একবার আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। তা সেবার আমি আমার আজন্ম লালিত বিশ্বব্যাপী বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়ে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা স্কোয়াড খুলে ফেললাম। সদস্য মোটে দু’জন, আমি আর আমাদের পাড়ার অতীশ পাগলা। সে আবার তারা মায়ের ঘোর ভক্ত, সারা কপাল জোড়া ইয়া রক্ত তিলক আঁকা, গলায় আট দশটা জবা ফুলের মালা, যেখানে সেখানে মা তারা কে দেখতে পায়, মায়ের সঙ্গে কথা বলে। পাড়ার লোকে বলে যে পুরোপুরি পাগল হয়ে যাওয়ার আগে নাকি সে একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে তন্তর মন্তরের সাধনা করতে গেসলো, প্রায় দশ বারো বচ্ছর বেপাত্তা ছিল। তারপর হঠাৎ কোত্থেকে একদিন ন্যালাখ্যাপার বেশে ফিরে এলো, চোখে খ্যাপাটে চাউনি, মাঝে মাঝেই চোখ বুঝে ‘জয় তারা’ বলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পড়ে যখন তখন বৃষ্টি নিয়ে আসে, চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্বজন্মের গল্প বলে, সে নাকি এর আগে একশ বাহান্ন বার জন্মেছে, আগের জন্মে কচ্ছপ ছিল, বলে উবু হয়ে বুকে হাত দিয়ে হেঁটে দেখায় আর লোকের কাছে পয়সা চায়। না দিলে চোদ্দ পুরুষের নামে গাল পাড়ে আর ঢিল ছোঁড়ে। তাই তার কাছে পাবলিক খুব একটা ঘেঁসে না। কিন্তু কেন জানিনা আমাকে সে প্রথম থেকেই স্নেহের চোখে দেখত, আমিও তাকে দেখতে পেলে বিস্কুট মিষ্টি টিস্টি খেতে দিতুম মাঝে সাঝে। একবার তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছিলুম, শুনে তো অবাক! ব্যাটা পাগল হলে কি হবে, আসলে সে ঢাকা বিক্রমপুরের কোন এক পুরনো রাজ পরিবারের ছেলে, বিদ্যে বুদ্ধিতে আচ্ছা আচ্ছা পালোয়ানকেও নাকি হার মানায়।
তা সেই অতীশ পাগলা হল আমাদের স্কোয়াডের চিফ কমান্ডান্ট আর আমি তার অনুগত যোদ্ধা। অস্ত্র শস্ত্র যোগাড় করতে করতে আমাদের মাস খানেক কেটে গেল। আমাদের বাড়িতে দা কাটারী হাতা খুন্তি লোহার বাঁটওলা দাদুর ভাঙা ছাতা ইত্যাদি যা যা ছিল সবই কৌশলে হাতিয়ে ফেললাম। উপরন্তু অতীশদের রাজবাড়ির গুপ্ত কুঠুরির বাতিল সিন্দুক আলমারি হাঁতড়ে পাওয়া গেলো মোগোল আমলের খান দুই ভাঙাচোরা রূপোর যমধার কাতার আর একটা জং ধরা গাদা বন্দুক। কিন্তু টোটা নেই যে! অতীশ অভয় দিয়ে বললে তার দাদুর সিন্দুক থেকে বারুদ বানাবার ফর্মুলা লেখা পুরনো পুঁথি চুরি করে আনবে। ব্যাস, আমাদের আর পায় কে!
