দিনু মণ্ডলের ওই বিঘে দশেক জমি নামেই তিন ফসলি আসলে সেই বাগ্দীপাড়ার তালপুকুরের মতই, বছরে ছ’সাত মাসই থকথকে কাদা আর বর্ষা এলেই দু’কূল ছাপিয়ে থইথই। চাষের খরচ তুলতে অর্ধেক ধান বিক্রি করে বাকি ধান ভাঙিয়ে সম্বৎসরের খোরাকী জোগাতে হিমসিম খায় দিনু। বড়টা ক্লাস ফাইভে দুবছর ঘষটিয়ে এবারই সিক্সে উঠলো। মাঝের মেয়েটা আর ছোট ছেলেটা পিঠোপিঠি, চার আর ছ’বছরের। পেট বাড়ছে কিন্তু ফলন সেই একই, গত তিনবছরে ধানের দামও বাড়ল না। তার ওপর আবার গোদের ওপর বিষ ফোড়ার মত কাল হয়েছে পৈতৃক তিন ফসলি জমিগুলো। এক ফসলি হলে গত বছর ধান উঠলে আর আলুর চাষও করত না আর অতি বৃষ্টিতে জমির আলু জমিতে পচতও না। এই বছরের ধান বেচেও গত বছরের আলু চাষের লোকসান মেটেনি তার ওপর রয়েছে এবছরের আলুর অস্বাভাবিক অধিক ফলন। কোল্ড স্টোরেজেও ঠাঁই নেই। জমির আলু মাটিতেই লুকিয়ে আছে, কেনার লোক নেই। আলু চাষ করতে গিয়ে বৌয়ের সোনার চেন বন্ধক দিয়ে টাকা ধার নিয়েছিল দিনু। আজ বৌয়ের শেষ সম্বল কানের দুল জোড়া মহাজনের হাতে দিয়ে পাঁচশো টাকার চারটে নোট লুঙ্গির কোঁচড়ে পুরে দিনু পা বাড়াল রহিমের চোলাইয়ের ঠেকের দিকে। বিটনুন আর কাঁচালঙ্কার টাকনা দিয়ে একপেট চোলাই খেয়ে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতেই রাত দশটা। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা শব্দের একঘেয়েমি কাটাতেই যেন মাঝে মাঝেই ডেকে উঠছে শেয়ালের দল। তিনমাস বিল বাকি তাই কাটা পরেছে ইলেকট্রিকের লাইন। একে নেশার ঘোর তার ওপর ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, ঠিক যেন ঠাওর করতে পারছে না দিনু। চোখ কচলে দেখল হেঁসেলের দাওয়ায় কাঠের পিড়িতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে ওর আদরের বৌ মিঠু। টিমটিমে লন্ঠনের আলোয় মিঠুকে হঠাত যেন অনেক দিন আগে গঞ্জের হলে দেখা ডর সিনেমার জুহি চাওলার মত দেখাচ্ছে। দিনুকে দেখে থমথমে নিঃস্পৃহ গলায় মিঠু জিজ্ঞেস করল-
– “বাচ্চারা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমায় খেতে দেব?”
মিঠুর কোনও কথাই কানে গেল না দিনুর। ওর মাথায় তখন বৃষ্টিভেজা জুহির উত্তেজক কল্পনা। মিঠুর হাত ধরে এক হেঁচকায় ওকে তুলে বুকে জড়িয়ে মিঠুর নরম শরীরটা পিষতে পিষতে নেশা জড়ানো গলায় বলে চলেছে-
– “আজ তোকে সারারাত সোহাগ করব! সারা রাত! অনেক অনেক সোহাগ… অনেক অনেক….”
বলতে বলতে রাতের চাপচাপ অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে ওরা ঢুকে গেল ঘরে আর লন্ঠনটা জ্বলতেই থাকলো তেল শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
মোরগ ডাকার আগেই ঘুম ভাঙল মিঠুর। একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া দিনুর শরীরটাকে তখনও জাপটে ধরে আছে আর পাশেই পড়ে আছে ফলিডলের শিশিটা। কাল রাতের শেষ সোহাগের বীজ শরীরে নিয়ে মিঠু ডুকরে কেঁদে ওঠার আগেই মোরগগুলো ডেকে উঠে বুঝিয়ে দিল ভোর হচ্ছে, আবার নতুন সকাল….
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।