হেমন্তের এক জাফরান বিকেলে আমি ও আমার পরম সুহৃদ ধর্মকেতু পাহাড় চুড়ার উদেশ্যে রওনা দিলাম। আমার কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, তাতে বাপুজি কেক ও জলের বোতল। তাছাড়া ধর্মকেতুর নকশা করা প্রিয় মাঙ্কি টুপি যা খরিদ করবার জন্য সে, কেননা শীতকাল সমাগত, ধর্মকেতু পাড়ি দিয়েছিল মার্কিন মুলুকে। ফিরে এসে আশেপাশের একঘেঁয়ে গোবরা মানুষদের দেখে সে উন্মার্গগামী হয়ে উঠলো। মানুষের তেলচিটে সংসার তার আর ভালোলাগেনা, এইবার সে নিসর্গের তূরীয় দ্রবণ চায়। এখানে আর তার মন টেঁকে না। যেনতেন প্রকারেণ সে একটা পাহাড়ের চুড়ায় যাবেই। এই এক বিচিত্র ব্যামো তার মাথায় ইদানীং। বাতাসে আঙুলের তুলি বুলিয়ে যখন তখন পেড়ে আনে বিদঘুটে নকশা চিত্র, আবছায়া জ্যামিতিক পমেটম ও বেরঙা ছাতারে। তাছাড়া গোসাপের থুতু সংগ্রহ করে তাই দিয়ে অতি উত্তম মদ প্রস্তুত করবার পন্থা শিখে এসেছে। ভূত পোষে কিনা তা অবশ্য আমার জানা নেই। সে যাক।
আমাদের যাত্রা শুরু হল। জনপদ পেরিয়ে খোলা প্রান্তর পেরিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে তবে আমাদের সেই পাহাড়। অজানার ডাকে নিরীহ আমরা আজ কুণ্ডলী থেকে বেড়িয়ে এসেছি, আমাদের রক্ত ঠান্ডা। ধর্মকেতু যোগী পুরুষ, যে কোনও রকম আশু বিপদের ইঙ্গিত সে পায়, দুনিয়ার যাবতীয় উচাটন ক্রিয়ায় সে সিদ্ধহস্ত! তার সঙ্গে থাকলে আমার আর ভয় কি?
আমরা হাঁটছি। যদিও রাস্তা চিনিনা, রাস্তাই চিনে নিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে, এবং যেন আমরা নেই এইভাবে, ঈষৎ নিষ্প্রভ, আমাদের পরোয়া না করে সমস্ত দৃশ্যমানতা নিয়ে ভোজবাজীর মত ঝাঁপ দিচ্ছে পিছনের শব্দহীন নির্জনতায়। নিরালম্বের মত শূন্যে ভেসে রয়েছি আমরা। মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে গড়িয়ে যাচ্ছে জীবন, যেমন ছাতিম ফুলের গা বেয়ে গড়িয়ে পরে বিন্দু বিন্দু জ্যোৎস্না। আমরা হাঁটছি। টেড়িকাটা পরিপাটী চুলের গোড়ায় বাসা বাঁধছে অনাত্মীয় ধুলো। মুখের ওপর নুইয়ে পরা গোধূলির বোরখা সরিয়ে সরিয়ে আমরা চলেছি। বহুদূর ফেলে আসা মলিন গ্রামের বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে শাঁখের আযান। পৃথিবীর সমস্ত উন্মাদের জীবনে নেমে আসছে শুকনো জমাট মাংসের মত আরেকটা নিঃসঙ্গ রাত। আমাদের এখনও বহুদূর যাওয়া বাকি।
২
মনুষ্য বসতির শেষ মাইল ফলক পেরিয়ে এসেছি কিছুক্ষণ আগে। সামনে দেখা যায় জঙ্গলের সীমানা। তারও পরে বৃদ্ধ ‘আরাবল্লি’র আলিঙ্গনে ধূসর হয়েছে ক্যানভাস। এসব জঙ্গল আমাদের বন্ধু নয়, সবুজের ঝাঁঝালো কোহল নিঃশ্বাসে হিংস্র আহ্লাদ ঝরে পড়ছে। সন্ধ্যার পোয়াতি আবছায়ায় আমরা এসে বসি এক ছদ্মবেশী হ্রদের পাড়ে, পরিশ্রান্ত পথিক যেমন। হ্রদের স্নেহহীন প্ল্যাসিড জলস্তরের ওপরে আদিম বুদবুদ ভেসে উঠছে, হ্রদের গভীরে এখন রাত্রি দুই প্রহর। যেকোনো মুহূর্তে সে এক দানবের রূপ ধরে উঠে এসে গিলে খেতে পারে আমাদের। একটি কিশোরী শিরীষ গাছ ধর্মকেতুকে কানে কানে এই বিপদ সংকেত জানিয়েছে। সে এখন তাই এক গুহ্য যৌগিক ক্রিয়ায় মগ্ন, নদীর দেবতাকে তুষ্ট করতে না পারলে আমাদের যাত্রা সফল হবেনা। ইউক্যালিপটাসের মাথায় নেমে এসেছে দলে দলে জীন ও