম পায় তখন আমি কবিতা লিখি

৩) আমার কাছে কবিতা হল আমার স্বপ্ন দেখার ভাষা

৪) কবিতা লেখবার কোনও কারণ হয়না, আমি অকারণেই কবিতা লিখি

৫) কবিতা আমার প্রথম প্রেম ও আমার কফিনের শেষ পেরেক

 

এইসব সার্ভে রিপোর্ট থেকে গবেষক শ্রী জোয়ারদার এই কনক্লুশান টেনেছেন যে “বাঙালীরা এতই অলস ও জ্ঞানবিমুখ যে তাঁরা পড়াশোনায় উৎসাহী নন। তাই পূর্বজদের রচিত কবিতা পড়ে দেখবার ও তা থেকে কবিতা লেখা সংক্রান্ত জ্ঞান আহরণে তাঁরা উৎসাহী নন। বরং তাঁদের অধিকাংশই নিজেদের এই মানসিক সঙ্কীর্ণতাকে সেলিব্রেট করতে বদ্ধপরিকর। ফলে নিজেদের লিখিত কবিতা কোনও ম্যাগাজিনে ছাপা না হলেও এঁরা বিন্দুমাত্র হতাশাগ্রস্থ হন না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সেগুলি বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে প্রকাশ করেন ও লাইকের আশায় প্রতি ৪৫ সেকেন্ড অন্তর নিজেদের হোম পেজ রিফ্রেশ করেন। এইভাবে তাঁরা সহজলভ্য ও ক্ষণস্থায়ী প্রশংসায় মগ্ন হয়ে বাঙলা সাহিত্যের আকাশ বাতাস কে প্রতি নিয়ত কলুষিত ও পঙ্কিল করে তুলছেন।… যে দীর্ঘ সময় এঁরা ফেসবুকে অতিবাহিত করেন সেই সময় যদি সাহিত্য পাঠে মনোযোগী হতেন তাহলে বাঙলা কবিতার আজ এই দুর্দশা হতনা”। [“A Survey on the Bengali Poetry and the Poets in the age of Social Networking” by Shri Arghyo Khanti Joaardar, অনুবাদ- আবু আহমেদ বাচ্চু, নীলমণি প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ]

 

***

এইসব থিসিস লিখিয়ে বজ্জাৎ বাঙালীগুলোকে দেখলেই ক্যালাতে ইচ্ছে করে। খেয়েদেয়ে কাজ নেই অন্যের পোঁদের গু শুঁকে বেড়াচ্ছে। বাঙালী কবি পড়াশোনা করুক বা না করুক, সে অকর্মণ্য অপদার্থ গবেট হোক বা না হোক, তোর তাতে কি রে মড়া! তুই ব্যাটা মার্কিনীদের কাছে নিজের দেশের কুচ্ছ গেয়ে ডলার কামিয়ে সেই ডলারে পোঁদ মুছবি আর নিজের দেহাতি ভাই বেরাদরদের প্রতি কোনও মায়া দয়া নেই না? এই শিক্ষা! আমার যদি কলমের সেরম জোর থাকতো তো এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শতখানেক কবতে লিখে তোর বাড়ি দেওয়ালে গিয়ে সেঁটে দিয়ে আসতুম। যেমন কুকুর তেমনি মুগুর!