এরপর রণকৌশল বা স্ট্রাটেজি নির্ধারণের পালা। একটা বিপ্লব করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, আগে পায়ের তলার মাটির চরিত্র বুঝতে হবে, তারপর জানতে হবে শত্রুপক্ষ কারা, তারা কি চায়, তাদের শক্তি আর আমাদের শক্তির তারতম্য কতটা, অতই সোজা ভেবেছো, অতীশ বললে। আমি ভেবে দেখলাম, কথা কিছু মন্দ বলেনি ছোঁড়া। আমি তো ছিলাম স্বপ্নে বিভোর, এসব কিছু ভেবে দেখিনি কোনদিন। শুনে অতীশ পাগলা তো খচে লাল, আমাকে মেগালোমেনিয়াক বলে গাল দিলে, বলে আমি নাকি ওর দুর্মূল্য সময় নষ্ট করছি ইত্যাদি। আমি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করবার জন্য তাকে একটা জিবেগজা উপহার দিলুম। এবার সে একটু শান্ত হয়ে আমার দিকে তাকাল, গম্ভীর গলায় বলল, “কাল রাত এগারটার সময় দিকনগরের খাল পাড়ের শ্যাওড়া গাছের নীচে চলে আসবে, আমি ওখানেই থাকবো। সঙ্গে অস্ত্র আনবে, আর এমন পোশাক পরবে যাতে সহজে কামুফ্লাজ করা যায়। মনে থাকে যেন।” আমি তার গায়ের কাছে ঘন হয়ে বসলুম, তাই হোক কমরেড, তুমিই পথ দেখাও তবে।
অতঃপর পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে শ্যাওড়া গাছের তলায় গিয়ে পৌঁছলাম। তখনো জানিনা কি আছে কপালে। দেখি চারিদিক সুনসান, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, অতীশ পাগলার দেখা নেই! এ কি চব্ব্য! ব্যাটা পাগল কি আমাকে নিয়ে বটকেরা করলে নাকি? খাল পাড়ে মশার কামড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে যেই একটা বিড়ি ধরাতে গেছি ওমনি কটাং করে ব্রহ্মতালু তে একটা রামগাঁট্টা এসে পরল আর পরমুহূর্তে দেখি মাথার চারিদিকে গোলগোল করে মুনিয়া পাখির মত এক গাদা সাদা সাদা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে! রীতিমত ভিরমি খেয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি শ্যাওড়া গাছের ডাল থেকে উর্দ্ধপদ হেঁটমুণ্ড অতীশ পাগলা ঝুলে রয়েছে আর শেয়ালের মত জ্বলজ্বলে সবুজ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি একটু অভিমানাহত হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বললুম, “মারলে কেন?” শুনে চোখ পাকিয়ে বলে, “যুদ্ধের প্রান্তরে বিড়ি ফুঁকতে এয়েচো? একি হলিউডের ঢপ্মারানি ফিলিম পেয়েচো নাকি? ওসব এখেনে চলবে না, জেনে রাখো।” আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, “না না তোমাকে দেখতে না পেয়ে একটু নার্ভাস হয়ে পরেছিলুম কিনা, তাই আরকি।”
“নার্ভাস আবার কি? চারিদিকে গিজগিজ করছে এতো শেয়াল কুকুর নেকড়ের পাল, সেসব দেখে নার্ভাস লাগে না?” আমি চম্কে চারিদিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিলাম, তারপর ঢোঁক গিলে বললাম, “লাগে না আবার? সেই জন্যেই তো অস্তর শস্তর বগলদাবা করে ঘুরছি, এই দ্যাখো না”, বলে তাকে কাঁধের গাদা বন্দুক টা দেখালুম। অতীশ পাগলা তখন খুশি হয়ে বিশুদ্ধ সংস্কৃতে “ওঁ হ্রিং ক্রিং গবেট জরদ্গব গদাম ফট্ স্বাহা” মন্ত্র আওড়ে বিচিত্র কায়দায় শূন্যে একশ আশি ডিগ্রী পালটি মেরে সটাং আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর আমার কানে কানে বলল, “এখন তোমার বিপ্লবের হাতেখড়ি হবে। চলো, তোমাকে আজ আমার মাথার ভেতরে নিয়ে যাবো।”
শুনে আমি পরম উৎসাহে নেমে যাওয়া প্যান্টুল টেনে টুনে কোমরে সেট করে নিই, চশমায় কালো কার বেঁধে মাথার পেছন দিয়ে এঁটে নিয়েছি আগেই, হাতকাটা কমলা পাঞ্জাবী, রোঁয়া ওঠা ডেনিম জিনস আর ধবধবে সাদা কেডস্ পরে ‘সাওধান’ পোজিশানে দাঁড়িয়ে প্রবল বিক্রমে চেঁচিয়ে বলে উঠি, “লাল সেলাম কমরেড। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।” অতীশ পাগলাও হাত মুঠো করে চেঁচিয়ে ওঠে, “হোক হোক।” তারপর সে খপ্ করে দুহাতে আমার কপালের রগ দুটো ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকাতে শুরু করল আর কি আজগুবি ভাষায় আবোল তাবোল মন্ত্র পড়তে লাগলো।
ধীরে ধীরে আমার চেতনা ধূসর মসলিন আস্তরণে ঢাকা পরে যায়, ঘন রসের পুকুরের ওপর দিয়ে সন্তুরের বেসুরো টুং টাং এর মত অতি স্লো মোশানে বয়ে যেতে থাকে ঢেউয়ের পর ঢেউ, আর কলঘরে একটানা জল পরার শব্দের মধ্যে দিয়ে কার যেন অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাই- “ওঠো, জাগো, আর কতকাল ঘুমিয়ে থাকবে বাওয়া? শেয়ালের বাচ্চারা এসে যে সব লুটে পুটে নিয়ে গেলো। মায়ের ইজ্জৎ বেচে সেই দিয়ে বিশ্বশান্তির ন্যাকরা ওড়াচ্ছে, আর তোমরা সেই শান্তির ঘুমে নাল ঝোল ফেলে মোরছো? বিপাশার পাছা ভেবে আর কদ্দিন স্বপ্নে পাশবালিশ ফুটো করবে?”
