বেলা শেষের গান-৩

মডেল স্কুলে ভর্তি হবার কিছুদিন পরে যখন তার বৃত্তি পাবার সংবাদ জানতে পারল তখন আক্কাস সাহেব খুশি মনে নিজে চেয়ার চেড়ে এসে হাসানের ক্লাসে ঢুকে টিচারের অনুমতি নিয়ে সংবাদটা জানাল। এর মধ্যে তার নিজের স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছাত্র বৃত্তি পেয়েছে এবং তা এরা খুব ধুমধাম করে উদযাপন করেছে। তবে হাসানের স্কুল দূরে থাকায় এ সংবাদ একটু দেরিতে পৌঁছেছে। হাসানকে তার ক্লাস শেষ হলে তার রুমে গিয়ে দেখা করার কথা বলে বের হয়ে গেলেন।

স্যার আসতে পারি? –কে? স্যার আপনি আসতে বলেছিলেন। ও আচ্ছা তুমি! আস আস। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তোমার মত ছেলেই আমার চাই। তুমি প্রতিদিন সকালে আমার বাসায় যাবে, এখন থেকে আমি তোমাকে পড়াব। আচ্ছা স্যার। আমার বাসা চেন? ঐযে পুকুর পাড়ে বড় টিনের ঘর………………আমি চিনি স্যার! চেন? বেশ, তাহলে এসো।
পরদিন সকালে বই খাতা নিয়ে হোস্টেল থেকে বের হয়ে পায়ে পায়ে পুকুর পাড় দিয়ে এসে কাঠের গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকেই দেখে কি সুন্দর ফুলের বাগান, পার হয়ে বড় ডাক বাংলো ধরনের বাড়ির বাইরের বারান্দায় একটা টেবিলে হেড স্যার আর তার সাথে দুই পাশে দুই মেয়ে বসে পড়ছে। আস্তে আস্তে হাসান দরজার পাশে এসে দাড়াতেই পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকিয়ে হাসানকে দেখে আরে আস আস! এত দেরি করলে কেন? বস বস এইযে এখানে বস। টেবিলের ওপাশের খালি চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন। সংকোচ ভরা ভীরু পায়ে হাসান আস্তে আস্তে স্যারের দেখান চেয়ারে বসল। বস। এরা আমার মেয়ে এ হলো দীপা আর এ নিপা। শোন এ হচ্ছে হাসান আমাদের স্কুলে নতুন এসেছে, জানিস এ কিন্তু বৃত্তি নিয়ে এসেছে। হাসান একটুখানি মাথা ঘুড়িয়ে দুই পাশে দুই বোনকে দেখল। একজন ফর্সা ডান চোখের পাশে ছোট একটা তিল, লাল সাদা ছাপা ফ্রক পড়নে আর একজন তার চেয়ে একটু চাপা গায়ের রঙ তবে সুন্দর ফ্রকে বেশ লাগছে দেখতে কিন্তু কে বড় আর কে ছোট বোঝার উপায় নেই। এমন সময় ফর্সা মেয়েটা বলে উঠল এই আপু পেন্সিলটা একটু দে না! তাই শুনে বুঝল তাহলে এই ফর্সা জনই ছোট আর এর নামই নিপা।

প্রায় ঘন্টা খানিক ধরে ক্লাসের পড়ার বাইরে ইংরেজি আর অংক দেখিয়ে দিলেন আক্কাস সাহেব। হাসান বের হবার জন্য উঠে দাঁড়ালো, স্যারের দিকে তাকিয়ে, তাহলে আমি এখন আসি। ক্লাসে যেতে হবে। হ্যাঁ ক্লাসে যাবে কিন্তু নাশতা করবে না? একটু বস। দীপা আর নিপা ভিতরে চলে গেল। এমন সময় খাদিজা বেগম ট্রেতে করে রুটি আর হালুয়া এনে হাসানের সামনে নামিয়ে দিল। নাও বাবা খেয়ে নাও। ও! তাহলে ইনি স্যারের স্ত্রী! আগেই স্কুলে দেখেছে কিন্তু বুঝতে পারেনি। দীপা আর নিপাকেও দেখেছে। আজ সবার সাথে পরিচয় হলো। সেদিনের মত নাশতা খেয়ে বের হয়ে এলো।
এর পর প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে এখানে আসা, পড়া আর নাশতা খাওয়া। দুপুরে এবং রাতে হোস্টেলেই খেতে হয়। অন্যান্য যারা তার মত দূর থেকে শিক্ষিত হবার জন্য, স্বপ্ন পূরণের জন্য এখানে এই স্কুলে এসেছে তারা সবাই। তবে সবার ভাগ্যে হেড স্যারের বাসায় নাশতার ব্যবস্থা হয় না। হাসানের হয়েছে। তার স্বপ্ন যে অনেক বড়, সিঁড়ি বেয়ে অনেক উপরে ওঠার আকাঙ্ক্ষা, ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নেয়ার বাসনা।

