আজানের শব্দে ধ্যান ভাঙে কণার।
বারান্দা থেকে মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। আসরের আজান দিয়ে দিলো?! এতক্ষণ ধরে এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে—ভেবে অবাক হয়!
মেয়েরা কী করছে কে জানে।
গত সন্ধ্যা আর আজকের দুপুরটার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল। এত সুখী একটা সময়, অথচ শুধু দু-একটা অসতর্ক শব্দের জন্য সব এভাবে নষ্ট হয়ে গেল।
সামান্যই ঘটনা—নাকি দুর্ঘটনা?
শিহাব বেড়ানো-পাগল মানুষ। প্ল্যান করছিল ছুটির শেষ দিনটা কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। কণা ঈদের কাপড়গুলোর মধ্যে থেকে বাছাই করছিল। শাড়ি যেটা পরতে চাচ্ছিল তার সাথে মিলিয়ে কোনো গয়না নেই। এক জোড়া মাঝারি হিলের স্যান্ডেলও দরকার ছিল। তাড়াহুড়ায় শাড়ির ব্লাউজও সেলাই করা হয়নি।
প্রত্যেকবার এমনই হয়। কিছু একটা গোঁজামিল দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়। যত বড় অনুষ্ঠানই হোক। সব ঠিক থাকে, শুধু কণার বেলায়ই এই অবস্থা। সবার খেয়াল সে রাখে, তার দিকে খেয়াল করার কেউ নেই। কিন্তু দোষ হলে ঠিকই খুঁজে পেতে ধরবে কেউ না কেউ।
মন খারাপ করে ঈদের দিন যা পরেছিল সেই সালোয়ার-কামিজই হাতে তুলে নিল। আয়রন করতে হবে। শিহাবের পাশ দিয়ে যাবার সময় মনের দুঃখ কি চেহারায় প্রকাশ পেল? কণার চেহারার পরিবর্তনটা শিহাব খেয়াল করল।
—এইটা ছাড়া কি আর পরার মতো কিছু নেই?
শিহাবের কথার ভেতরে কি উষ্মা প্রকাশ পেয়েছিল? বলার টোনে এমন কিছু ছিল, যা শুনে কণার ভেতরে মুহূর্তেই এতদিনের ছোটখাট পাওয়া-না-পাওয়ার দুঃখ জাগানিয়া ব্যথা মনে খোঁচা দিলো। তাৎক্ষণিক রিএকশনে ফস করে কণার মুখ দিয়ে বের হল—
—কত দিয়েছ মনে হয়?
মেয়েদের সামনে কথাগুলো শুনে শিহাবের নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হল। পরক্ষণেই লজ্জা, ক্ষোভ আর এক ধরনের অচেনা অনুভূতিতে জ্বলে উঠল। তবে একেবারে বেসামাল হল না। বড় মেয়ের দিকে তাকাতেই সে নীরবে ওর রুমে চলে গেল। ছোট মেয়েও বড় বোনকে অনুসরণ করল।
কথার গোড়ায় গিয়ে সে কথা শুরু করে, “কি পাওনি?”
কণার মুখ তখন ঘোর অন্ধকার। হয়তো কাঁদত। কি ভেবে শিহাবের চেয়ে কঠিন গলায় বলল, “তোমার তো জানার কথা!”
ব্যস। দপ করে জ্বলে উঠল দাবানল। দুই-এক কথায় বাড়াবাড়ি। কে কখন কি পায়নি… কে কী ছেড়েছে… কার কোন আত্মীয় স্বজন কাকে কখন কী কষ্ট দিয়েছে… শ্বাশুড়ি-বউ সম্পর্কের গুরুতর বিষয়ও… এভাবে হতে হতে এক পর্যায়ে গলার স্বর চড়তে চড়তে চিৎকার-চেঁচামেচি… অনেক বেশিই হয়ে যায়। রাগে হাতের কাছে থাকা কাঁচের গ্লাসটি দেয়ালে ছুড়ে মারে শিহাব।
তারপর…
শোক উথলে চোখ ছাপিয়ে গালমুখ ভিজে যায়। অযত্নে গায়ের উপর পড়ে থাকা ওড়নায় নেমে আসে পানি। না-খাওয়া দুর্বল শরীরটা দুঃখে কাঁপতে থাকে।
কে আছে কণার? সংসারে একমাত্র যে মানুষটাকে তার কষ্টের কথা বলতে পারত—সেও এই!