আমি ধরমরিয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করি, দেখি কার একটা ঠান্ডা হাত আমার কপালের ওপর। আমাদের পাড়ার অতীশ পাগলা, শাদা ধপধপে পোশাকে সর্বাঙ্গ আবৃত তার, চোখে মুখে অন্য রকম জ্যোতি, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমাকে বলে, উঠতে হবেনা, শুয়ে থাকো এখন। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখি খাল পাড়, শ্যাওড়া গাছ সব ভোঁ ভাঁ, এ যেন কোনও ক্যালেন্ডারের সিনারির মধ্যে ঢুকে বসে রয়েছি আমরা দুজন, দূরে দিকচক্রবাল রেখার কাছে পূব দিক থেকে চাঁদ উঠছে আর পশ্চিম দিক থেকে সূর্য, আকাশ টা উদ্ভাসিত হয়ে আছে গলন্ত কাঁচা সোনার রঙে!
আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করি, “এটা কোন জায়গা?” অতীশ পাগলা হেসে উত্তর দেয়, “এটা হল আমার মাথার ভেতরের শহর থেকে বহু দূরের একটা ইকো-ট্যুরিসম পার্ক, কেমন বুঝছো?” আমি কোনোমতে বললাম, “বেঁড়ে!” সে খুব একচোট হেসে নিয়ে বলল, “বাল! ইকো সিস্টেমের মা মাসি এক করে দিয়ে এখন ঢপের ইকো পার্ক বানিয়ে মানবধর্মের কুমীর ড্যাঙ্গা খেলতে এয়েচে। যত্তোসব!” আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “তা এতো যখন জানো তো মরতে নিজের মাথার ভেতরে এসব বানিয়ে রেখেছো কেন?” সে বললে, “কে বলেছে বানিয়ে রেখেছি? এসব কোনো কিছুই পার্মানেন্ট ভেবেছ? ওহে চাঁদু, এ হল গিয়ে পাগলের মাথা, এই আছে এই নেই!” অগত্যা কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ব্যাটা বদ্ধ উন্মাদ, কি যে বলে তার আদ্দেক বোঝা যায়না! এদিকে সে যেন এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে বলে চলেছে- “ওই যে দেখছো পাহাড়ের মতন মাটির ঢিবি, ওর নীচে আছে গত সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। উঃ কি ঐশ্বর্যই না ছিল এককালে, সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা সব জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত, বীর যোদ্ধা, তুখোড় রাজনীতিবিদ… যাদের কে তোমরা ধরে ধরে ঠাঁই দিলে সমাজের একদম গ্রাউন্ড ফ্লোরে… তুর্কী শয়তানের পা চেটে নিজেরা উঠে গেলে ওপরে… বামুন আর মুসলমানের বদমাইশিতে সব গিয়ে লুকলো মাটির নীচে… আরে বাবা বাংলা তো চিরকালই ছোটলোকের দেশ, ট্রাইবাল অধ্যুষিত, অবৈদিক, বৌদ্ধ বাংলা, সেই মহাভারতের যুগ থেকেই তো… পান্ডব বর্জিত দেশ… মনে নেই, বনবাসের সময় পাণ্ডবরা বাংলায় এসেছিলো বলে তাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল… কেন বল দিকিনি? হেঁ হেঁ হেঁ, বাংলা তো আসলে অসুরের রাজ্য, আমরা তো সব অসুরের বাচ্ছা, ডাকাতের বংশধর, হারেরেরেরেরে…” সেই মায়াবী উদ্যানের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যেতে লাগলো অতীশ পাগলার ডাকাতে চিৎকারে।