পরীরা, গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঝিকমিক করছে তাদের অভ্র বিভঙ্গ, তুঙ্গ টুং টাং। আকাশে নক্ষত্র পতনের মহাজাগতিক নৈশব্দে কান পাতা দায়। আর ঠিক এমনই মুহূর্তে নিকটবর্তী জঙ্গলের মধ্যে বেজে ওঠে দ্রিমিকি দ্রিমিকি দাদুরী দিদুরা – দ্রিম দ্রিম দারা – দ্রিম দ্রিম দারা… বাজতেই থাকে বাজতেই থাকে বাজতেই থাকে। আর বাজনার তালে তালে জঙ্গলের প্রাচীন বনস্পতিরা মাটি কাঁপিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে আমাদের চারিপাশে। এ যেন এক নৈসর্গিক অর্জির সূচনা হয়েছে। আমরা সচকিত হই। ধর্মকেতুর ধ্যান ভঙ্গ হয়েছে, সে উঠে এসে আমার পাশে বসে। বহুদূরে আকাশের কোণ ঘেঁসে দিকচক্রবাল রেখায় তখন কালচে বেগুনী নিশ্চলতা।
সন্ধ্যে আরেকটু নিটোল হলে আমরা অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করি। দুন্দুভি ধ্বনি ক্রমশ পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক উদ্ভট গ্র্যান্ড অপেরার জন্ম দিয়েছে। হাড়ে তাক লাগানো উত্তরে হাওয়ায় বাবলা গাছের মাথা দুলছে, ভালো করে কান পাতলে তীক্ষ্ণ বাঁশির সুর, স্নায়ুর ওপর বুলিয়ে দিয়ে যায় তার মোলায়েম সেলোফেন অঙ্গুলি।
আর তখনই মুখ তুলে তাকিয়ে আমার খটকা লাগে, দূরের সারিবদ্ধ পাহাড় কি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে? পাহাড়ে পাহাড়ে কথা হচ্ছে কি ফিসফিস? জঙ্গলের অপদেবতা পাসাংমারা কি জেগে উঠেছে তবে? এইসব পাহাড় অরণ্য সব তাঁর সম্পত্তি, এখানে তাঁর আইন চলে, বাইরের মানুষের উপস্থিতিতে রুষ্ট হন তিনি, তখন পাহাড়ে পাহাড়ে গোপন নির্দেশ চালাচালি হয়, বহুযুগের আদিম অন্ধকার এগিয়ে এসে ঘিরে ফেলে অরণ্য কে, সেই অন্ধকার থেকে জ্বলে ওঠে প্রতিহিংসার আগুন।
আমাদের হাতে বেশী সময় নেই, কাজ সারতে হবে দ্রুত। আমরা পা চালাই। চারিদিকে ন্যাড়া ন্যাড়া পাহাড়, ভয়ার্ত কর্কশ ডাক ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে সন্ধ্যের শেষ পাখীর দল, জংলী ফুলের রেণু তে বারুদ বারুদ গন্ধ। মায়া উদ্ভিদ থেকে পথের দুধারে ঝরে পরেছে করুণার চূর্ণ ফুল, রাত্রির চিদস্পর্শে জরাগ্রস্থ ডাকিনীর অস্পষ্ট প্রেতদাগ। চারিদিকে কেমন একটা অপার্থিব নিশ্চলতা, কেবল দামামার শীৎকারে মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে অরগ্যাসমিক চাঁদ।
৩
এদিকে পাহাড়ের দেখা নেই! গত তিন ঘণ্টা ধরে আমরা এই ভুতুড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এমনটা তো হবার কথা নয়। ধর্মকেতু গণনা করে দেখেছে জঙ্গলের প্যাঁচানো পথে খানিকদূর গেলেই পাহাড়ের উৎরাই শুরু হওয়ার কথা। ধর্মকেতুর গণনা তো মিথ্যে হয়না, সে গণিতের দিজ্ঞজ বটে। কদিন আগেই গণনা করে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের পা এর মাপ আবিষ্কার করেছে। এদিকে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সুকতলা ক্ষয়ে যাবার যোগাড়! আমরা কি তবে জঙ্গলে পথ হারিয়েছি? ধর্মকেতু আবার নক্ষত্রের অবস্থান মিলিয়ে মাটিতে হিজিবিজি ছক কেটে আঁক কষতে বসলো। আর ওমনি জঙ্গলের অন্ধকারও যেন আরও এক পোঁচ ঘন হয়ে ঝুপ করে নেমে এলো তার কোলের ওপর, আকাশের বুকে কোত্থেকে এক পাল জমাট মেঘ এসে ঢেকে দিল নক্ষত্রদের। এ কি অলুক্ষুনে কাণ্ড!
আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছি কোনও একটা অতিপ্রাকৃতিক শক্তি প্রবল ভাবে বাধা দিতে চাইছে আমাদের। তারা চায়না যে আমরা তাদের জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করি। তারা চায়না তাদের পবিত্র পাহাড়ের চুড়ায় পড়ুক বিধর্মী মানুষের পায়ের ছাপ। বিকেলের দামামার শব্দ, যাকে আমরা অলৌকিক রণবাদ্য ভেবে আমোদ পেয়েছিলাম তা আসলে ছিল তারই সংকেত। পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে এই কথা। দুটো বিষধর শহুরে দ্বিপদ কে দেখা গেছে এ অঞ্চলে। নিশ্চিহ্ন করো ওদের, রক্তবীজের বংশ ওরা, এসেছে সব লুটে পুটে নিতে। ওরা মায়াবী, জাদু মন্তর জানে, সহজ ব্যবহারে ভুলিয়ে নিতে এসেছে তোমার অধিকারের অরণ্য, প্রিয় সবুজ, যুগ যুগ ধরে এভাবেই আসছে ওরা, ওদের বিশ্বাস করোনা। মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা সোনার প্রতি ওদের লোভ, প্রান্তরের বুকে ছড়িয়ে থাকা কুয়াশার প্রতি ওদের লোভ, আলুলায়িত অরণ্যের যুবতী শরীরের প্রতি ওদের লোভ। এই লোভই ওদের পরমারাধ্য দেবতা, ওদের চালিকাশক্তি। ওদের হত্যা করো, খতম করো। নিকষ অন্ধকারের জমাট হাত দিয়ে কে যেন আমাদের গলা টিপে ধরেছে, বন্ধ হয়ে আসতে থাকে আমাদের নিঃশ্বাস, আমি ছটফট করে উঠি, পালাবার পথ খুঁজতে থাকি। পাশে তাকিয়ে দেখি ধর্মকেতু নিশ্চল ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। আমি তাকে পালাতে বলি, সে আমাকে নিশ্চয়তা দেয়, সমাহিত স্বরে বলে, প্রায়শ্চিত্তের সময় এসেছে বন্ধু, আমাদের পিতৃপুরুষের বহু ঋণ শোধ করা বাকি ছিল, তারাই টেনে এনেছে আমাদের এই গহনে, মুক্তির আর দেরী নেই, অগ্রজের পাপ কে বয়ে বেড়ানোর এই বুঝি শেষ, প্রস্তুত হও। আমার মাথা কাজ করেনা, প্রশ্ন করি, তাহলে আমাদের পাহাড়ের চুড়ায় যাওয়ার কি হবে? সে মৃদু হেসে বলে, ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো, পাহাড়ের চুড়াতেই তো বসে আছো, চারিদিকে ব্যাপ্ত হয়ে আছে অধর্মের পর্বতশ্রেণী আর পাপের সুউচ্চ গিরিশৃঙ্গ!
আমার পা অবশ হয়ে আসছে, গলা শুকিয়ে কাঠ, উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি দূরের বনভূমির আকাশে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে, দুন্দুভির রণবাদ্যে কান পাতা দায়। প্রকৃতির পরম মমতাময়ী সংহারক এই আগুন এসেছে আমাদের মুক্তি দিতে, আমাদেরই পাপের আগুন এগিয়ে আসছে ক্রমে, এই শাশ্বত আগুনে পুড়ে ছারখার হবে সমস্ত অধর্মের ইতিহাস, সমস্ত স্বেচ্ছাচারের মহাকাব্য। ধর্মকেতু নিশ্চল ধ্যান মুদ্রায়, অর্ধ নিমীলিত চোখ মাটির ওপর রেখে বিড়বিড় করে প্রলাপ আওড়াতে থাকে। তার বিকারগ্রস্থ অস্তিত্ব আমার স্নায়ুর ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে, আমি সেই নারকীয় অন্ধকারের মধ্যে পাগলের মত এদিক সেদিক ছুটোছুটি করে এই গোলকধাঁধা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার রাস্তা খুঁজতে থাকি। ধর্মকেতুকে চিৎকার করে বলি, কিছু করো বন্ধু, তন্ত্র মন্ত্র মারণ উচাটন- কিছু একটা করো, আর তার গোঙানির মত বিড়বিড়ানির শব্দ আমার কানে সহস্র জলপ্রপাতের মত আছড়ে আছড়ে পড়ে, “বড় দেরী হয়ে গেছে বন্ধু, বড়ই দেরী হয়ে গেছে, পালাবার আর কোনও পথ নেই, পুরুষকার কে প্রকৃতির হাতে সমর্পণের পালা এইবার, সভ্যতার ইতিহাসের উপসংহার লেখা হবে আদিমের বর্ণমালায়, প্রস্তুত হও সকলে প্রস্তুত হও…”
***
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।