বলে নাকি কেউ পড়াশোনাই করেনা। এদিকে কোলকাতা বইমেলায় কাতারে কাতারে লোক পাগলা কুকুরের মত বই কিনে বেড়াচ্ছে, ছাগল কে খাওয়াবে বলে, নাকি? আমি তো এবার জীবনে প্রথমবার বইমেলা গিয়ে দেখলাম সব স্বচক্ষে। কতরকমের সব বই। রবীন্দ্রনাথ ও ফড়িং, আপেক্ষিকতা সূত্রের আলোকে যৌনতা, ভারতের জাতীয় ইতিহাসে জ্যোতি বসুর অবদান… এরম কতো সব চিত্র বিচিত্র বই! জীবনে এসব দেখতে পাবো ভাবিনি! বইয়ের দামও সেরকম আকাশ ছোঁয়া। পেট্রোলের দামের সঙ্গে নাকি কাগজের কোনও সম্পর্ক নেই, তাই এতো দাম। কে জানে, হবেও বা! আমি গিয়ে এদিক ওদিক খানিক ঘুরে টুরে বেড়ালুম, দু একজন পুলিশ আর বইপ্রেমী কে জিজ্ঞেস করলুম, তারা কেউ কিছু বলতে পারলেন না, অবশেষে একটা ম্যাপ জোগাড় করে অনেক ঘিলু অপচয় করে ফুডকোর্টটা খুঁজে বের করে নিস্তার পেলুম। ও বাবা, ফুডকোর্টে গিয়ে দেখি সেখানেও কি লাইন! সবার হাতে ইয়া মোটা মোটা প্যাকেট আর ব্যাগ ভর্তি বই। দেখে এমন ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আর অভিমান হল যে ফুলে ওঠা নাকের পেটো আর উপচে পরা ঝাপসা চোখ সামলে এক ছুটে পালিয়ে এলাম। আর কোনোদিন বইমেলা যাবনা ঠিক করেছি।

 

***

এইসব নানাবিধ দুঃখ কষ্ট চেপেচুপে অলক্ষ্যে সময় কেটিয়ে যাচ্ছি। ফেব্রুয়ারির হলদেটে বিকেলগুলো নদীর ওপর দিয়ে হু হু করে চলে যাচ্ছে একের পর এক। কত কিছু যে বলার ছিল আর করার ছিল, কিছুই গুছিয়ে ওঠা হচ্ছে না ঠিকঠাক। অনেকগুলো অসম্পূর্ণ লেখা জমে আছে, শেষ আর করা হচ্ছে না। নিস্তব্ধতার তিনমাস কেটে গিয়ে স্লো স্পীডে পাখা ঘোরার ঘ্যানঘেনে শব্দে নিমজ্জিত হয়েছে জীবন। শীতের কম্বলে মুখ গুঁজে থাকতে থাকতে টুক করে কখন দেখি, আরে, বসন্ত এসে গেছে!

কার্নিশের নয়নতারাগুলো রেলিঙ ছুঁইছুঁই হল। মা প্রতিদিন সকালে পুজো করার সময় ফুল তুলে নিয়ে যায়, ওরাও বিনা প্রত্যাশায় ফুল জুগিয়ে চলে প্রতিদিন। কেন কে জানে! আমাদের উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের বাচ্ছাটাও একটু বড় হয়ে গেছে। ‘বাচ্ছা’ থেকে ‘বাচ্ছা মেয়ে’তে রূপান্তরিত হচ্ছে প্রতিদিন একটু একটু করে। আজকাল আর রাত বিরেতে তারস্বরে কাঁদে না। বুদ্ধিসুদ্ধি হচ্ছে মনে হয়। তাকিয়ে দেখি আয়ার দুপুরের আলসেমির সুযোগ নিয়ে গ্রীলঢাকা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে একাএকা। সন্দিগ্ধ চোখে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে চারিদিকটা। ওদের ব্যালকনির লাগোয়া আমার প্রিয় বন্ধু শিমূল গাছটার উচ্চতা জরীপ করার চেষ্টা করছে ওর আনকোরা ভাষাহীন চাহনিতে। মেয়ে হিসাবে বড় হয়ে ওঠার খুঁটিনাটি শিক্ষার বেসিক পাঠ নিচ্ছে বোধহয় সন্তর্পণে। আউট অফ ফোকাসে চিলটা এখনও উড়ছে গোল গোল পাক খেয়ে। সেদিকে কারুরই খেয়াল নেই।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!