আমি আর থাকতে না পেরে প্রতিবাদ করে উঠি, “কি আবোল তাবোল বকছ সেই থেকে? নিজের দেশের সম্পর্কে এরম কথা বলতে নেই। বাংলার নবজাগরণের ইতিহাস গুলো পড়ে দ্যাখো, বড় বড় মনিষীরা কত ভালো ভালো কথা লিখে গেছেন আমাদের বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে, ভাবলে গর্ব হয়। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর…”
অতীশ পাগলা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “বিদ্যাসাগর? এই সেই জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি… গিরি নয়, গিরি নয়, গেরো.. ওইখেনেই তো আসল গেরো। নবজাগরণের গল্প আদ্দেক গুলগল্প, কিছুটা নেটিভদের নিজেদের বর্তমান অবস্থা কে ভুলিয়ে রাখবার চুষিকাঠি হিসেবে আর কিছুটা ইউরোপিয়ান নীতিবাদের শেকড় পত্তনের উদ্দেশ্যে ম্যাক্সমুলার আর তার চ্যালা চামুণ্ডারা মিলে এইসব পাঁয়তারা কষেছিল। আর পরের দিকে ইংরেজের বিরুদ্ধে গোটা জাতটা কে জাতিগত ঐক্যের ছাতার তলায় এককাট্টা করবার উদ্দেশ্যে নবজাগরণের মনিষীরা ওই সমস্ত রূপকথা কে কাজে লাগিয়েছিল, আরও নানা রকম গপ্পো ফেঁদেছিল… আর বেদ পুরাণের গোল গল্প? ওসব সব শালা বৈদিক পণ্ডিতদের অধিক পরিমাণে সোমরস আর গ্যাঁজা টানবার ফল। সব কিছুর সঙ্গে একটা করে উদ্ভট গল্প যোগ করে দাও আর সমস্ত কিছু কে গিলে খাও… শালারা তথাগত বুদ্ধকেও বানিয়েছে বিষ্ণুর অবতার… এরে কয় তিমিং গিল! বড়ো তিমি সোটো তিমিরে গিইল্যা খায়, বুইলে কত্তা… আর শুধু কি বুদ্ধ? গনেশ, জগন্নাথ, সরস্বতী, কালি, শিব, চন্ডী, মনসা… এমনি এমনি এক একটা ঠাকুরের দুশ পাঁচশ করে রূপ আর অবতার? হাতের সামনে যা পেয়েছে সব গিলে গিলে খেয়েছে, কি খিদে বাপরে! মা তারা, মাগো মা, কোথায় তুই তারা মা? ওঁম্ তারে তুত্তারে তুরে স্বহা। জয়ত্তারা।” অতীশ চোখ বুজে বিড়বিড় করে খানিক তারা মা এর ধ্যান করে নিয়ে ফের শুরু করল- “আর মুসলমানরাও কম যায়না, ধরে ধরে বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মুন্ডু কেটে গেণ্ডুয়া খেলেছে, পুঁথি পুড়িয়েছে, চৈত বিহার মন্দির যা পেয়েছে সমস্ত ভেঙে তচনচ করেছে, নালন্দা বিক্রমশীলা, সমস্ত মহাবিহারগুলো কে শেষ করেছে… ধর্মস্বামীর নাম শুনেছ? ১২৩৪ সালে তিব্বত থেকে একা একা পায়ে হেঁটে পড়তে এসেছিলো নালন্দায়, রোগ জ্বালা দুর্যোগ ডাকাত সমস্ত কিছু পেরিয়ে শেষকালে নালন্দায় পৌঁছে দেখে একটা মাত্তর নব্বই বছরের থুত্থুড়ে মাষ্টার আর গোটা সত্তর ছাত্র থরহরিকম্প হয়ে দরজায় খিল এঁটে বসে রয়েছে। বাকি সব হয় মরেছে নয় মুসলমানের ভয়ে পালিয়েছে।… আর শালা ক্যালানির চোটে কনভার্সান কাকে বলে দেখে যা। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে যেখানে যত রিলিজিয়াস কনভার্সান হয়েছে তার রেট বিচার করলে মধ্যযুগের বৃহত্তর বাংলা এক থেকে পাঁচের মধ্যে থাকবে, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। প্রথমে ট্রাইবাল আর শুদ্ররা বৌদ্ধ হল, তারপর উঁচুতলার বৌদ্ধরা গলায় পৈতে ঝুলিয়ে বামুন হয়ে গেল, আর নিচু তলার নেড়ানেড়ি যত ছিল সব কণ্ঠী গলায় দিয়ে বোষ্টম হয়ে নবদ্বীপে আর খড়দায় কেত্তন গাইতে বসলো, আর রেস্ট অফ দা লট ঝাড়া ঝাপটা যা কিছু অবশিস্ট ছিল সব সুন্নৎ করে মুসলমান হয়ে প্রাণ বাঁচালে। আর তারপর আবার ইংরেজ আমলে সুযোগ বুঝে টাকা পয়সা খরচা করে পদবী পালটে ধরাদ্ধর সব উঁচু তলায় উঠে এলো। এই আজকের যত বাঙালি বামুন আছে দেখছ, জানবে সব শালা এক কালে বৌদ্ধ ছিল।”
আমি অতীশ কে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “কিন্তু শাস্ত্রে যে বলেছে প্রাণ গেলেও নিজের ধর্ম কে পরিত্যাগ করতে নেই, তার কি হল?”
অতীশ চোখ টিপে বললে, “বুঝলে না? সেই জন্যেই তো ওই কথা লিখেছে, যাতে লোকে কনভার্ট না করে, সব লোক তো তখন প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে! আরে ধর্ম ফর্ম কে গুলি মারো, আগে আপনি বাঁচলে তবে বাপের নাম, বুঝলে চাঁদু?”
এইসব শুনতে শুনতে আমার ঘুম পেয়ে যায়। আমি সেইখানেই শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পরি। পোকা মাকড়ের ফিস্ফিসানির মত অতীশ আমার কানের কাছে বলে চলেছে হাজার বছরের ঘোলাটে শ্যাওলা ধরা সব গল্প। কি যে সেসবের মানে তা আমি জানিনা, অথচ সেই সম্মোহনের যন্তর মন্তরে আমার মাথা পরিস্কার হয়ে উঠছে ক্রমে। চোখের ওপর সিনেমার ফ্রেম আসছে যাচ্ছে একের পর এক, সুপার ইম্পোস করে একে অন্যের সঙ্গে তাল গোল পাকিয়ে জন্ম দিচ্ছে বিস্মৃত প্রাচীর ভাস্কর্যের নিসর্গ গাথা। আমি নিস্পলক সেই অন্ধকার শূন্যের দিকে চেয়ে রয়েছি। অতীশ জলদগম্ভীর কন্ঠে কি একটা অপূর্ব সংস্কৃত স্তোত্র পাঠ করে চলেছে, আর সেই স্তোত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আবির্ভূতা হয়েছেন আমার সামনে। নিরঞ্জনের স্বচ্ছতোয়া অনাবৃত স্পর্শে দেবী আমাকে আলিঙ্গন করছেন, তাঁর দানা দানা গোলাপি বেদানা জিভ খেলা করে বেড়াচ্ছে আমার সারা মুখে, আমি ধীরে ধীরে ডুব দিচ্ছি তাঁর সহস্রদল দেহপদ্মের গহন সরোবরে। আনলার্ন করো, আনলার্ন করো, ভুলে যাও যা শিখেছ, অতীশ বলে চলেছে। জ্ঞান দিয়ে প্রপঞ্চ কে বোঝবার চেষ্টা করোনা, নির্জ্ঞানের সমুদ্রে ডুব দাও। অভিজ্ঞতা কে তুচ্ছ করো, নিজেকে ছাড়িয়ে আনো নিজের থেকে।…
