
১৯৯৫ সাল। পৌষ মাসের শীতে তখন সবাই বেশ কাবু। তারিখ আর বার আমার ঠিক মনে নেই। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলাম। আমার হবি ছিল ছুটি পেলেই কোনও না কোনও আত্মীয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে আসা। যাই হোক, তেমনি এক ছুটিতে আমার এক কাজিনের বাসায় বেড়াতে গেলাম। তিনি থাকেন বান্দরবানে বাজার টাইপের একটা ছোটখাট এলাকায়। তিনি ঐ এলাকার একজন নামকরা ডাক্তার। দিন বা রাত যেকোনো সময়ই উনার ডাক পড়ত।
সেদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পর রুমে এসে বেশ আরাম করে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। ২ টান না দিতেই কে যেনো দরজায় নক করল। ঠক ঠক! দরজা খুলে দেখলাম আমার কাজিন। তিনি বললেন, উনার ড্রাইভার ছুটিতে গেছে, আর এই মুহূর্তে উনার একটি জরুরী ডাক পড়েছে। তাই আমার যদি সমস্যা না হয়, তবে তিনি আমাকে নিয়ে যেতে চান। সেই রুগীর বাসা থেকে এক লোক এসেছে।
কি আর করা! কপালে সিগারেটের সুখ সইল না! তড়িঘড়ি করে রেডি হলাম। ঘড়িতে তখন রাত ১১.৩০ বাজে। বাইরে আমার কাজিনের ১৯৮০ মডেলের নিসান সেন্টরা দাড় করানো ছিল। তাতে চেপে রওনা হলাম। গাড়িতে আমি, আমার কাজিন, আর সেই লোকটা। গাড়ির অবস্থা খুবই নাজুক। বান্দরবানের পাহারি রাস্তায় চলতে চলতে এইটার মেয়াদ প্রায় শেষ।
যাই হোক, ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে প্রায় নিভু নিভু হেড লাইটের আলোতে কোনোরকমে গন্তব্বে পৌঁছলাম। রাত তখন ১২ টার বেশি হবে। এলাকাটা খুব গহীন। ৪-৫ টা শুধু কুঁড়ে ঘর আর চারপাশে পাহাড় আর জঙ্গল। ঠাণ্ডাও পড়েছে অনেক। লোকটা আমাদের রাস্তায় অপেক্ষা করতে বলে লণ্ঠন আনার জন্য সরু একটা পথ ধরে হনহন করে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম সেই পথ দিয়ে অন্য একটা লোক আসছে। কাছে আসতেই দেখলাম, লোকটার চেহারা খুব হাসি খুশি টাইপের। কিন্তু কেন যেনও দেখলে একটু অস্বস্তি হয়। লোকটি আমাদের দেখে বললেন, “কে? ডাক্তার বাবু নাকি? ঐদিকে তো রুগীর হয়ে গেলো! হি হি!” এই বলে লোকটি আমাদের সামনে দিয়ে হনহন করে হেঁটে অন্ধকারে কোথায় যেনও মিশে গেলো।
গাড়িতে টর্চ ছিল, তা হাতে নিয়েই ছিলাম। আলো জ্বালিয়ে দেখলাম। কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না। খানিক বাদে সেই লোকটি লণ্ঠন হাতে ফিরে এলো। আমি গাড়িতে বসলাম আর আমার কাজিন গেলো লোকটার সাথে। ১০ মিনিটও হয়নি, দেখলাম আমার কাজিন যেনও ভূতের তাড়া খেয়ে ফিরে আসছে। হনহন হনহন করে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়ালো।
আমি ওর অনুপস্থিতির সুযোগে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম। কিন্তু সে ফিরে আসায় এইবারও অর্ধেক টেনে ফেলে দিতে হল। আমার কাজিন খুব দ্রুত গাড়িতে বসে বলল, “চল!” কিছুদূর যাওয়ার পর আমার কাজিন আনমনে বলল, “আচ্ছা, যে লোকটি আমাদের খবর দিয়েছিল যে রুগী মারা গেছে তাকে ভালো মত খেয়াল করেছিলি?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ! একটু আজব টাইপের। চেহারাটা দেখলে মনে হয় সারাক্ষণ হাসছে!” আমার কাজিন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল, “গিয়ে দেখি ঐ লোকটিই রুগী ছিল। অনেক আগেই মারা গেছে। মোড়ে একপাশে কাত হয়ে পড়ে ছিল। বাসায় ও কেউ ছিল না। বাসার একমাত্র লোকটা আমাদের আনার জন্য গিয়েছিলো। আসলে কি ঘটলো বলতো?”
এই বলে আমার কাজিন আরেকটু পাশ চেপে আমার একদম গা ঘেঁষে বসলো।