৫।
দেখতে দেখতে এক এক করে অনেকদিন চলে গেল। ফাইনাল পরীক্ষা সামনে এসে হাজির। প্রতিদিন স্যারের বাসায় আসতে যেতে দীপা আর নিপার সাথে বেশ অনেকটাই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে। রাতে শোবার পর একটু একটু ভাবনা এসে জড় হয়। কাকে বেশি ভাল লাগে বুঝে উঠতে পারে না। দীপা আর নিপার মনেও হাসানের জন্য একটু একটু করে স্বপ্নের জোয়ার বইতে শুরু করেছে। সব ব্যাপারে দুই বোন একজনের কাছে আর একজন খোলামেলা হলেও হাসানের ব্যাপারে কেও কারো কাছে কিছু প্রকাশ করতে পারে না। কোথা থেকে যেন বিশাল এক দেয়াল এসে দাঁড়ায়। কেও সে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে না। হাসানও কিছু বুঝে উঠতে পারে না। পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো সেদিন খাদিজা বেগম স্কুল থেকে বের হবার পথে হাসানকে বলে দিল আজ বেলা পড়ে গেছে অনেক দূরে যেতে হবে কাজেই আজ বাড়ি যেওনা কাল সকালে বাসা থেকে নাশতা খেয়ে বের হবে। তোমাদের রেজাল্ট হবে ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে তার আগেই চলে এসো। মাথা নিচু করে আচ্ছা বলে বেরিয়ে এসেছে।
পরদিন সকালে যথারীতি হেডস্যারের বাসায় যেয়ে দেখে আগের মত আজ আর কেও টেবিলে বসে নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সিঁড়িতেই কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে একা একা কোথাও দাঁড়িয়ে থাকা যায় না কোন না কোন ভাবনা এসে মনের সঙ্গী হয়ে যায়। এখন ওই দীপা আর নিপার ছায়া মনের সঙ্গী হলো। কে ভাল? কার জন্য মনটা কেমন করে বলতে পার? হাসান বোকার মত দাড়িয়েই রইল। কি বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। দেখতে নিপা বেশি সুন্দর কিন্তু বড্ড খিটখিটে, তার চেয়ে দীপা অনেক শান্ত, মোমের আলোর মত ম্রিয়, একাদশীর জোসনার মত স্বচ্ছ তুলতুলে। একটুতেই আঘাত পায়। কথাও বেশি বলে না, চুপচাপ থাকে । হেডস্যারকে দেখেছে কখনও ওর সাথে জোরে কথা বলেনা। এমনি কত কি ভাবছে এমন সময় ম্যাডাম এসে ওকে দেখে অবাক। ওমা! তুমি দাঁড়িয়ে কেন, কখন এসেছ? তোমার দেরি দেখে ভাবছিলাম তুমি কি চলেই গেলে নাকি! এসো ভিতরে এসো। বলে গেট খুলে দিল। আস ভিতরে আস বলে এগিয়ে গেল, পিছনে দেখল হাসান আসছে কি না। আস! লজ্জার কি আছে, তুমিতো আমাদের ছেলের মতই। মাদুর পেতে বসিয়ে মুরগির মাংস দিয়ে খিচুরি খেতে দিয়ে পাশে বসে রইল। হাসানের উৎসুক দৃষ্টি কাউকে খুঁজতে চাইছিল কিন্তু লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিল না। বাড়িতে স্যার বা দীপা নিপার কোন সারা না পেয়ে ভাবছিল ওরা হয়ত বাইরে কোথাও গেছে। একটু পরেই দেখল দীপা আর স্যার পিছনে নিপা বাইরে থেকে ফিরে আসল। যা ভেবেছিল তাই। নিপা বাড়িতে থাকলে বাড়ি এমন নীরব থাকত না।
এইযে হাসান তুমি কি আজকেই বাড়ি যাবে? জী স্যার এখনই যাব, আমি ব্যাগ গুছিয়ে রেখে এসেছি। এখান থেকে খেয়ে হলে গিয়েই বের হব ভাবছি। বেশ ভাল কথা, মায়ের কাছে যাবে এসো, সঙ্গে বইখাতা কিছু নিয়েছ? নিয়েছি। আচ্ছা তাহলে ২৭ তারিখের আগেই ফিরে এসো আর যে অংকগুলি দেখিয়ে দিয়েছি সেগুলি করবে। এর মধ্যে হাসানের খাওয়া হয়ে গেছে। হাত ধোবার সময় বলল তাই আসব। হাত ধুয়ে পিছনে ঘুরে দেখে দীপা একটা গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এগিয়ে দিল। দীপার মুখের দিকে একটু লাজুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গামছা নিয়ে হাত মুছে আবার ওর হাতে ফিরিয়ে দিল।
তাহলে স্যার, ম্যাডাম আমি যাই? যাই না বাবা বলতে হয় আসি! এসো।