অথচ…
দু-একটা সুখী মুহূর্তের ছবি কান্নাটাকে আরো উসকে দেয়। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো দুঃখ আর কান্না দুর্বার বইতে থাকে অনুভূতির উঁচু-নিচু ভেঙে।
একসময় শান্ত হয়। নিঃশব্দ ভাবনা হয়ে বইতে থাকে।
বইতে থাকে সময়ও।
—আম্মু, খাবে না?
বড় মেয়ের ডাকে ধ্যান ভাঙে কণার।
সেই কখন থেকে সে নিজেও না খেয়ে আছে। সাথে মেয়েরাও।
—রাইসাকে নিয়ে খাবার টেবিলে যাও। আমি আসছি।
একজন স্ত্রী মুহূর্তেই মায়ের রূপে ফিরে আসে। কিন্তু তাতে কি তার হৃদয়ের জ্বালা একটুও কমে? এই রূপান্তরে নিজের ভেতরের ভোঁতা অনুভূতিগুলো কি আগের সতেজ অবস্থায় ফিরে আসে?
দীর্ঘশ্বাসগুলো নামেই মাত্র দীর্ঘ। সেগুলোও কি আরো হ্রাস পায়?
নাকি মস্তিষ্কের ঝিল্লিগুলো হৃদয় নামের এক বিচিত্র মাংসপিণ্ডের ক্রমাগত সংকোচন-প্রসারণের বাইরে আরও কিছু বর্ণনাতীত কর্মকাণ্ডের দ্বারা রিফ্রেশ হতে চায়?
চিন্তাভাবনাকে শিকেয় তুলে দিয়ে কণা জোর করে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।
কিন্তু এত অস্বাভাবিকতার ভেতরে বিক্ষিপ্ত মনকে সাথে নিয়ে তাও কি হওয়া যায়?
… … …
ঈদের দীর্ঘ ছুটির পর আজ অফিস খুলছে।
খোলার প্রথম দিনটি কেমন যেন অফিস-অফিস মনে হয় না। ওদেরটা পোশাক কারখানা। গার্মেন্টস বললেই হয়তো বেশী পরিচিত মনে হয়। এই একটা শব্দ সাধারণ এবং অসাধারণ—এই দুই শ্রেণীর মানুষের কাছেই শ্রবণের প্রথম পর্যায়েই ভালো-মন্দ দুই রকম অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
—কি করেন আপনি? এই প্রশ্নের উত্তরে যদি বলা হয়,
—ভাই, আমি একটা পোশাক কারখানায় গোলামি করি।
শুনে প্রথমটায় অনেকেই বলে ফেলে,
—বুঝলাম না।
—ভাই, গার্মেন্টসে চাকরি করি।
—ওহ! গার্মেন্টস! তাই বলেন।
এই যে “ওহ! গার্মেন্টস” বলার টোন—এতে দুই ধরণের ভাবপ্রকাশ পায়। অনেকেরই ধারণা, যারা অন্য কোথাও চাকরি পায় না, তারাই এখানে আসে। সেদিন কে যেন বলেছিল—নাকি কোথায় যেন পড়েছিল—“ক্লাসের সব থেকে খারাপ ছাত্রটি কোথাও সুযোগ না পেয়ে শিক্ষকতায় চলে আসে। সে আরও খারাপ ছাত্র তৈরি করে এবং তাদের ভেতর থেকে সব চেয়ে খারাপ ছাত্রটি শিক্ষক হয়।”
এটি নিতান্তই কথার কথা—ভাবল শাহেদ। তবে এর ভেতরে কি একটুও সত্যতা নেই? নিজের ডেস্কে বসে ভাবনার গভীরে ডুব দিলো সে। খারাপ ছাত্রের শিক্ষক হবার ব্যাপারে মতৈক্য থাকলেও, গার্মেন্টসে সবাই আসে শুধু ব্যর্থতার কারণে—এটা মানতে নারাজ সে।
এখন আর আগের মতো নেই। প্রতিটি সেকশনে এখন শুরুতে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যাদের নেওয়া হয়, সবাই হয় এমবিএ করা, নাহয় টেক্সটাইল গ্র্যাজুয়েট। শাহেদ নিজেও ঢাকা ভার্সিটি থেকে এমবিএ শেষ করে বেশ আগেই এই কারখানায় ঢুকেছে।
মোবাইল বেজে উঠতেই চিন্তা ছিন্ন হল।
বাবার ফোন!
