বিন্তিপিসির সাদা খাম

সেদিন সকালে বিন্তিপিসির বাড়িতে গিয়ে হতচকিত হতেই হল। বিন্তিপিসি একটুতেই প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে ওঠে সেকথা সবাই জানে, কিন্তু একটু যেন বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করলাম। অবসরপ্রাপ্তা বিন্তিপিসি ব্যতীত সর্বক্ষণের কাজের মেয়ে মিনিদি দ্বিতীয় এবং একমাত্র প্রাণী যে বিন্তিপিসির ফ্ল্যাটে থাকে। কিন্তু মিনিদিও দেখা গেল কিছুই জানে না, তাকে কিছু জানাতে হবে এই প্রয়োজনটাই বোধ করেনি পিসি।

বিন্তিপিসি যে কিছু একটা হারিয়েছে, সেটা আমি বুঝতে পারলাম। মিনিদির থেকে এও জানা গেল সেটা একটা সাদা খাম। সেই সাদাখাম, যা পিসির হাতব্যাগে একাধিক, সময় সময় হয়ত বা দশাধিক থাকে, এমনকি বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশাধিক থাকলেও আমি বিস্মিত হব না, বিভিন্ন খামে খরচভিত্তিক টাকা ভাগ বাঁটোয়ারা করে রাখা থাকে, তবে সবগুলি খাম যে সবসময় ব্যস্ত থাকে, এমন নয়, কিছু নিষ্কর্মা খামও কয়েকটা ট্রেনি খামকে নিয়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকে। তার থেকে একটা হারিয়ে ফেলে পিসিকে এত উতলা হতে দেখে মন খারাপ হল। আমি গোয়েন্দাগিরি শুরু করার চেষ্টা করলাম। মিনিদি ধীরেসুস্থে এবং বিন্তিপিসি ঠিক উল্টোভাবে ফ্ল্যাট তোলপাড় করতে করতে যা জবানবন্দী দিল তা অনেকটা এইরকম।

গতকাল বিন্তিপিসি বিকেলবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়ে একটা দাঁত তোলায়, সেখান থেকে কলেজস্ট্রিটে একাধিক বইয়ের দোকান ঘুরে একটি ওষুধের দোকানে গিয়ে কিছু ওষুধপত্র কেনে, এরপরে বিন্তিপিসি একটি বিয়েবাড়িতে যায়, সেখান থেকে খেয়েদেয়ে রাতে বাড়ি ফেরে। পিসির যদ্দূর মনে পড়ে, তা হল, ওষুধের দোকানে পিসি খামটিকে শেষবার ব্যাগে দেখে, তারপরে আর মনে পড়ছে না

– আচ্ছা কি ছিল সেই খামে? টাকা পয়সা ছিল না তো? তুমি তো আবার…

উত্তরে বিন্তিপিসির মুখ থেকে কিছু অবোধ্য বিড়বিড়ানি বেরিয়ে এল। মিনিদিও আলো ফেলতে পারল না। বইয়ের র‍্যাক, হাতব্যাগ সব তিন-চারবার হাতড়ানো দেখার পর আমি বললাম – ‘আচ্ছা বিয়েবাড়িতে ফেলে আসোনি তো বাই চান্স?’ ব্যস, বিন্তিপিসি মনে হল যেন হাতে চাঁদ পেল। এই অপশনটা বিন্তিপিসি বোধহয় আগে ভেবে দেখেনি। সাথে সাথে টপ প্রায়োরিটি – হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস, এই কথাটা এতক্ষণ মাথায় আসেনি – ঘোষণা করেই বিন্তিপিসি ফোন ঘোরালো। বিয়েবাড়িতে কে একটা সাদা খামের খোঁজ রাখবে – এইসব বিন্তিপিসিকে কে বোঝাবে, বা কেউ বোঝাতে চাইলেও পিসি বুঝবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। অতএব……কিন্তু এ কি হল!! ওপার থেকে ‘হ্যালো’ শুনেই পিসির সব কিছু কি ঘুলিয়ে গেল!!! ‘কিরে, কাল তোরা কখন ফিরলি? কখন সব ঝামেলা মিটল? কবে দ্বিরাগমনে যাচ্ছে?’ এইসব নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তার সাথে বিন্তিপিসির এটাও মনে হল নববিবাহিত বর-বউকে একদিন নেমন্তন্ন করাটা কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে, অতএব সেটাও সেরে ফেলল। আসল কথা কেন বলছে না, আমি ভাবছি ভুলেই গেল কিনা। যদিও ভুলে যাওয়াটা একরকম অসম্ভব বললেও চলে, তবু দৈবক্রমে ঘটনাটি যদি ঘটেই যায়, তাহলে যার ওপর সবচেয়ে বেশি কোপ পড়তে পারে সেই মিনিদি প্রায় পিসির চোখের ভেতর ঢুকে গিয়ে মুখ এবং হাতভঙ্গি করে বলার চেষ্টা করছে ‘সাদা খাম, সাদা খাম’ এমন সময় পিসি প্রায় আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল – কি হয়েছে? আমরা ভাবলাম মিনিদির ওপরেই এই বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু সাথে সাথেই পিসিকে আশ্বস্ত হতে দেখে আমরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। একটু পরেই পিসি হো হো করে হেসে উঠল –দেখেছিস আমার অবস্থা? আর বলিস না, ওটা আমারই কান্ড। আচ্ছা, আমি মিনিকে পাঠাচ্ছি, দিয়ে দিস একটু

বিন্তিপিসি আবার হাতব্যাগ খুলল। একটা খাম বের করে তাতে কিছু টাকা দিয়ে মিনিদির হাতে দিয়ে বলল – মিনি, এটা নিয়ে যা। নতুন বউয়ের হাতে দিবি আর পূর্নিমার কাছে খামটা রাখা আছে, নিয়ে আসিস

মিনিদি বেরিয়ে গেল। আমি ব্যর্থ হব জেনেও আবার প্রশ্ন করলাম – কি ছিল ওই খামে

আমাকে অবাক করে বিন্তিপিসি মুখ খুলল – আরে দাঁত তুলিয়ে দাঁতটা রেখেছিলাম, ভেবেছিলাম টাকাটা পরে ভরে নেব, ভুলে গিয়ে সেই দাঁতের খামটাই…আর বুঝলি তো দাঁতটা আমার একটু দরকার

 

দুঃখিত!