
ছেলেবেলার সিনেমা-ভক্তি আর ঢাকায় প্রথম ভূতের দেখা
ছোটবেলা থেকেই আমার সিনেমা দেখার নেশা খুবই মারাত্মক। জন্ম অজপাড়াগাঁয়ে। স্কুলে যেতে হলে দু’ গাঁ পেরিয়ে যেতে হতো। সবে মাত্র হাইস্কুলে উঠেছি। গাঁয়ের বড় ভাইয়েরা, যারা কলেজে পড়ে, তাদের কাছ থেকে সিনেমার গল্প শুনি। কোথায় কোন নায়ক কোন নায়িকাকে নিয়ে পালিয়ে গেল, কোন ভাঁড় কী বলে হাসালো—মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি আর গোগ্রাসে গিলি।
থাকি কাচারিঘরে। সন্ধ্যার পর হ্যারিকেন জ্বালিয়ে পড়াশোনা করি। রাতের গ্রাম — আটটা বাজতেই যেন গভীর রাত নেমে আসে। তখন মনজুড়ে বসে অদ্ভুত সব চিন্তা — কার গাছের নারকেল চুরি করব, কার খোয়াড়ের মুরগি নিয়ে বাহাদুরি দেখাব বন্ধুদের সামনে। শীতকাল এলে মাথা আরও খারাপ হতো — চারদিকে যাত্রাপালার ধুম। দূরের কোন গাঁয়ে যাত্রার খবর পেলেই বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে কাচারিঘরে বালিশ দিয়ে মানুষ বানিয়ে কাঁথা মুড়িয়ে প্রক্সি দিতাম। তারপর দলবেঁধে রহিম-রূপবান, ভেলুয়া সুন্দরী, একটি পয়সা—এসব পালা দেখে ফিরতাম ভেজা মাঠ পেরিয়ে, মুখে ‘বিবেকের গান’ গাইতে গাইতে।
ভাবছেন, আমি বুঝি কোন শতাব্দীর গল্প বলছি? আসলে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের গ্রামের গল্প—যা আজকের কম্পিউটার যুগে শুনলে অবিশ্বাস্যই ঠেকে।
এমন বাঁদরামিতে অতিষ্ঠ হয়ে, আর কলেজে পড়ুয়া কাকাদের উৎসাহে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন—আমাকে ঢাকায় পাঠাবেন, ভালো হাইস্কুলে পড়ানোর জন্য। ভর্তি করিয়ে দিলেন পুরান ঢাকার এক বনেদী স্কুলে। থাকতাম স্কুলের হোস্টেলে — চারতলা পরিপাটি বিল্ডিং। হোস্টেল সুপার রাশভারী, কড়া মেজাজের লোক। প্রতিদিন সন্ধ্যায় হোস্টেল ভিজিট করেন — সাথে থাকেন ইয়া বড় গোঁফওয়ালা দারোয়ান ‘মন্ত্রী কাকা’। কে কবে তার নাম ‘মন্ত্রী’ রেখেছিল, গবেষণার বিষয়!
মন্ত্রী কাকার নজর এড়িয়ে সন্ধ্যার পর হোস্টেলের বাইরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তার কড়া নজরদারিতে আমার রাতের উচ্ছৃঙ্খলতা গায়েব হয়ে গেল। হয়ে গেলাম ‘সুবোধ বালক’।
তবে প্রতিদিন রিকশায় স্কুলে যাওয়ার পথে একটা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে যেতাম — বুকের ভেতর হালকা দীর্ঘশ্বাস জমা হতো। ভাবতাম, হুট করে যদি ঢুকে যেতাম!
তারপর এলো রোজার ঈদের ছুটি। হোস্টেল ফাঁকা, প্রায় সবাই বাড়ি চলে গেছে। আমিও যাব, কিন্তু আমার সহযাত্রী কাকা দু’একদিন দেরি করবেন বলে জানান। হাতে কোনো কাজ নেই, কোনো পড়াশোনার চাপ নেই।
হঠাৎ মাথায় এল বুদ্ধি — আজ সিনেমা দেখব!
মন্ত্রী কাকা প্রতিদিন রাত ৯টার দিকে সামনের চায়ের দোকানে যান। তখনই পেছনের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে বের হব, সিনেমা দেখে ফিরে আবার সেই দেয়াল টপকে ঢুকব। ঠিক যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ।
রাত পৌনে ৯টার সময় পা টিপে টিপে পেছনের গলি দিয়ে রওনা দিলাম। একটু দূরের সিনেমা হলে গেলাম, যাতে কেউ চেনা মানুষ দেখে না ফেলে।
সিনেমা হলে পৌঁছে যেন শান্তি পেলাম — আহা, এতদিন পরে সিনেমা! টিকিট কেটে ঢুকে গেলাম নাইট শোতে।
রোমান্টিক সিনেমা ছিল, বেশ ভালো লাগল। একটা ঘোরের মধ্যেই পুরো সিনেমা দেখে ফেললাম।
সিনেমা শেষ। বাইরে বেরিয়ে রিকশা খুঁজলাম — কেউ যেতে চায় না। অগত্যা হেঁটে রওনা দিলাম হোস্টেলের দিকে।
রাস্তায় টুংটাং করে দু’একটা রিকশা যাচ্ছে, আর আমি সিনেমার দৃশ্য মনে করে হাঁটছি। হঠাৎ “হল্ট!” আওয়াজে ঘোর কাটল। চমকে দেখি, এক ট্রাফিক আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে সাদা পোশাকে একজন ট্রাফিক পুলিশ — হাত বাড়িয়ে আমাকে থামতে বলছেন।
আশ্চর্য! এত রাতে ট্রাফিক পুলিশ? ভালো করে তাকিয়ে দেখি — তার হাতের পাঁচটা আঙুল অস্বাভাবিক রকম মোটা!
ভয়ে শরীর কাঁপতে লাগল। ও মা! মনে হয় ভূত!
চোখ বন্ধ করে দৌড় দিলাম হোস্টেলের দিকে। আতঙ্কে গেটের সামনে এসে চিৎকার করতে থাকলাম—
“মন্ত্রী কাকা! গেট খোলো!”
মন্ত্রী কাকা বিরক্ত মুখে গেট খুলে জিজ্ঞেস করলেন, “এত চেঁচামেচি করছ কেন?”
আমি বললাম, “এইমাত্র মোড়ের ট্রাফিক সিগনালে একটা ট্রাফিক ভূত দেখলাম — হাতের পাঁচটা আঙুল ইয়া মোটা মোটা!”
মন্ত্রী কাকা আমার সামনে তার হাত মেলে বললেন, “দেখ তো, এই পাঁচটা আঙুল কিনা?”
আমি চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি আমার বিছানায় — পাশে বসে কাকা। সব কথা খুলে বললাম। তিনি বললেন,
“হ্যালুসিনেশন।”
মন্ত্রী কাকা বললেন,
“আমি তো গেটই খুলিনি।”
আমি গল্পটা আর কাউকে বলিনি। শুধু মনে মনে বলেছি — “যা দেখেছি, তা আমি জানি।”
কিন্তু আজো ভাবি —
“সব যদি হ্যালুসিনেশনই ছিল, তাহলে সিনেমা দেখলাম কীভাবে?”
“আর গেটই বা খুলে দিল কে?”