মনটা আনন্দে ভরে উঠল। এই তো গতকালই বাড়ি থেকে এসেছে। তারপরও…
কল রিসিভ করে… পরিচিত ভরাট কণ্ঠস্বর শুনে ভালোলাগা যেন স্বর্গ থেকে আলোর গতিতে ছুটে এলো! অন্য কেউ ঠিক এই মুহূর্তে শাহেদকে দেখলে—এক অপার্থিব আলোয় উদ্ভাসিত মানুষটিকেই দেখত।
যে আনন্দ নিয়ে বাবার সাথে কথা শুরু করেছিল, শেষ হল একটু অন্যভাবে। এখন খানিকটা চিন্তিত লাগছে তাকে।
নিজের ডেস্ক ছেড়ে এইচ.আর. ডিপার্টমেন্টের দিকে এগোল। সেখানে শিহাব রয়েছে—সেই সেকশনের ম্যানেজার। ইচ্ছে করলে ফোনে ডেকেও পাঠাতে পারত। কিন্তু কিছু কিছু কথা আছে, যা ফোনে বলা যায় না।
শাহেদ ও শিহাব একই ভার্সিটিতে পড়াশোনার সুবাদে অনেক আগে থেকেই বন্ধু। তবে শাহেদ শিহাবের সিনিয়র। এখন সে অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার। তাই নিয়ম অনুযায়ী শিহাবেরই দেখা করতে আসার কথা।
নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছে শিহাব। ল্যাপটপ অন, মাউস হাতে। দৃষ্টি স্ক্রিনে, কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হল না। বারবার মাউস দিয়ে রিফ্রেশ করছে।
শাহেদ সামনে এসে দাঁড়াল—সে টেরও পেল না। গলা খাঁকারি দিতেই সম্বিৎ ফিরে পেল। উঠে দাঁড়াতে যেতেই শাহেদ হাতের ইশারায় বসতে বলল।
—কেমন আছো? ঈদ কেমন কাটালে?
—ভালো। তোমার?
—আলহামদুলিল্লাহ! কণা আর বাচ্চারা কেমন আছে?
—সবাই-ই ভালো আছে।
কথাগুলো ঠিকই ছিল, কিন্তু শিহাবের উত্তরের ভেতর থেকে যে স্বতঃস্ফূর্ততা শাহেদ আশা করেছিল, সেটা পেল না। কেমন যেন নির্লিপ্ত লাগল।
—কি ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো? এনিথিং রং?
হাসে শিহাব। মনের গ্লানিগুলো উড়িয়ে দিতে চায়।
—না, তুমি শুধু শুধু ভাবছ। আসো কোলাকুলিটা সেরে নেই।
দুজন বুকে বুক মিলায়। হৃদয়েও কি?
কথার মোড় ঘোরাতে শিহাব প্রশ্ন করল,
—ঈদে বাড়ি গিয়েছিলে?
—হ্যাঁ, গতকাল ফিরেছি।
…
এরপর আসে রায়হানের প্রসঙ্গ, এসোসিয়েশনের বন্ধুতা, আর ভাঙা সম্পর্কের প্রতীকী উপমা।
…
শেষে, নিজের ব্যবহারের জন্য শিহাব খুব অনুতপ্ত। কণার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু কিসের এক জড়তা তাকে ফোন করতেও দ্বিধায় ফেলে।
তবু সব কিছু ছাপিয়ে বারবার একটা কথা মনে ঘুরপাক খেতে থাকে—
“কণাও কি একটিবার ফোন করতে পারে না?”
(ক্রমশঃ)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।