গাঢ় রঙের ওপর নিঃসাড়ে স্নেহের পরত পরেছে সমস্ত চরাচরে। সেলুলয়েডের ঘন নীল জ্যোৎস্না প্রান্তরে বসে রয়েছি আমি আর আমাদের পাড়ার অতীশ পাগলা, পরনে গেরিলা যুদ্ধের কামুফ্লাজ পোশাক, হাতে নির্মম যমধার। ঘাসের গোপনে সাজানো গোছানো পিপিলিকা নগরীর বাতিস্তম্ভের আলো নিভু নিভু। অতীশ আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায় সমস্ত শহর। এই দ্যাখো নরকের দ্বাররক্ষী বিভীষিকা যক্ষিণী মূর্তি, ওই যে মহা-মাতৃকা দেবী ছিন্নমস্তার সংহার ভ্রূকুটির নীচে কপিউলেটেড আদম আর ইভ। আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে আর আমি কাঁধের গাদা বন্দুক সামলাতে সামলাতে তার পেছন পেছন চলেছি। শবরীর মেহগনি স্তনবৃন্ত থেকে গড়িয়ে পরছে সুতীব্র মাধ্বী ধারা, এই হল ভাষা, এসো পান করি। আমরা দুই হাত অঞ্জলি ভরে পান করে নিই হাজার বছরের প্রাচীন সেই জংলা মদ। কোথায় কোন স্বর্গীয় রবাবে ঋষভের গর্ভ থেকে অতি কোমল গান্ধারের মায়াবী আন্দোলনে আবির্ভূত হচ্ছে দরবারী কানাড়ার সুগভীর অনুনাদ। পরাবাক ধ্বনি গাম্ভীর্যের মত্ততায় শরীরের ভেতরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অশরীরী জলপ্রপাতের আত্মারা। সেই নাদবিন্দুর অনন্ত গহ্বরের শূন্যতায় এক অর্থহীন পরাবাস্তব কার্নিভ্যাল চলছে, জীবনের জীবিতের তূরীয় সেলিব্রেশান। আমরা সন্তর্পণে সেই মেলায় প্রবেশ করি, সামনেই একটা বিশাল আকাশছোঁয়া নাগরদোলা শান্ত গতিতে ঘুরছে, একটা ফাঁকা সিট দেখে অতীশ হঠাৎ আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে লাফিয়ে সেটায় চড়ে বসে। আমি অবাক হয়ে অতীশের দিকে তাকিয়ে বলি, “একি, আমাদের বিপ্লবের কি হবে?” সে শান্ত চোখে অভয় দিয়ে বলে, “আগে পায়ের তলার মাটির চরিত্রকে জানো, নিজেকে জানো, জীবন কে জানো, তবেই না বিপ্লব করবে। অতই সোজা ভেবেছ,” বলে পরম নির্লিপ্তির সঙ্গে হাতের জিবেগজা তে একটা আলতো কামড় বসায়। আমি ভেবে দেখি, কথা কিছু মন্দ বলেনি ছোঁড়া। আমার মাথা থেকে তখন স্বপ্ন ফপ্ন সব কেটে গেছে, দিব্বি পরিষ্কার স্বচ্ছভাবে চিন্তা ভাবনা করতে পারছি, সাদা কালোর মধ্যবর্তী ধূসরতায় চোখ সেট হচ্ছে ধীরে ধীরে। অতঃপর লক্ষ বছর ধরে ঘুরপাক খেতে থাকা সেই আবহমান নাগরদোলায় বসে আমি আর অতীশ পাগলা গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে আমাদের বিপ্লবের পরবর্তী রণকৌশল নির্ধারণের কাজে নিমগ্ন হই। দিকনগরের খালের ওপারে পূব আকাশে তখন লালচে আভা লেগেছে, শ্যাওড়া গাছের ফাঁক দিয়ে ভোরের প্রথম আলো এসে পড়েছে আমাদের চোখে মুখে। অতীশ চোখ বুজে ধীর ছন্দে উদীয়মান সূর্যের উদ্দেশ্যে স্তব আবৃত্তি করে চলে-
ভাস্বদ্রত্নাঢ্যমৌলী স্ফুরদধররুচা রঞ্জিতশ্চারুবেশো,
ভাস্বান্ যো দিব্যতেজাঃ করকমলযুতঃ স্বর্ণ বর্ণ প্রভাভিঃ।
বিশ্বাকাশাবকাশ গ্রহপতিশিখরে ভাতি যশ্চোদয়াদ্রৌ,
সর্বানন্দপ্রাদাতা হরিহরনমিতঃ পাতু মাং বিশ্বচক্ষুঃ।।
***
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।