মানিকগঞ্জ থেকে সুতি পাড়া নেমে ৩/৪ মাইল পথ হেটে যেতে হয়। একা হাটা পথে কত কি ভাবনা ভাবছে আর হাঁটছে। কোথা থেকে যেন দিবা এসে সামনে দাঁড়ালো। হাসান একটু থমকে উঠে থেমে গেল। না কোথাও নেই! সামনে পিছনে ডাইনে বায়ে কোথাও নেই। ও তাহলে আমি ওর কথাই ভাবছিলাম? হ্যাঁ তাইতো ভাবছিলে! কেন, মনে পড়ছে না ঐযে প্রথম যেদিন হালকা আকাশী রঙের ফুল ছাপা ফ্রক গায়ে দেখেছিলে সেই ছবি তোমার মনে একে দিয়েছে, কে দিয়েছে জান? কে? তোমার মন! তুমিতো ওই ছবিই সবসময় ভাব। দুবোনকে আলাদা করতে না পারলে কি হবে দীপার কথাই যে সবসময় তোমার মনে আগে আসে! ভেবে দেখেছ? হ্যাঁ তাইতো!! কিন্তু! না না কোন কিন্তু নয় এই কথাই সত্য।কি জানি তাই হবে হয়ত। আবার একটু এদিক ওদিক দেখে হাটতে শুরু করল। এখনও অনেক পথ বাকি রয়েছে।
বাড়িতে পৌছতে প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় ভাব। একটু পরেই গ্রামের ঘরে ঘরে বাতি দেখা যাবে। অঘ্রাণের সবুজ গ্রামে এর মধ্যে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে একটু একটু শীত লাগছে। গ্রামের রান্না ঘর থেকে ওঠা ধোয়া আর কুয়াশা মিশে চাদরের মত ঢেকে দিতে চাইছে। পথের পাশে ধনেপাতা, জৈন এসবের গন্ধ বেশ লাগছে কিন্তু সেদিকে মন দেয়ার মত অবস্থায় নেই। স্কুলের কাছেই দেখা যায় দেবেন্দ্র কলেজ, এই স্কুল ছেড়ে কবেই যে কলেজে ভর্তি হবে সে কথা ভাবাই এখন মূল কথা, দীপা নিপার কথা ভেবে কি হবে? ওদের নিয়ে ভাবার মত সময় এখনও আসেনি। দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হব নাকি একেবারে ঢাকায় যাব? এই সব এলোমেলো ভাবতে ভাবতে কখন যেন বাড়ির পাশের পুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ করেনি। মা পুকুরের ঘাট থেকে পানি নিয়ে উঠে আসছিল হাসানকে দেখে থমকে গেল হাতের বাসন পেয়ালা পাড়ে নামিয়ে রেখে দৌড়ে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বাবা তুই কখন এসেছিস, আমাকে ডাকলি না কেন? [চলবে]

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!