অনেকের মাঝে একা হওয়ার একটু পরে

ট্রেন যথাসময়ে ছেড়ে যখন শিয়ালদহ এবং বিধাননগরের মাঝামাঝি জায়গায়, ঠিক এমন সময় আমার মোবাইল ফোনটি বেজে উঠল। কথা শেষ হওয়ার আগেই লাইন কেটে গেল। নো নেটওয়ার্ক কভারেজ। অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – ওঃ শিট। তারপর এক এক মুহুর্তকে মনে হতে লাগল এক ঘণ্টা। আমার কথাবার্তা একটু লম্বা হওয়ার দিকে ছিল, সেই সঙ্গে মনে পড়ল দমদম ছেড়ে ট্রেন একটু এগোলে আবার একই সমস্যার মুখোমুখি হব, এছাড়াও ভিড়ের মধ্যে হয়ত ঠিকঠাক শুনতেও পারব না কাজেই একবার নেটওয়ার্ক ফিরে পেতেই একটা টেক্সট পাঠিয়ে দিলাম যে আধঘণ্টা পরে ফোন করছি। আমি নিশ্চিত তখন এই সমস্যা থাকবে না।

আধঘণ্টা কেটে গেল। ট্রেন থেকে নেমে অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে ফোন করলাম। কথা বলছি, আবার একই অবস্থা। দু’চারবার হ্যালো হ্যালো বলে ওপ্রান্ত থেকে সাড়া না পেয়ে ফোনটা সামনে নিয়ে দেখলাম চার্জ নেই, ফোন বন্ধ। অর্থাৎ প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ধাক্কা। আধঘণ্টা লাগবে বাড়ি পৌঁছতে, তারপরে মিনিট পনের চার্জ দিয়ে তবেই কথা বলতে পারব। একবার নিজেকে মনে ধন্যবাদ জানিয়ে নিলাম, প্রিপেড কানেকশনের বদলে পোস্টপেড নেওয়ার জন্যে। অন্তত ব্যালান্স শেষ হয়ে যাওয়া জনিত কারণে আমাকে কখনও বিপাকে পড়তে হয় না। অটোতে উঠলাম, সেই ট্রেনের অভিজ্ঞতা, এক মুহুর্তকে মনে হচ্ছে কয়েকদিন। কোথাও জ্যামে সামান্যতম আটকালেও মুখে গালাগাল উঠে আসছে। বহু কষ্টে সংযত রইলাম। বাড়িতে ঢুকে মোবাইলটা চার্জে বসাব, জামার পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম মোবাইলটা ওখানে নেই। এরপর বুঝলাম আমার জামার পকেট কেন, প্যান্টের পকেট কিংবা ব্যাগেও নেই। আবার বের হলাম, রাস্তায় দেখতে দেখতে। নাহ্ নেই। মানে আমি এতক্ষণ কথা বলতে পারছিলাম না, এখন এর সাথে জুড়ল সমস্ত কন্ট্যাক্ট, মেসেজ সব কিছুর জলাঞ্জলি। তবে মন্দের ভাল, আপডেটেড না থাকলেও একটা ব্যাক-আপ রাখা আছে।

কি মনে হচ্ছে? বানিয়ে বানিয়ে কি সব লিখছি, তাই তো? ঠিক ধরেছেন। একদম ঠিক। বানিয়ে বানিয়েই লিখছি। সবরকম দুর্ঘটনা একইসঙ্গে এভাবে সচরাচর ঘটে না। ঈশ্বর অত্যন্ত দয়ালু।

কারো কারো ক্ষেত্রে সমস্যা শুরু হয় এর অনেক আগে থেকেই।  অতএব ঘটতে পারে এর যে কোনও কিছুই, আলাদাভাবে হলেও। এই ‘ঘটতে পারে’ থেকেই শুরু হয় বিপত্তি। এক সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে এই ‘ঘটতে পারে’ যে চাপ সৃষ্টি করে তার তুলনা প্রথম চাকরি শুরু করা, প্রথমবার দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার কাছাকাছি। একটু পুরনো একটি গবেষণা এ-ও জানাচ্ছে যে ইংল্যান্ডের প্রায় ৫৩ শতাংশ মোবাইল ব্যবহারকারী আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন এই ব্যাধিতে। অর্থাৎ ‘কি ঘটলে কি ঘটতে পারে’ এই ভবিষ্যৎচিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে উঠেছে তাঁদের। হ্যাঁ, এটি একটি মানসিক অসুখ যার নাম ‘নো মোবাইল ফোন ফোবিয়া’ সংক্ষেপে ‘নোমোফোবিয়া’। মাত্র ছয় বছর আগে এই অসুখটির নামকরণ হলেও পিছিয়ে নেই আমাদের এই পোড়া দেশও। প্রায় চার বছর আগে ইন্দোরে একটি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের ভেতর সমীক্ষা চালিয়ে এই অসুখটির উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নিশ্চয় বেড়েছে। কারণ মোবাইল ফোন হ্যান্ডসেট এখন অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। আরও বেশি ইউজার ফ্রেন্ডলি হয়েছে। বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা হয়ে থাকা অনেক সহজ হয়েছে, সেই সঙ্গে অজান্তেই হয়ত এগিয়ে গিয়েছি অন্য দিকে।

একটি ব্যাধি হিসেবে একে সদ্যোজাতই বলা যায়। অতএব বিতর্ক আছে। আজকের দিনে গতির সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে মোবাইল ফোন তো অপরিহার্য। তাহলে কাকে বলব নোমোফোবিক? উপায় কিছু বেরিয়েছে। মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে।

১. হ্যান্ডসেটের সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতিতেই সীমাহীন অধৈর্য হয়ে পড়া
২. কোনও ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটছে কিনা তা নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কনশাস হয়ে ওঠা
৩. হ্যান্ডসেটটির জন্যে প্রায় জেড প্লাস ক্যাটেগরির নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা
৪. অন্যের হ্যান্ডসেটের বিষয়ে অতিরিক্ত আগ্রহী হয়ে ওঠা

এবং এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে যাঁরা চাইছেন তাঁরা যে পদ্ধতি অনুসরণ করছেন, তা হল

১. দিনের কিছু সময় ফোনহীন থাকা
২. আপনি যে গাড়ি চালাচ্ছেন বলে ফোন ধরতে পারছেন না, তা টেক্সট করে জানানো অদরকারী
৩. ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার দরকার নেই। আগামীকাল বলে কিছু একটার অস্ত্বিত্ব আছে
৪. এমনি একটু হেঁটে আসছেন শুধুমাত্র জামাকাপড় পরে
৫. দিনের কোনও একটা সময়ে লিখে ফেলছেন কাদের সাথে ফোনে কথা বলেছেন এবং সেটা কতটা জরুরি ছিল

অর্থাৎ সেই সব পদ্ধতিই অনুসরণ করছেন যা আমাদের বাইরের জগত থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে নিজেদের অন্তরমহলটাকে দেখার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। আসলে এই পৃথিবীতে একাই এসেছি, আবার ফিরে যাব একাই, আমি থাকি বা না থাকি এই গ্রহের কিছুই যায় আসে না, সে ঘুরতেই থাকবে আর নিত্য নতুন প্রাণের জন্ম দেবে, এত ভেতরেই কেউ সাময়িক অপরিহার্য হয়ে উঠব, কিন্তু কোনোদিনই এতটা অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারব না যে আমার অনুপস্থিতি এই গ্রহের ঘূর্ণন বন্ধ করে দিতে পারে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!